বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার নেপথ্যে কারা?

কানাডার কুইবেক সিটির একটি মসজিদে বন্দুকধারীদের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ছয়জন। আহত হয়েছেন আরও আটজন। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় আটক করা হয়েছে দু’জনকে। একে একটি সন্ত্রাসী হামলা বলে উল্লেখ করেছে পুলিশ। মসজিদে হামলা ও হতাহত হওয়ার ঘটনাকে মুসলমানদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে অভিহিত করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের ওপর এই সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানাই।’ উল্লেখ্য যে, ২৯ জানুয়ারি (স্থানীয় সময় রোববার রাতে) নামাযের সময় কুইবেক সিটি ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে বন্দুকধারীরা নির্বিচারে গুলী ছোঁড়ে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, মসজিদের ভেতর থাকা অন্তত ৪০ জন মানুষের ওপর তিনজন বন্দুকধারী গুলী ছোঁড়ে। এই ঘটনার পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বলেছেন, কানাডার মুসলমানরা দেশের জাতীয় কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কানাডার সমাজ, শহর ও দেশে এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের কোনো ঠাঁই নেই। উল্লেখ্য যে, আমেরিকার নয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন তার দেশে মুসলিমপ্রধান সাতটি দেশের শরণার্থী প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী বিপন্ন শরণার্থীদের নিজ দেশে স্বাগত জানান। এমন পরিস্থিতিতে মসজিদে ওই সন্ত্রাসী হামলা সৃষ্টি করেছে নানা প্রশ্ন। এর আগে মসজিদে আগুন-হামলার ঘটনা ঘটেছে আমেরিকায়।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে আগুনে পুড়ে গেছে একটি মসজিদ। টেক্সাসের হিউস্টন শহরের ১১৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ছোট শহর ভিক্টোরিয়ার ওই মসজিদটির পুরোটাই আগুনে পুড়ে গেছে। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। মসজিদে আগুনের এ ঘটনা ‘বিদ্বেষপ্রসূত হামলা’ হতে পারে বলে জানিয়েছে সংবাদ মাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত ২টার দিকে ভিক্টোরিয়া ইসলামিক সেন্টার নামের ওই মসজিদ থেকে আগুনের শিখা বেরুতে দেখা যায়। পরে স্থানীয়রা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে মসজিদটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডের উৎস বা কারণ সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। ৭ বছর আগে এই মসজিদটি একবার সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছিল। এ ছাড়া ৩ মাস আগে মসজিদটিতে চুরি হয়েছিল বলে জানিয়েছে সংবাদ মাধ্যম। ওই মসজিদটি এলাকার একমাত্র মসজিদ। এক সাথে ১০০ জন নামায আদায় করতে পারতেন ওই মসজিদে। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রে ৭টি মুসলিম দেশের নাগরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে নির্বাহী আদেশে ট্রাম্পের স্বাক্ষরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মসজিদে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটলো। মসজিদে সন্ত্রাসী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি অমানবিক ও নিন্দনীয়। কোন ধর্মের মানুষই এমন ঘটনাকে সমর্থন করতে পারেন না। দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পও নিশ্চয়ই মসজিদে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে সমর্থন করবেন না। ডেমোক্র্যাটরাও ঐ ঘটনাকে সমর্থন করবেন না। তাহলে ঘটনাটি কারা ঘটালো? কাদের ইন্ধনে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন ঘটনা ঘটলো? এখানে কোন ভুল বার্তা কাজ করেনি তো?
আমরা জানি, ট্রাম্পের অভিবাসন বিরোধী বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। কারো কারো মধ্যে উগ্রতার বীজও বপিত হতে পারে। অভিবাসীদের রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত আমেরিকায় ট্রাম্পের অভিবাসন বিরোধী নীতি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিকে লজ্জাজনক ও নিষ্ঠুর বলে অভিহিত করেছেন। ৭টি দেশের অভিবাসীদের সাময়িক নিষিদ্ধ করে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের প্রতিক্রিয়ায় এক বিবৃতিতে তিনি ওই ঘটনাকে স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতার মূল্যবোধহীনতা বলে উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের এমন নীতিতে অনেক বৃটিশ নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন লন্ডনের প্রথম মুসলিম মেয়র। পাশাপাশি এই নীতির বিষয়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে উদ্বেগ প্রকাশ করায় সাদিক খান তার সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। লন্ডনের মেয়র আরো বলেন, ‘উদ্বাস্তুদের আশ্রয় ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে গর্ব করার মতো ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলেই এই বিশ্ব-সংকটকে উপেক্ষা করতে পারেন না। সব দেশকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে।’
লন্ডনের মেয়রের বক্তব্য ট্রাম্প কতটা উপলব্ধি করবেন তা আমরা জানি না। তবে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ জারির পরে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে হয়রানির শিকার হচ্ছেন মুসলমানরা। বৈধ কাগজপত্র থাকার পরেও বিভিন্ন বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রগামী মুসলিম যাত্রীদের আটকে দেয়া হচ্ছে। গত শনিবার নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্রানজিট এলাকা থেকে ১১ জন উদ্বাস্তুকে আটক করা হয়েছে। মিসরের রাজধানী কায়রোর বিমানবন্দর থেকে ভিসা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রগামী ইয়েমেনের একজন এবং ইরাকের ৫ জন নাগরিককে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এদিকে নিজেদের ৭ জন মুসলিম যাত্রীকে বিমানে করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায় নেদারল্যান্ডভিত্তিক বিমান সংস্থা কেএলএম। এসব ঘটনায় উপলব্ধি করা যায় ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ বিশ্বে কেমন এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আমরা মনে করি, সময় থাকতেই বিশ্বনেতাদের এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসা উচিত, নয়তো পৃথিবীতে অশান্তির মাত্রা আরো বেড়ে যেতে পারে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাত্র দুই সপ্তাহ অতিবাহিত করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাকে নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে যে শঙ্কা ছিল তিনি বেশ দ্রুতই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা বাস্তবে পরিণত করে চলেছেন। বলা যায়, একের পর এক তিনি তুলকালাম কাণ্ড করে চলেছেন। ট্রাম্পের সমর্থকরা বলছেন, তিনি একজন বিপ্লবী। তবে অন্যরা এভাবে শঙ্কিত যে, তাঁর একনায়কসুলভ আচরণে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিই বিপন্ন হবে না, বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়তে পারে। উল্লেখ্য যে, ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একের পর এক নির্বাহী আদেশ জারি করে চলেছেন। গত শুক্রবার হলোকস্ট স্মরণ দিবসে অভিবাসন প্রশ্নে দু’টি নির্বাহী আদেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। প্রথমটিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত সিরিয়া থেকে উদ্বাস্তু গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আর অন্যসব দেশের উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা চালু থাকবে পরবর্তী ১২০ দিনের জন্য। দ্বিতীয় নির্দেশে ৭টি আরব দেশ থেকে মুসলমানদের ভিসা দেয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। দেশগুলো হলো ইরাক, ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান, লিবিয়া ও  সোমালিয়া। তবে যেসব দেশের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই কড়াকড়ি আরোপ হবে না। এই ক্ষেত্রে সৌদি আরব, মিসর ও জর্দানের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এর আগেই এক নির্দেশে অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারের লক্ষ্যে অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব শহর অভিবাসীদের গ্রেফতারে সহযোগিতা করবে না তাদের বাধ্য করতে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করবে ট্রাম্প প্রশাসন। এদিকে নিউইয়র্ক, লসঅ্যাঞ্জেলেসসহ অনেক শহরের মেয়ররা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের নির্দেশ সত্ত্বেও তারা এ ব্যাপারে ফেডারেল সরকারের সঙ্গে কোন সহযোগিতা করবেন না। অবৈধ অভিবাসী ঘেরাও করার লক্ষ্যে ট্রাম্প যদি আসলেই ফেডারেল বাহিনী পাঠান তাহলে ফেডারেল সরকারের সঙ্গে অঙ্গরাজ্যগুলোর বড় ধরনের বিরোধের সূত্রপাত হতে পারে।
শরণার্থী কর্মসূচি স্থগিত ও মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করতে গিয়ে আইনী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্য কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশন্স (সিএআইআর) নামের এক বিখ্যাত আইনী সহায়তা প্রতিষ্ঠান দাবি করেছেন, নয়া প্রেসিডেন্টের আদেশ সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আদেশটির বিরুদ্ধে একটি ফেডারেল মামলা দায়েরের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। তাদের অভিযোগ, ট্রাম্পের এ আদেশের মূল উদ্দেশ্য মুসলিম প্রধান দেশগুলোর ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। এদিকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতিমান মানুষরা ট্রাম্পের আদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
ইরাক যুদ্ধের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলা থেকে নিজের ইউনিটকে বাঁচাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন মার্কিন সেনা হুমায়ুন খান। তার বাবা খিজির খান ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের সমালোচনা করে বলেন, ‘মুসলিম ও অভিবাসীদের আক্রমণকে লক্ষ্য করে ট্রাম্প সাংবিধানিক নীতি এবং আমেরিকার মৌলিক মূল্যবোধ ক্ষুণœ করার যে দৌড়ে নেমেছেন তা খুবই উদ্বেগজনক। মুসলমানদের জন্য বৈষম্যমূলক নীতি করে ট্রাম্প যে পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন এবং তিনি ও তার প্রশাসন যে পদক্ষেপগুলো নিতে পারেন সেগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রত্যেক আমেরিকানের জন্য অপরিহার্য। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গও এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাকারবার্গ জানান, “তার প্রপিতামহরা জার্মানী, অস্ট্রিয়া ও পোল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। তার স্ত্রীর বাবা-মা চীন ও ভিয়েতনাম থেকে অভিবাসী হয়ে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্র আসলে অভিবাসীদের দেশ এবং আমাদের তা নিয়ে গর্বিত হওয়া উচিত। আমাদের উচিত শরণার্থী এবং যাদের সহায়তা দরকার তাদের জন্য আমাদের দুয়ার খোলা রাখা। সেটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য। কয়েক দশক আগে যদি আমরা শরণার্থীদের তাড়িয়ে দিতাম তবে প্রিসসিলার (জাকারবার্গের স্ত্রী) পরিবার আর এখানে থাকতো না।” জাকারবার্গ আসলে আমেরিকার ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। আজ হঠাৎ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন ইতিহাস ও ঐতিহ্য অস্বীকার করে এ কোন্্ অভিযাত্রায় নেমেছেন? তার এই অভিযাত্রা দেশে-বিদেশে কোন আশাবাদ সৃষ্টি করতে পারেনি, বরং জন্ম দিয়েছে এক নতুন শঙ্কার। যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল ভাষ্যকার ডেভিড ব্রুকস বলেছেন, “আসলে ট্রাম্প একজন আত্মম্ভরি মানুষ, তার ব্যবহার বখে যাওয়া পাঁচ বছরের বালকের মতো।” ডেভিস ব্রুকস-এর এমন মন্তব্যের পর ট্রাম্পের ব্যাপারে মানুষ আশাবাদী হবে কেমন করে? তবে আমরা আশা করবো, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞজনদের সমালোচনা ও পরামর্শকে গুরুত্ব দেবেন এবং যৌক্তিক পথে ফিরে এসে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads