বুধবার, ৩ জুন, ২০১৫

গণতন্ত্রের জীর্ণদশায় দখল-রাজনীতি প্রবল হচ্ছে


অনুরাগ-বিরাগের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এমন বাতাবরণে আইনের শাসন শিথিল হয়ে পড়ে, বিপরীতে চলতে থাকে সন্ত্রাস, দখল ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের দৌরাত্ম্য। ২ জুন বাংলাদেশ প্রতিদিনে দখলের রাজনীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়: দখল সংস্কৃতির এক নতুন যুগ চলছে দেশ জুড়ে। বিচারপতির বাড়ি, সরকারি সম্পত্তি, টেন্ডার থেকে শুরু করে পেশাজীবীদের ক্লাব কিংবা সংগঠনও দখলবাজির দৌরাত্ম্য থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সরকারি দলের নামে প্রভাবশালীরা সর্বত্রই গড়ে তুলেছে দখলবাজির সিন্ডিকেট। তারা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দাপটের সঙ্গে একের পর এক দখল করে নিচ্ছে সবকিছু। দখল হচ্ছে খাল-বিল, নদী-নালা, ফুটপাত, এমনকি ওভারব্রিজের ওপর পথচারীদের চলাচলের জায়গাটুকুও। দখলবাজির অব্যাহত দৌরাত্ম্যে এক চিলতে জায়গা ফাঁকা থাকারও উপায় নেই। দলের নাম ভাঙ্গিয়ে কল-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমি-জিরাত, বাড়ি-ঘর দখল করা হচ্ছে। এসব নিয়ে র‌্যাব-পুলিশ আর প্রশাসনের দফতরে দফতরে অভিযোগের পাহাড় জমে উঠেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ব্যানারে দাপিয়ে বেড়ানো দখলবাজদের সামনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেন অসহায় হয়ে পড়েছেন। র‌্যাবের কাছে অভিযোগের সংখ্যা বেশি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মামলা ও অন্যান্য কারণে র‌্যাব এ নিয়ে নাক গলাচ্ছে না। এদিকে পুলিশ দখলবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে উল্টো দখলবাজদের পক্ষেই ভূমিকা রাখছে। রাজধানী ঢাকার সর্বত্র ফুটপাত দখল করে সারা বছর বেশুমার বাণিজ্য চালানোর পাশাপাশি ইদানীং দখলবাজরা ব্যস্ততম রাস্তার একাংশ দখল করে নানা রকম স্থাপনা গড়ে তুলছে। ঢাকার গুলশান, বনানী ও উত্তরায় দখলবাজদের কৌশল ভিন্ন। সেখানে পাকিস্তানীদের অনেক বাড়িকে ‘বিহারীদের সম্পদ’ দেখিয়ে দফায় দফায় দখল পাল্টা দখল হয়। পুরান ঢাকায় একজনের জায়গা-জমি কিংবা বাড়িতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অন্যজন দখল করে নিচ্ছে। দখল হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, ভোট কেন্দ্র, টেন্ডার বাক্স, বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল, সরকারি খাস জমি, লেক, রেলের জমি। এমনকি পাহাড় পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে অনায়াসে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বিবেক ও গণতন্ত্রের প্রতীক প্রেস ক্লাব পর্যন্ত দখল করার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। প্রসঙ্গত এখানে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, গত এক দশকে দখল করা হয়েছে রাজধানীর অন্তত ১২টি মাঠ ও শিশু পার্ক। রাজধানীর শিশুদের কাছে খেলার মাঠ এখন দুর্লভ বিষয় হয়ে পড়েছে। ফলে খেলার মাঠের বদলে শিশুরা এখন বিনোদন খুঁজছে কম্পিউটার এবং মোবাইলে। এর মন্দ প্রভাব সম্পর্কে অনেক কথা বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। রাজধানীর ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাতই এখন অবৈধ দখলে। এসব দখল করা জায়গা ভাড়া দিয়ে অর্জিত টাকার অংশ পৌঁছে যাচ্ছে উপর মহলেও। দখলবাজদের দখল থেকে শিল্প-সংস্কৃতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানও রক্ষা পাচ্ছে না। একজনের নাট্যসংগঠন, আবৃত্তি পরিষদ অন্যজন দখল করে নিচ্ছেন। দখল-পাল্টা দখলের কবল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও রেহাই পাচ্ছে না।  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দখল-বেদখলের তৎপরতা প্রকট। প্রভাবশালী ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন দলের এমপি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাও বিশ্ববিদ্যালয় জবর দখলের মাধ্যমে ব্যাপক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। সাবেক এক রাষ্ট্রপতির পত্নী কর্তৃক পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ও দখল করে নিতে দখলবাজ সিন্ডিকেটের কোনোরকম সমস্যা হয়নি।
দখলবাজির এমন ব্যাপক চিত্র থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, দেশে আইন-শৃঙ্খলা ও সুশাসনের সংকট ক্রমেই বাড়ছে। এর বাইরে রয়েছে সামাজিক-সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। কোনো দেশের রাজনৈতিক-সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধের এমন অবক্ষয় ঘটলে; বড় বড় দালান, উড়ালসেতু ও বিদ্যুৎ বাতির ঝলকানি দিয়ে জাতির প্রকৃত উন্নতি ও জনগণের প্রকৃত মুক্তি নিশ্চিত করা যায় না। এ কারণেই বিবেকবান মানুষরা এখন অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এডভোকেট আহমেদ আলী বলেছেন, ‘চোখের সামনে দেশ ধ্বংস হচ্ছে, কেউ কিছু করতে পারছেন না, আবার অনেকে তা সহ্যও করতে পারছেন না, তাই বিবেকবান মানুষ অন্তর্জ্বালা নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। গত ৩১ মে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘বিবেকবান মানুষের জন্য বাংলাদেশ দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। সরকার ও বিরোধী দল দেশ ও মানুষের কল্যাণ নিয়ে চিন্তা করছে না। সবাই নিজেদের আখের গোছানো নিয়ে ব্যস্ত’। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ জীবনের এই পর্যায়ে এসে যে কথাগুলো বললেন, তা গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু দেশের সংকট নিয়ে, সম্ভাবনা নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করলে কার্যকর ব্যবস্থা বেরিয়ে আসতে পারে, সেই রাজনীতিবিদরা এখন মানসিক ও নৈতিকভাবে কোথায় অবস্থান করছেন? আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন তো আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা কিংবা ত্রুটি স্বীকার ও সংশোধনের চেতনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সবাই নিজেদের অবস্থানকে সঠিক আখ্যায়িত করে ব্লেম-গেমে মত্ত রয়েছেন। এমন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই হয়তো প্রবীণ রাজনীতিবিদ এডভোকেট আহমেদ আলী বলেছেন- বিবেকবান মানুষরা অন্তর্জ্বালা নিয়ে এখন কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।
আমরা তো একথা জানি যে, দেশ চালাচ্ছে সরকার। আর দেশ চালানোর ক্ষেত্রে সরকারকে সংবিধান মানতে হয়, ইশতেহার ও অঙ্গীকার পূরণে নিষ্ঠাবান থাকতে হয়, দুর্নীতি দূর করে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে সক্রিয় থাকতে হয়, সর্বোপরি নৈতিক মেরুদ- সোজা রেখে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেও সমুন্নত রাখতে হয়। বর্তমান সময়ে এসব ক্ষেত্রে সরকারের ভুল-ত্রুটি অনেক। দেশ ও জনগণের স্বার্থে সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া এবং সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করার ব্যাপারে বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তেমন ভূমিকা পালনে বিরোধী দল সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি। সৃজনশীল কর্মসূচি প্রণয়নেও বিরোধী দল উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনি। এমন সমালোচনার জবাবে বিরোধী দলের বক্তব্য হলো- সরকারের দমন-পীড়ন ও ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে আমরা গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছি না। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাকে গণতান্ত্রিক বলে অভিহিত করা যায় না। এ কারণেই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না।
শুধু সরকারের নয়, বিরোধী দলের ভূমিকাকেও এখন অনেকে সমালোচনা করছেন, সরকার পক্ষের সমালোচনাতো বেশ তীর্যক ও নির্মম। চাতুর্যের রাজনীতি আসলে কখনও সত্যনিষ্ঠ হয় না, এই রাজনীতিতে আত্মসমালোচনাও হয় না। ফলে সংশোধনের বদলে ব্লেম-গেমের রাজনীতিই প্রাধান্য পায়। এমন রাজনীতিতে নিজেদের প্রতাপকে অব্যাহত রেখে ভিন্ন পক্ষকে নির্মূল করাই যেন লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। অথচ এমন লক্ষ্য গণতান্ত্রিক চেতনা কিংবা সুশাসনের সাথে যায় না। দমন-অবদমনের এই রাজনীতিতে অনুরাগ-বিরাগ ও দলবাজি দিন দিনই প্রকট রূপ ধারণ করছে। ফলে বিচারপতির জায়গা দখল করে সরকারি দলের লোকজন দলীয় অফিস করতেও এখন অকুণ্ঠচিত্ত। এ ব্যাপারে ৩১ মে তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি ও একজন বিচারপতির পৈতৃক জমি জবর-দখল করে নির্মাণাধীন খুলনার দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভবনটি উচ্ছেদ করা যায়নি। বৃহস্পতিবার থেকে কয়েক দফা চেষ্টা করেও দলীয় নেতাকর্মীদের প্রবল বাধার মুখে উচ্ছেদ কার্যক্রম থেকে পুলিশ প্রশাসনকে পিছু হটতে হয়েছে। এই ভবনটি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উচ্ছেদের নির্দেশ রয়েছে উচ্চ আদালতের। ২৮ মে উচ্চ আদালতের ওই আদেশটি খুলনা জেলা প্রশাসনের হাতে আসে। ৩০ মে শনিবার উচ্চ আদালতের দেয়া ৭২ ঘণ্টা সময়সীমা পার হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় ২ শতাংশ ও একজন বিচারপতির পৈতৃক ১ শতাংশ জমি জবর দখল করে আলোচিত বহুতল বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়টি নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু দুই পক্ষের কারও কাছ থেকে জমি ব্যবহারের বন্দোবস্ত বা অনুমতি নেয়া হয়নি। তাই প্রশ্ন জাগে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এমন বেআইনি কাজ করার সাহস পায় কী করে? সরকারি দলের লোকজন কি আইনের ঊর্ধ্বে? এমন উদাহরণ শুধু দেশের জন্য নয়, সরকারি দলের জন্যও এক বড় অশনি সংকেত। দেশে এখন দখল বেদখলের যে রাজনীতি চলছে তা শুধু আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, এতে সরকার ও সরকারি দলের ইমেজও ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সমাজপতি ও সমাজের প্রাগ্রসর মানুষরাও তাদের দায় এড়াতে পারেন না। এখনও সময় আছে, যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা যদি সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে নৈতিক মেরুদ-কে সোজা রেখে কর্তব্য পালনে এগিয়ে আসেন, তাহলে মুক্তির পথ বেরিয়ে আসতে পারে। কারণ যে জাতি নিজেকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, স্বয়ং স্রষ্টাও সে জাতির প্রতি তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads