বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০১৫

রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ ও আমাদের দায়িত্ব

আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছিল তাতে বলা হয়েছিল, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়া হবে। দেশে বেকার থাকবে না। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। ফলে বেকারত্ব ও অভাবের কারণে দেশের হাজার হাজার খেটে খাওয়া কিশোর, যুবক ও মধ্যবয়সী নিম্নবিত্ত মানুষ মানবপাচারকারী দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে পড়েছে। ওই সব প্রতারকের দল বিদেশে চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা আদায় করেছে। বিদেশে চাকরি দেয়ার কথা বলে জনহীন বনাঞ্চলে নিয়ে যায়। এভাবে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র উপকূলের নির্জন বনাঞ্চলে নামিয়ে দেয়া হয় ভাসমান অভিবাসীদের। শুরু হয় ওদের অত্যাচার মুক্তিপণের অর্থের দাবিতে।
আগে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিপরিষদে এক মহিলা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তাকে জাতীয় সংসদে বলতে শুনেছি, কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের মাটিতে নামতে দেয়া হবে না। অথচ আরাকানে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ ভিু ও তাদের দাঙ্গাবাজ ভক্তরা। রোহিঙ্গাদের ওপর চলছে নির্যাতন। চলার পথে তাদের নানাপ্রকার অশোভন ভাষায় গালি দেয়া হয়। নারী নির্যাতন বাদ যায় না। হত্যা করা হয় কর্মক্ষম রোহিঙ্গাদের। তাদের এটাই দোষ যে, তারা মুসলমান। একসময় আরাকানে মুসলিম সুলতান ক্ষমতায় ছিলেন। যুবরাজ শাহ সুজা [মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের পুত্র] ভাতৃঘাতী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আরাকানের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এগুলো ইতিহাসের কথা। বাংলাদেশসংলগ্ন সেই আরাকান প্রদেশ বর্মিবাহিনী দখল করার পর সেখানে মুসলমানদের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। বাংলাদেশের সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে হুমকি দিয়ে বললেন, ওদের এ দেশে স্থান হবে না। 
ঠিক তার আগের রাতেই দেখেছিলাম অসহায় রোহিঙ্গাদের আকুতি। আরাকান ফিরলেই তাদের হত্যা করা হবে। এই নির্যাতিত, বঞ্চিত, নিঃসহায়, সম্বলহীন অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত রোহিঙ্গাদের জীবনে পরে কী ঘটেছে, জানা নেই। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে থেকে জাতীয় স্বার্থে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করা, মানবতার ডাকে সাড়া দেয়া এবং দুস্থদের সেবায় আত্মনিয়োগ করা কর্তব্য। কারণ-অকারণে দেশভ্রমণ, ফটো তুলে অ্যালবাম স্ফীত করার ঝোঁকে অনেক ঊর্ধ্বতন আমলা ও ক্ষমতাসীন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান এমন অভিযোগ অনেকের কাছেই শোনা যায়। পাশের দেশ মিয়ানমার বা বার্মার সাথে আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে জোরালো আলোচনা করার কথা শুনিনি। অবশ্য আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলো রোহিঙ্গাদের সাহায্য দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল।
সাবেক পূর্বপাকিস্তান, অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ছিল ব্রিটিশ আমলে অবহেলিত জনপদ। যোগাযোগব্যবস্থা ছিল চরম সঙ্কটময়। দীর্ঘকাল কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ঢাকা পরিণত হয় জেলা শহরে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বঞ্চনা ও অভাব অনটনের মধ্য দিয়েই বিশেষ করে ব্রিটিশ আমলে আমাদের জীবন কেটেছে। এজন্য আমাদের উচিত ছিল রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশার সমভাগী হয়ে বিষয়টি তুলে ধরা এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা লাভের জন্য সচেষ্ট থাকা।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। অথচ সেই দেশে ব্রিটিশ আমলের ঠগি ও পিন্ডারি দস্যুদের আদলে কিভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হাজার হাজার নাগরিককে দেশের সীমানার বাইরে নিয়ে গেল দালালরা? কর্তৃপক্ষের বা সীমান্ত প্রহরীর কারো নজরে বিষয়টি ধরা পড়ল না, এটা কী করে সম্ভব হতে পারে? এখনো বহু বাংলাদেশী সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, প্রশাসনের একাংশের সহযোগিতা ছাড়া এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কোনোভাবেই ঘটতে পারে না। এর খেসারত কে দেবে?
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ব্রুনেই, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ বাংলাদেশী অভিবাসীদের কোনো সাহায্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। বদনামের ভয়ে বাংলাদেশ সরকার আগেই ঘোষণা দিয়ে বসে, ওরা অধিকাংশই রোহিঙ্গা। এমন একটি বিব্রতকর অবস্থায় সমুদ্রে ভাসমান শত শত মানুষের ুধার্ত পিপাসার্ত থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। মহান রাব্বুল আলামিনের অশেষ করুণায় আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সরকারের লোকজন উদার হয়েছেন। তাদের হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হয়েছে বলেই আজ কিছুটা রক্ষা। এমনই একটি আশঙ্কাজনক অবস্থায় আমাদের সরকারের উচিত ছিল, সর্বপ্রথম এই বিপন্ন লোকদের সাহায্য করা।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশ, ছেলের কবর আর ঘাতকের খোঁজে সন্তানহারা পিতা কুইল্যা মিয়া থাই সমুদ্র উপকূলে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন। একটানা চার মাসের অব্যাহত চেষ্টায় ধরা পড়ল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাফিয়াচক্রের এক দুর্বৃত্ত, আনোয়ার। সন্ধান মিলল থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের। এরপর লোমহর্ষক ঘটনাগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে। এখনো দালালচক্রের দুরভিসন্ধি শেষ হয়নি। এই পাচারকারীচক্র এখনো অর্থ আদায়ের জন্য ফোন করছে। ১ জুন বাংলাদেশের একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ ‘চার দিন আগে টেকনাফের খালেদা বানুর কাছে ফোন আসে। ওপাশ থেকে জানানো হয়, তার ছেলে বেঁচে আছে। ৩০ হাজার টাকা দিলে ছেলেকে ফেরত পাবেন। কয়েক মাস আগেও এমন একটি ফোন পেয়ে টাকা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ছেলে ফেরেনি। এবার ফোন পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দশ গুণ বেশি আয়ের লোভ দেখিয়ে তার ছেলেকে যে ব্যক্তি মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন খালেদা। এদিকে থাইল্যান্ডের প্রশাসন অন্তত ৩২টি গণকবরের সন্ধান পেয়েছে। 
গত ১৯ মে বাংলাদেশে বহুল প্রচারিত একটি পত্রিকায় প্রকাশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘মানবপাচারের সঙ্গে বাংলাদেশ নয়, মিয়ানমারের মানুষ বেশি জড়িত।’ এ ধরনের নেতিবাচক বক্তব্য না দিয়ে আন্তরিকভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র নেই। হাজার হাজার বাঙালি কিভাবে বিদেশে পাড়ি জমাল? সেখানে তাদের হত্যা ও নির্যাতন করা হচ্ছে। গণতন্ত্র থাকলে এমন দুর্যোগ জনগণের জীবনে নেমে আসত না। গালিগালাজ ও হুমকি-ধমকির রাজনীতি চলছে। যখন দেশের হাজার হাজার দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে কান্নার রোল; যখন ঈশান কোণে কালো মেঘের গুমোট কাটেনি, মানবতা লাঞ্ছিত, তখন ছিটমহল সমস্যার সমাধানের বিষয় নিয়ে সংবর্ধনা চলছে। ছিটমহল এবং এর সমস্যাবলির সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার প্রদানে দীর্ঘ দিন পরে উদ্যোগ নিয়েছেন। সে জন্য আমরা জনগণ কৃতজ্ঞ। যখন দেশের হাজার হাজার পরিবারে শোকের মাতন থামেনি; যখন থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলে হাজার হাজার বাঙালির মাটিচাপা লাশের এখনো সন্ধান চলছে, এমনই একটি বেদনাবিধুর পরিবেশে সংবর্ধনা বা আনন্দ মিছিল কি অনভিপ্রেত নয়?
ড. মো: মোয়াজ্জেম হোসেন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads