অনেকগুলো টপিক জমা হয়ে আছে। কোনটা লিখব? এসব ভাবতে ভাবতে সামনে এসে গেল নতুন নির্বাচন কমিশন। এই কমিশন গঠনের ঘোষণা হতে কি না হতেই শুরু হয়েছে বিতর্ক, কমিশন নিয়ে বিতর্ক, চীফ ইলেকশন কমিশনার নূরুল হুদাকে নিয়ে বিতর্ক। মঙ্গলবার থেকেই বিতর্কটি চলছিল। বুধবার সেটি প্রকাশ্যে চলে আসে। বুধবার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০ দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ২০ দলের মতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রধানমন্ত্রীর মতামতেরই প্রতিফলন ঘটেছে। বিতর্কিত একজন সাবেক কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত কোনো প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে না। তাই কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকেও বলা যায় যে, অনুসন্ধান কমিটি যে ১০ জনের নাম বাছাই করবে তাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। তাদের জীবনবৃত্তান্ত, অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সেটা না করে অবিশ্বাস্য এবং রূদ্ধশ্বাস দ্রুততার সঙ্গে কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই তাড়াহুড়ো, এই লুকোচুরি একরাশ সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। এখন আর এটি বুঝতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না যে, এসব নাম আগেই ঠিক করা ছিল। বাছাই কমিটি গঠন, বিভিন্ন দলের সাথে বৈঠক, নাগরিক সমাজের ১৬ জনের সাথে বৈঠক, ১০ জনের নাম বাছাইÑ সবই ছিল সাজানো নাটক। কে চীফ ইলেকশন কমিশনার হবেন, কারা কমিশন সদস্য হবেন, সেগুলো সবই ছিল সরকারের মনের মধ্যে। তাই বাছাই কমিটির সাথে সন্ধ্যায় বৈঠকের সাথে সাথেই আস্তিনের ভেতর থেকে ৫টি নাম বের করা হয় এবং সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়।
নূরুল হুদা যখন যুগ্ম সচিব ছিলেন তখনই তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় বিএনপি সরকার। এরপর হাইকোর্ট বা সুপ্রীম কোর্ট নয়, আওয়ামী সরকার গঠিত প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তাকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল করে। তাকে যুগ্মসচিব থেকে সচিব পদে পুনর্বহাল করা হয়। মাঝখানে অতিরিক্ত সচিব পদটি ডিঙিয়ে যাওয়া হয়। আরও মজার ব্যাপার হলো, অতিরিক্ত সচিব বা সচিব পদে তিনি একদিনও কাজ করেননি। সচিব পদে পুনর্বহাল করে সাথে সাথেই তাকে অবসর দেয়া হয়। সুতরাং চাকরি জীবনে তার অভিজ্ঞতা ঐ যুগ্ম সচিব পর্যন্তই। এসব ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও সব গুরুতর অভিযোগ আছে। তিনি যখন কুমিল্লার ডিসি ছিলেন তখন তিনি নাকি তার অফিস থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছবি নামিয়ে ফেলেন। তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং নূরুল হুদাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, নূরুল হুদা সব সময় বিএনপি তথা ২০ দল বিরোধী লোক এবং আওয়ামী লীগের খাস লোক। সুতরাং নূরুল হুদা কমিশন যে আরেকটি রকিব কমিশন হবে তার আলামত এখনই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে।
এখানে আরো কয়েকটি বিষয় সন্দেহকে ঘনীভূত করে। বাছাই কমিটির সাথে প্রেসিডেন্টের মিটিং এবং কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি- মাঝখানে সময় ছিল মাত্র দু’ঘণ্টা। এই দুই ঘণ্টায় বাছাই কমিটির ১০ জন সদস্যের জীবনবৃত্তান্ত পড়া এবং তাদের খোঁজ-খবর নেয়া ও মূল্যায়ন করতেই তো ২৪ ঘণ্টা লেগে যাওয়ার কথা। সেখানে মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে এসব যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করার অর্থই হলো, সব কিছুই আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। নাহলে কেন এই তাড়াহুড়ো? আরো কথা আছে। নূরুল হুদা, রফিকুল ইসলাম এবং ব্রিগেডিয়ার শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরীর নাম কে বা কারা প্রস্তাব করেছিলেন? কোত্থেকে এলো এই তিনটি নাম? তরীকত ফেডারেশন নামক একটি স্বল্প পরিচিত দল নাকি এসব নাম দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র মত দল, যারা বছরের পর বছর সরকার চালিয়েছে, তাদের হাত দিয়ে এসব নাম এলো না, আর এলো তরীকত ফেডারেশন নামক একটি দলের মাধ্যমে, যাদের কোনোদিন একটি ইউনিয়ন পরিষদ চালানোরও অভিজ্ঞতা নাই, তাদের হাত দিয়ে এলো এই তিনটি নাম এবং সেসব নাম প্রেসিডেন্ট গ্রহণও করলেন, সে কথাই কি আজ বিশ্বাস করতে হবে? নাকি নিজেরা না দিয়ে অন্যের হাত দিয়ে এসব নাম টেবিলে আনা হয়েছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে?
॥ দুই ॥
কথা ছিল, সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি তাদের বাছাই করা ১০ জনের নাম পূর্বাহ্নে জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন তাহলে বোঝা যাবে, এরা কারা, এদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা এবং এদের সততা ও নৈতিকতা অতীতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল কিনা? সেটি করা হলে সমগ্র বিষয়টি স্বচ্ছ থাকত। এরপর প্রেসিডেন্ট যখন ঐ ১০ জনের ভেতর থেকে ৫ জনের নাম চূড়ান্ত করতেন তখন আর কারো কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকত না। কিন্তু এবার সেটি করা হল না। বরং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন যে, চাঁদ উঠলেই সকলে দেখতে পাবেন। তাই নাম প্রকাশের কোনো দরকার নাই। তার কথাই বর্ণে বর্ণে মেনে নেয়া হলো। অন্য কমিশনারদের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কবিতা খানম, ব্রি: জে: শাহাদৎ হোসেন এবং রফিকুল ইসলাম কঠিন আওয়ামী লীগার। মাহবুব তালুকদারের নাম যদিও নাকি বিএনপি দিয়েছে, তবুও বিএনপি কোন বিবেচনায় এই নামটি দিয়েছে সেটি মোটেই আমার বোধগম্য নয়। তিনি বাংলার ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের একজন এ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। চাকরি জীবনেও আওয়ামীপন্থী আমলা ছিলেন। তিনি অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে যান। তাকে সচিব না করায় তার ক্ষোভ ছিল। এজন্য অবসর পরবর্তী জীবনে তিনি আওয়ামী সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। এই ক্ষুব্ধতা তার আওয়ামীপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটায়নি।
এখন প্রশ্ন হলো অন্যত্র। বিএনপি আওয়ামী সরকারের নিকট থেকে একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আশা করেছিল কিভাবে? একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের জন্য তারা প্রেসিডেন্টের ওপর অনেকখানি ভরসা করেছিল। কেন এমন ভরসা তারা করে তার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা ভুলে যায় কিভাবে যে, জনাব আব্দুল হামিদ কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন কয়েকদশক ধরে। তিনি শেখ মুজিবের একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মী ছিলেন। কিশোরগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি ছয়বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনাই তাকে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার বানান। শেখ হাসিনাই তাকে জাতীয় সংসদের স্পিকারও বানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তাকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বানান। এমন একটি পটভূমি এবং পরিস্থিতিতে বিএনপি কেমন করে আশা করে যে, প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ এমন একটি নির্বাচন কমিশন বানাবেন যেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দসই হবে না? বিএনপি তথা বিরোধী দলকে ভুললে চলবে না যে, ৭০ বছরের বেশি বয়স- এই ধুয়া তুলে সাবেক সচিব জনাব আসাফউদ্দৌলাকে বাতিল করা হয়েছে। তাহলে ৭৬ বছর বয়সী মাহবুব তালুকদারকে কমিশনার করা হলো কোন যুক্তিতে? একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের জন্য বিএনপি অনেক এনার্জি খরচ করেছে। দুই মাস ধরে তাদের প-িতরা পড়াশোনা ও গবেষণা করে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের একটি রূপরেখা দাঁড় করিয়েছে এবং জনগণের মাঝে সেটি প্রকাশও করেছে। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিগত ৬ দশক ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন তারা তখনই ভেবেছিলেন যে, বিএনপি এসব রিসার্চ ও ব্রেন স্টর্মিং সবই অরণ্যেরোদন। আওয়ামী লীগ কোন্ ধরনের ইলেকশন কমিশনার বানাবে সেটি তারা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিল। অনেকটা সেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত। শিশু তার মাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘মা আমি কোথায় ছিলেম? কিভাবে এলেম আমি?’ মা বলছেন, ‘ইচ্ছে হয়ে ছিলি তুই মনের মাঝারে।’ তেমনি নূরুল হুদা কমিশনও ইচ্ছে হয়েছিল সরকারের মনের মাঝারে। বাছাই কমিটির মাধ্যমে সেটির প্রসব হয়েছে মাত্র। সেই কমিশন একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, তেমন আশা যদি কেউ এখনও পোষণ করে থাকেন তাহলে বলতে হবে, ‘ধন্য আশা কুহকীনি।’
॥ তিন ॥
আবার একটি রকিব কমিশন গঠিত হলো। বিএনপি এই কমিশন প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু তাতে কি লাভ? একটি প্রেস কনফারেন্স করে প্রত্যাখ্যান করলেই কি ঐ কমিশন বাতিল হয়ে যাবে? সকলেই জানেন, বাতিল হবে না। হুদা কমিশন বাতিল করতে হলে প্রয়োজন হবে প্রবল গণআন্দোলনের। বিএনপি আমলে বিচারপতি এমএ সাত্তারকে চীফ ইলেকশন কমিশনার করে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। সেই কমিশন কাজ করতে পারেনি। প্রবল গণআন্দোলনের ফলে ঐ কমিশন বাতিল হয়েছিল। এসেছিল এটিএম শামসুল হুদা কমিশন। সেই ধরনের গণআন্দোলন কি বিএনপি করতে পারবে? গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে বিএনপি’র সামনে তথা সমস্ত বিরোধী দলের সামনে আর কোনো অপশন কি খোলা আছে?
॥ চার ॥
ইতোমধ্যেই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এবং পত্র-পত্রিকায় বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে বিশিষ্টজনরা বলছেন যে, আগামী নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে হলে সেটি অবশ্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। সেই সরকারকে আপনি যে নামেই ডাকুন না কেন, সেটি কেয়ারটেকার সরকার হতে পারে বা অন্য যে কোনো নামের সরকার হতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই দলীয় সরকার হতে পারবে না। তাদের মতে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারই বিজয়ী হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে, বিশেষ করে আওয়ামী সরকারের অধীনে গঠিত সমস্ত নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। হুদা কমিশন নামে যে আওয়ামী কমিশন গঠিত হলো তার ফলে আগামী নির্বাচনে ঐ কমিশন নয়, সরকারের ভূমিকাই মুখ্য হবে। রকিব কমিশন সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থাকেই নষ্ট করে গেছে। নষ্ট করার এই প্রক্রিয়ায় সরকারের মদত ছিল এবারও তেমন একটি কমিশনই গঠিত হলো এবং এই সরকারই সেটি গঠন করলো। নতুন সিইসি হুদা বলেছেন, তিনি কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। প্রশ্ন হলো, এই চাপ তাকে কে দেবে? নিশ্চয়ই বিরোধী দল নয়। কারণ চাপ দেয়ার মতো ক্ষমতা কি তাদের আছে? তারা তো বড়জোর কোনো ইস্যু বা দাবি নিয়ে কমিশনের কাছে যাবেন এবং একটি দাবিনামা বা স্মারকলিপি পেশ করবেন। এর বেশি কিছু তারা কি করবেন? চাপ এলে সিটি আসবে সরকারী দল থেকে। অতীতেও, বিশেষ করে আওয়ামী আমলে চাপ এসেছে সরকারী দল থেকে। এসব চাপের কাছে সম্পূর্ণ নতি স্বীকার করেছিল রকিব কমিশন। নতি স্বীকার করে তারা অনেক অন্যায় কাজ করেছে। ফলে নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ে ইউপি নির্বাচন-প্রতিটি স্তরে ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান, সহিংসতা, হত্যা, খুন জখম, এসব অপকর্মের ফলে শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনই নয়, সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থার ওপরেই জনগণের অনাস্থা জন্মেছে।
হুদা কমিশনের প্রধান কাজ হবে, এই বিশাল অনাস্থা দূর করা এবং জনগণের আস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনা। প্রো-গভর্নমেন্ট ইলেকশন কমিশন দিয়ে সেই আস্থা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। এটি ফিরিয়ে আনতে হবে সরকারকে। এই সরকার সেই কাজটি করবে বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সেটি করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে বিরোধী দলকে। জনগণকে সাথে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, হুদা কমিশন গঠনের পর সেই আন্দোলনের আর কোন বিকল্প পথ সরকার খোলা রাখলো না।
নূরুল হুদা যখন যুগ্ম সচিব ছিলেন তখনই তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় বিএনপি সরকার। এরপর হাইকোর্ট বা সুপ্রীম কোর্ট নয়, আওয়ামী সরকার গঠিত প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তাকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল করে। তাকে যুগ্মসচিব থেকে সচিব পদে পুনর্বহাল করা হয়। মাঝখানে অতিরিক্ত সচিব পদটি ডিঙিয়ে যাওয়া হয়। আরও মজার ব্যাপার হলো, অতিরিক্ত সচিব বা সচিব পদে তিনি একদিনও কাজ করেননি। সচিব পদে পুনর্বহাল করে সাথে সাথেই তাকে অবসর দেয়া হয়। সুতরাং চাকরি জীবনে তার অভিজ্ঞতা ঐ যুগ্ম সচিব পর্যন্তই। এসব ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও সব গুরুতর অভিযোগ আছে। তিনি যখন কুমিল্লার ডিসি ছিলেন তখন তিনি নাকি তার অফিস থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছবি নামিয়ে ফেলেন। তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং নূরুল হুদাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, নূরুল হুদা সব সময় বিএনপি তথা ২০ দল বিরোধী লোক এবং আওয়ামী লীগের খাস লোক। সুতরাং নূরুল হুদা কমিশন যে আরেকটি রকিব কমিশন হবে তার আলামত এখনই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে।
এখানে আরো কয়েকটি বিষয় সন্দেহকে ঘনীভূত করে। বাছাই কমিটির সাথে প্রেসিডেন্টের মিটিং এবং কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি- মাঝখানে সময় ছিল মাত্র দু’ঘণ্টা। এই দুই ঘণ্টায় বাছাই কমিটির ১০ জন সদস্যের জীবনবৃত্তান্ত পড়া এবং তাদের খোঁজ-খবর নেয়া ও মূল্যায়ন করতেই তো ২৪ ঘণ্টা লেগে যাওয়ার কথা। সেখানে মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে এসব যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করার অর্থই হলো, সব কিছুই আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। নাহলে কেন এই তাড়াহুড়ো? আরো কথা আছে। নূরুল হুদা, রফিকুল ইসলাম এবং ব্রিগেডিয়ার শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরীর নাম কে বা কারা প্রস্তাব করেছিলেন? কোত্থেকে এলো এই তিনটি নাম? তরীকত ফেডারেশন নামক একটি স্বল্প পরিচিত দল নাকি এসব নাম দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র মত দল, যারা বছরের পর বছর সরকার চালিয়েছে, তাদের হাত দিয়ে এসব নাম এলো না, আর এলো তরীকত ফেডারেশন নামক একটি দলের মাধ্যমে, যাদের কোনোদিন একটি ইউনিয়ন পরিষদ চালানোরও অভিজ্ঞতা নাই, তাদের হাত দিয়ে এলো এই তিনটি নাম এবং সেসব নাম প্রেসিডেন্ট গ্রহণও করলেন, সে কথাই কি আজ বিশ্বাস করতে হবে? নাকি নিজেরা না দিয়ে অন্যের হাত দিয়ে এসব নাম টেবিলে আনা হয়েছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে?
॥ দুই ॥
কথা ছিল, সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি তাদের বাছাই করা ১০ জনের নাম পূর্বাহ্নে জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন তাহলে বোঝা যাবে, এরা কারা, এদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা এবং এদের সততা ও নৈতিকতা অতীতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল কিনা? সেটি করা হলে সমগ্র বিষয়টি স্বচ্ছ থাকত। এরপর প্রেসিডেন্ট যখন ঐ ১০ জনের ভেতর থেকে ৫ জনের নাম চূড়ান্ত করতেন তখন আর কারো কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকত না। কিন্তু এবার সেটি করা হল না। বরং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন যে, চাঁদ উঠলেই সকলে দেখতে পাবেন। তাই নাম প্রকাশের কোনো দরকার নাই। তার কথাই বর্ণে বর্ণে মেনে নেয়া হলো। অন্য কমিশনারদের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কবিতা খানম, ব্রি: জে: শাহাদৎ হোসেন এবং রফিকুল ইসলাম কঠিন আওয়ামী লীগার। মাহবুব তালুকদারের নাম যদিও নাকি বিএনপি দিয়েছে, তবুও বিএনপি কোন বিবেচনায় এই নামটি দিয়েছে সেটি মোটেই আমার বোধগম্য নয়। তিনি বাংলার ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের একজন এ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। চাকরি জীবনেও আওয়ামীপন্থী আমলা ছিলেন। তিনি অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে যান। তাকে সচিব না করায় তার ক্ষোভ ছিল। এজন্য অবসর পরবর্তী জীবনে তিনি আওয়ামী সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। এই ক্ষুব্ধতা তার আওয়ামীপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটায়নি।
এখন প্রশ্ন হলো অন্যত্র। বিএনপি আওয়ামী সরকারের নিকট থেকে একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আশা করেছিল কিভাবে? একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের জন্য তারা প্রেসিডেন্টের ওপর অনেকখানি ভরসা করেছিল। কেন এমন ভরসা তারা করে তার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা ভুলে যায় কিভাবে যে, জনাব আব্দুল হামিদ কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন কয়েকদশক ধরে। তিনি শেখ মুজিবের একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মী ছিলেন। কিশোরগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি ছয়বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনাই তাকে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার বানান। শেখ হাসিনাই তাকে জাতীয় সংসদের স্পিকারও বানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তাকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বানান। এমন একটি পটভূমি এবং পরিস্থিতিতে বিএনপি কেমন করে আশা করে যে, প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ এমন একটি নির্বাচন কমিশন বানাবেন যেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দসই হবে না? বিএনপি তথা বিরোধী দলকে ভুললে চলবে না যে, ৭০ বছরের বেশি বয়স- এই ধুয়া তুলে সাবেক সচিব জনাব আসাফউদ্দৌলাকে বাতিল করা হয়েছে। তাহলে ৭৬ বছর বয়সী মাহবুব তালুকদারকে কমিশনার করা হলো কোন যুক্তিতে? একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের জন্য বিএনপি অনেক এনার্জি খরচ করেছে। দুই মাস ধরে তাদের প-িতরা পড়াশোনা ও গবেষণা করে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের একটি রূপরেখা দাঁড় করিয়েছে এবং জনগণের মাঝে সেটি প্রকাশও করেছে। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিগত ৬ দশক ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন তারা তখনই ভেবেছিলেন যে, বিএনপি এসব রিসার্চ ও ব্রেন স্টর্মিং সবই অরণ্যেরোদন। আওয়ামী লীগ কোন্ ধরনের ইলেকশন কমিশনার বানাবে সেটি তারা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিল। অনেকটা সেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত। শিশু তার মাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘মা আমি কোথায় ছিলেম? কিভাবে এলেম আমি?’ মা বলছেন, ‘ইচ্ছে হয়ে ছিলি তুই মনের মাঝারে।’ তেমনি নূরুল হুদা কমিশনও ইচ্ছে হয়েছিল সরকারের মনের মাঝারে। বাছাই কমিটির মাধ্যমে সেটির প্রসব হয়েছে মাত্র। সেই কমিশন একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, তেমন আশা যদি কেউ এখনও পোষণ করে থাকেন তাহলে বলতে হবে, ‘ধন্য আশা কুহকীনি।’
॥ তিন ॥
আবার একটি রকিব কমিশন গঠিত হলো। বিএনপি এই কমিশন প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু তাতে কি লাভ? একটি প্রেস কনফারেন্স করে প্রত্যাখ্যান করলেই কি ঐ কমিশন বাতিল হয়ে যাবে? সকলেই জানেন, বাতিল হবে না। হুদা কমিশন বাতিল করতে হলে প্রয়োজন হবে প্রবল গণআন্দোলনের। বিএনপি আমলে বিচারপতি এমএ সাত্তারকে চীফ ইলেকশন কমিশনার করে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। সেই কমিশন কাজ করতে পারেনি। প্রবল গণআন্দোলনের ফলে ঐ কমিশন বাতিল হয়েছিল। এসেছিল এটিএম শামসুল হুদা কমিশন। সেই ধরনের গণআন্দোলন কি বিএনপি করতে পারবে? গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে বিএনপি’র সামনে তথা সমস্ত বিরোধী দলের সামনে আর কোনো অপশন কি খোলা আছে?
॥ চার ॥
ইতোমধ্যেই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এবং পত্র-পত্রিকায় বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে বিশিষ্টজনরা বলছেন যে, আগামী নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে হলে সেটি অবশ্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। সেই সরকারকে আপনি যে নামেই ডাকুন না কেন, সেটি কেয়ারটেকার সরকার হতে পারে বা অন্য যে কোনো নামের সরকার হতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই দলীয় সরকার হতে পারবে না। তাদের মতে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারই বিজয়ী হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে, বিশেষ করে আওয়ামী সরকারের অধীনে গঠিত সমস্ত নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। হুদা কমিশন নামে যে আওয়ামী কমিশন গঠিত হলো তার ফলে আগামী নির্বাচনে ঐ কমিশন নয়, সরকারের ভূমিকাই মুখ্য হবে। রকিব কমিশন সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থাকেই নষ্ট করে গেছে। নষ্ট করার এই প্রক্রিয়ায় সরকারের মদত ছিল এবারও তেমন একটি কমিশনই গঠিত হলো এবং এই সরকারই সেটি গঠন করলো। নতুন সিইসি হুদা বলেছেন, তিনি কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। প্রশ্ন হলো, এই চাপ তাকে কে দেবে? নিশ্চয়ই বিরোধী দল নয়। কারণ চাপ দেয়ার মতো ক্ষমতা কি তাদের আছে? তারা তো বড়জোর কোনো ইস্যু বা দাবি নিয়ে কমিশনের কাছে যাবেন এবং একটি দাবিনামা বা স্মারকলিপি পেশ করবেন। এর বেশি কিছু তারা কি করবেন? চাপ এলে সিটি আসবে সরকারী দল থেকে। অতীতেও, বিশেষ করে আওয়ামী আমলে চাপ এসেছে সরকারী দল থেকে। এসব চাপের কাছে সম্পূর্ণ নতি স্বীকার করেছিল রকিব কমিশন। নতি স্বীকার করে তারা অনেক অন্যায় কাজ করেছে। ফলে নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ে ইউপি নির্বাচন-প্রতিটি স্তরে ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান, সহিংসতা, হত্যা, খুন জখম, এসব অপকর্মের ফলে শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনই নয়, সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থার ওপরেই জনগণের অনাস্থা জন্মেছে।
হুদা কমিশনের প্রধান কাজ হবে, এই বিশাল অনাস্থা দূর করা এবং জনগণের আস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনা। প্রো-গভর্নমেন্ট ইলেকশন কমিশন দিয়ে সেই আস্থা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। এটি ফিরিয়ে আনতে হবে সরকারকে। এই সরকার সেই কাজটি করবে বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সেটি করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে বিরোধী দলকে। জনগণকে সাথে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, হুদা কমিশন গঠনের পর সেই আন্দোলনের আর কোন বিকল্প পথ সরকার খোলা রাখলো না।