মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০১৫

প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেলো সার্বভৌমত্বই


ভারতের চরম হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি থেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বিশ্বনেতৃত্ব গ্রহণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপকে তার বলয়ভুক্ত করার জন্য মরিয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। নেপাল ও মালদ্বীপে তার সামান্য ভুল হলেও সে ভুল তিনি করেননি বাংলাদেশ ও ভুটানের ক্ষেত্রে। নেপালের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে সাহায্য করার নামে হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়ে হাজির হয়েছিল ভারতীয় সামরিক বাহিনী। কিন্তু সেখানে গিয়ে ভারতীয় হেলিকপ্টার বিতর্কিত চীন-সংলগ্ন অরুণাচল প্রদেশে চীনা সীমান্ত অতিক্রম করে ঐ এলাকার ছবি তুলছিল। চীন অরুণাচলকে ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই তাদের এলাকা বলে দাবি করে আসছে। এমনকি নরেন্দ্র মোদির চীন সফরের সময় ঐ এলাকার যে মানচিত্র চীনে প্রকাশ করা হয়, তাতেও এই অঞ্চলকে চীনের অংশ হিসেবে দেখানো হয় আর মোদিকে তা হজমও করতে হয়।
তথাকথিত ত্রাণ কাজে নিয়োজিত ভারতীয় হেলিকপ্টার চীন সীমান্ত অতিক্রম করলে পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নেয়। কড়া প্রতিবাদ আসে চীনের তরফ থেকে। নেপাল সরকার খুব দ্রুতই ত্রাণ কাজে নিয়োজিত ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নেপাল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ভারতও ত্রাণ কাজ থেকে সামরিক বাহিনী গুটিয়ে নেয়। ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে দাহ করা হয় নরেন্দ্র মোদির কুশপুতুল। মালদ্বীপের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। মালদ্বীপের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভারতপন্থী বলে নিন্দিত মোহাম্মদ নাশিদ শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। কিন্তু তাকে জেতাতে কসরত কম করেনি ভারত। এখন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে মোহাম্মদ নাশিদের বিচার চলছে। সেই অভিমানে নরেন্দ্র মোদি তার মালদ্বীপ সফর বাতিল করে দিয়েছেন।
ভুটানের পরিস্থিতি বেশ ভালো। কারণ ভুটান পুরোপুরি একটি ভারতনির্ভর দেশ। এর রাজনীতি-কূটনীতি-অর্থনীতি সবই ভারত নিয়ন্ত্রিত। তারা একটি দিয়াশলাইয়ের কারখানা দেয়ারও অধিকার রাখে না। ভারত তা সরবরাহ করে। নিজেদের নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ। এসব লেখাপড়ার জন্য তাদের যেতে হয় ভারতে। এখন পর্যটন শিল্প থেকে যেটুকু আয় হচ্ছে তারও সিংহভাগ চলে যাচ্ছে ভারতে, অধিকতর আমদানির কারণে। সেদিক থেকে মোদি সরকার ভালো আছেন শ্রীলঙ্কা নিয়ে। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভারতপন্থী মাইথ্রিপালা সিরিসেনা নির্বাচিত হয়েছেন। তার এ বিজয় ছিল অকল্পনীয়। হেরে গেছেন চীনপন্থী বলে পরিচিত মাহিন্দ্র রাজা পাকশে।
এই প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই মোদি ঢাকা সফরে এসেছিলেন। ঢাকায় তিনি যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, তার সবই হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ছাড়া অন্যান্য দেশের ওপর ভারতের সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক খবরদারি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। একই সঙ্গে আরও উদ্বেগের বিষয় হলো যে, মোদি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যে অবাধে প্রবেশের সুযোগ আদায় করে নিয়ে গেছেন। আর তার সবই করেছেন বাধা-বিঘœহীনভাবে। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশকে দিয়ে যাননি কিছুই। বরং তিনি নানা বাকোয়াজিতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন।
বার্লিন ওয়াল ধ্বংস, পাশাপাশির বদলে এখন থেকে একসঙ্গে চলা এসব বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ না করেই, ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির পরিণতি কী হতে পারে সে চিন্তা না করেই বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা মোদি চলে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মন্ত্রিসভায় কানেকটিভিটির নামে ভারতকে করিডোর দেয়ার ব্যবস্থা অনুমোদন করে দেয়। ঐ চুক্তিতে অবশ্য বলা হয় যে, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ব্যক্তিগত, যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যান চলাচল করতে পারবে। আর এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর হবে, এতেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে সরকার ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা নৌবন্দর ব্যবহার করতে দিল এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা ও কলকাতা-ঢাকা-ত্রিপুরা রুটে বাস চলাচলের অনুমতি দিল এবং বাস চলাচল শুরু হয়ে গেছে।
কিন্তু মীমাংসা হয়নি কোনো প্রশ্নেরই। যদি বিষয়টা সমানে সমানে হতো তাহলে বাংলাদেশ থেকে একদল পর্যটক বাসে করে যেতে পারতো নেপাল কিংবা ভুটানে। সে ব্যবস্থা তো হয়ইনি, বরং এখন বলা হচ্ছে, ভুটানে যাবার রাস্তাই তৈরি হয়নি। সে কথার বিশ্বাসযোগ্যতাও অতি সামান্য। কারণ, ভারতের সঙ্গে ভুটানের নিয়মিত সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। আর ভুটানে প্রধান রফতানিকারী দেশ ভারতই। তাহলে আমরা কেন যেতে পারলাম না ভুটানে বা নেপালে।
এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের যানবাহন ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল-ভুটানে যেতে পারবে কিনা, তার কোনো ফয়সালা হয়নি। অথচ, ভারতের যানবাহন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নির্বিঘ্নে যাচ্ছে আগরতলা বা ত্রিপুরায়। তাছাড়া এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নেপাল বা ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তিই হয়নি। সেদিক থেকে চার দেশের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ চুক্তি একটি ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই না। এর এতসব চুক্তির মধ্যে কোথায়ও নেই যে বাংলাদেশের কোনো যানবাহন পণ্য নিয়ে ভারত বা নেপাল-ভুটানে যেতে পারবে কিনা। তাহলে এর সরল অর্থ দাঁড়ালো, ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তার সকল পণ্য ও সেবা নির্বিঘ্নে নিয়ে যাবে তার সাত রাজ্যে। আগে যা নিতে দু’হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো, এখন বিনা শুল্কে বিনা মাশুলে মাত্র ৫০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েই তা নিয়ে যেতে পারবে তার সাত রাজ্যে। এতে বাংলাদেশের স্বার্থ যা দাঁড়ালো, তাহলো যেটুকু পণ্য বাংলাদেশ ঐ সাত রাজ্যে রফতানি করতো, সে পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। তথাকথিত কানেকটিভিটির লাভের গুড় এভাবেই ভারতই খেয়ে ফেলার আয়োজন সম্পন্ন করে নিলো। অথচ আমাদের ব্যবসায়ীরা অনেকদিনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সাত রাজ্যে কয়েক কোটি ডলারের বাজার তৈরি করেছিল।
এদিকে ভারতকে এই সুবিধা দেয়ার ফলে আরও যে বিপদ আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে তাহলো, এই সুযোগে ভারতীয় পণ্যে সয়লাব হয়ে যাবে বাংলাদেশের বাজার। বিপন্ন হয়ে পড়বে আমাদের দেশের শিল্প-কারখানাগুলো। ভেঙে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। ঐতিহাসিকভাবেই দেখা যায় যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ছোট অর্থনীতির দেশগুলো বাণিজ্য ভারসাম্যের দিক থেকে এগিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারত বাংলাদেশে বছরে রফতানি করে ছয়শ’ কোটি ডলারের পণ্য। আর ভারতে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির পরিমাণ মাত্র ছয় কোটি ডলার। এটাও অবিরাম খাবিখায় ভারতের নানা ধরনের অশুল্ক বাধার জন্য।
এছাড়া ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তার উত্তর-পুর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে সেখানকার স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য পাঠাচ্ছে সমরাস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম। সেই সঙ্গে যাচ্ছে ও যাবে পর্যটকের বা যাত্রীর ছদ্মবেশে ভারতীয় সৈন্য। তাতে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের টার্গেটে পরিণত হবে বাংলাদেশ। গেরিলা যুদ্ধের নিয়মানুসারে তারা এসব সামরিক সাজসরঞ্জাম ও সৈন্য ঠেকাতে প্রবেশ করবে বাংলাদেশের ভেতরে। তাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হবে বাংলাদেশের ভেতরেই। আর এতে অকারণেই বাংলাদেশ ভারতের এক সম্প্রসারিত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে।
তারপরও সম্ভবত মোদি সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, তিস্তার পানি বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার। আর করিডোর-ট্রানজিট আমাদের সদিচ্ছা। বাংলাদেশের মানুষকে অধিকারবঞ্চিত করে রেখে ফাঁকা বুলি দিয়ে তাদের বেশিদিন ধোঁকা দিয়ে রাখা যাবে না। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এদেশের মানুষ একসময় প্রতিরোধ গড়ে তুলবেই। ভারত সরকার যত তাড়াতাড়ি সেটা উপলব্ধি করে, ততই মঙ্গল।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads