এক এগারো নিয়ে এদেশে অনেক আলোচনা হয়েছে। ১/১১-এর পর ১০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই ১০ বছরে এই দিবসটি নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে সেটা বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। কারণ দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক শিবির, অর্থাৎ বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগ নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে দিবসটির ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এ বছর অর্থাৎ চলতি জানুয়ারীর ১২ তারিখে দু’টি সংবাদ মনে হয় সব আলোচনাকে ছাপিয়ে গেছে। একটি হ’ল বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন আহমেদের একটি মন্তব্য। এবং অপরটি হ’ল আওয়ামী লীগ নেতা মোনায়েম সরকারের বক্তব্য। এমাজ উদ্দিন আহমদ তার বক্তব্য রেখেছেন একটি আলোচনা সভায়। এবং মোনায়েম সরকারের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে তারই রচিত গ্রন্থ থেকে।
গত ১১ জানুয়ারী বুধবার একটি আলোচনা সভায় অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, “এক-এগারোতে পরিকল্পিতভাবে জরুরী অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনার সব কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানেন। অথচ কেউ তাদের বিচারের কথা বলে না।” ১২ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার দৈনিক ‘দিনকাল’ প্রকাশিত ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর ন্যায়বোধের কাছে জবাবদিহিতা করা উচিত। সেই ন্যায়বোধের কারণেই এ ব্যাপারে তার পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এমাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন কিভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সবই জানেন। তার মতে, ঐদিন যেটা ঘটেছিল সেটা ছিলনা কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ। সেটি ছিল একটি সামরিক অভ্যুত্থান। কারণ ঐ সরকারে কে কে উপদেষ্টা হবেন তার একটি তালিকা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তার মতে এখন দেশে যে রাজনীতি চলছে সেটি মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের দেখিয়ে দেয়া পথেই চলছে। তিনি পুনরায় উল্লেখ করেন যে, ওয়ান-ইলেভেনে যা ঘটেছিল সেটি ছিল একটি সামরিক অভ্যুত্থান। সেই সময় সর্বত্র ছিল সেনাবাহিনীর উপস্থিতি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তা হ’লে তারা কি করবে সেটি আমি জানিনা। তবে শেখ হাসিনার উচিত ছিল ক্ষমতায় আসার পর তাদের বিচার করা। কোন আইনে, সংবিধানের কোন ধারা মতে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, অর্থাৎ এই দুইমাস মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনরা ক্ষমতায় থাকলেন তার জবাব বাংলাদেশের জনগণকে দিতেই হবে। কোনধারা বলে, কোন আইনে মইনুদ্দিন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেন তার কৈফিয়তও বাংলার জনগণ একদিন আদায় করবে। আর বিচার করতে হ’লে এক-এগারোর পূর্বাপর ঘটনাবলীল নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এবং বিচার হওয়া উচিত।
একই আলোচনা সভায় বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বর্তমান সরকার ওয়ান-ইলেভেনের বেনিফিশিয়ারী। ঐ সরকারের আমলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিপুল শ্রদ্ধা জানিয়ে গয়েশ্বর বলেন, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অমর এবং স্মরণীয় রাখার জন্য তাদের গেজেট প্রকাশ করুন। যারা গুম হয়েছেন, যারা গুম হয়ে খুন হয়েছেন তাদেরকে শহীদের মর্যাদা দিন এবং তাদের গেজেটও প্রকাশ করুন। গয়েশ্বর এই মর্মে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন যে, ওয়ান-ইলেভেনের মত আরেকটি ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের চারিদিকে ঘুরছে। এই ষড়যন্ত্র আরও শক্তিশালী।এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিএনপি’র নেতা-কর্মীকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, যেহেতু আওয়ামী লীগ ১/১১-এর বেনিফিশিয়ারী তাই তারা এক-এগারোর কুশীলবদের বিচার করবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাদের বিচার কোনোদিনই হবে না। বাংলার মাটিতে তাদের বিচার একদিন হবেই।
দিনকালের ঐ রিপোর্ট মোতাবেক গয়েশ্বর স্মরণ করিয়ে দেন যে, একটি পর্যায়ে এক এগারোর নায়করা পালাবার পথ পাচ্ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পালাবার পথ করে দেয়। যেহেতু মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করে দেয় তাই আওয়ামী লীগও তাদেরকে জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য পালাবার নিরাপদ রাস্তা, অর্থাৎ সেফ একজিট দেয়। সে জন্যই আওয়ামী লীগ বলে যে ওয়ান-ইলেভেন আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল।
॥ দুই ॥
এতক্ষণ ধরে আমরা এক-এগরো সম্পর্কে বিএনপি’র বক্তব্য পড়লাম। কিন্তু এই বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের মোনায়েম সরকারের বয়ানে। তার গ্রন্থ আত্মজৈবনিক, ভাষাচিত্র, ফেব্রুয়ারী ২০১৪-তে তিনি এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। ঐ গ্রন্থের ২৬৪ থেকে ২৬৮ পৃষ্ঠায় বিধৃত অংশে তিনি লিখেছেন, “ওয়ান-ইলেভেনের গণবিস্ফোরণের পর শেখ হাসিনা তখন কারারুদ্ধ। সে সময় শেখ হাসিনার মুক্তির বিষয়ে নানারকম খবর শোনা যেত। ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জনের বিদায় ভোজে উপস্থিত ছিলেন মোস্তফা ফারুক মাহমুদ। তিনি ছিলেন ভারতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি পিনাক রঞ্জনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, খবরটি কতদূর সত্য। বিদায়ী হাইকমিশনার পিনাকী জানালেন, খবরটি সত্য নয়।
এরপর মোনায়েম সরকার লিখছেন, আমরা আরও খবর পেলাম, শেখ হাসিনাকে জেলের ভেতর হত্যা করা হতে পারে। ঠিক হ’ল ঢাকা থেকে আমি (মোনায়েম চৌধুরী) কলকাতা যাব, আর লন্ডন থেকে গাফফার চৌধুরী কলকাতা আসবেন। সেই মোতাবেক মোনায়েম সরকার কলকাতা যান। সেখানে ‘বাংলা স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক মানস শেখ বললেন, দাদা এসেছেন যখন, তখন দিল্লীটা ঘুরে যান। তখন আমি দিল্লী গেলাম। (এরপর যতগুলো ক্ষেত্রে ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সব ক্ষেত্রেই মোনায়েম সরকারকে বোঝানো হয়েছে)। চেষ্টা করলাম তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মূখার্জীর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন ব্যস্ত। তার ব্যক্তিগত সচিব পরামর্শ দিলেন কলকাতা যেয়ে দেখা করতে। তখন দেখা করলাম মুচকুন্দ দুবের সঙ্গে। তখন তার একটি রিসার্চ সেন্টার ছিল। সেই রিসার্চ সেন্টারের পাশে অবস্থিত একটি ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের পাশে একটি রেস্তোরায় আমরা বসলাম। তাঁর কাছ থেকে জানতে চাইলাম, এ অবস্থায় আপনি কি করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর সিকিউরিটি এ্যাডভাইজার নারায়ণের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বললেন, আমরা পাকিস্তান আর্মী আর বার্মার আর্মীর সঙ্গে ডিল করি। সে রকম বাংলাদেশ আর্মীর সঙ্গেও ডিল করব।’ তা’হলে কি করা যায়? মুচকুন্দ দুবে সাফ জানালেন, ‘সেটা আমি জানিনা।’
তখন আমি বাংলাদেশে কাজ করা ভারতের প্রাক্তন হাইকমিশনার দেব মূখার্জীকে ফোন করে জানতে চাইলাম, আই. কে. গুজরালকে বললে কি কিছু হবে? বললেন, হতে পারে। আই. কে. গুজলার ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ৫ জনপদ রোডে থাকতেন। তার পিএকে ফোন করলাম। তার পিএ বললেন, ‘আগামীকাল বিকাল ৫টায় ৫নং জনপদ রোডের বাসায় চলে আসুন।’
॥ তিন ॥
সুপ্রিয় পাঠক ভাই-বোনেরা, এতক্ষণ আমরা এক এগারো সম্পর্কে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরলাম। এই বিবরণ পড়ার পর আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, এরা যা বলেছেন তার এক বিন্দুও আমাদের কথা নয়। বিবরণী লম্বা হয়ে গেছে। কিন্তু লম্বা বিবরণী না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। কারণ সম্মানিত পাঠকের কাছে আমরা পূর্ণ সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, অর্ধসত্য উপস্থাপন করে তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চাইনি। তবে দেখা গেল যে, ওয়ান-ইলেভেন সম্পর্কে দেশের সবচেয়ে বড় দু’টি দল একেবারে পরস্পর বিরোধী কথা বলছে। বিএনপি বলছে যে, শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ জানতো যে, ওয়ান-ইলেভেন আসছে। আর সেজন্য তারা উপদেষ্টাদের লিষ্টও প্রস্তুত করে রেখেছিল। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ বলছে যে, এক-এগারোর জেলে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছিল। এখন মানুষ বিশ্বাস করবে কার কথা?
প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে উঁকি দেয়, সেটি হ’ল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এক-এগারোর ষড়যন্ত্র যদি হয়ে থাকে তাহলে তারা কিভাবে এবং কেন বলেছিলেন যে, এক-এগারো তাদের আন্দোলনের ফসল? যদি তখন যদি শেখ হাসিনাকে হত্যারই চেষ্টা করা হয়ে থাকে তাহলে আট বছর ধরে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এক-এগারোর কোনো কুশীলবেরই বিচার হ’লনা কেন? প্রধান সেনাপতি মইন উ আহম্মদ, প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা (মন্ত্রী) ড. ইফতেখার আহমদ চৌধুরীসহ প্রায় সকলেই নিরাপদ বহির্গমনের পথ পেয়ে দেশের বাইরে চলে গেলেন কিভাবে? আর এর সব কিছুই আওয়ামী সরকারের আমলে সম্ভব হ’ল কিভাবে? শেখ হাসিনা যেমন জেল থেকে বেরিয়ে দেশের বাইরে চলে গেলেন, তেমনি বিদেশ থেকেও নিরাপদে ফিরলেন কিভাবে? পক্ষান্তরে বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র বিএনপি’র দুই নাম্বার নেতা তারেক রহমানকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিল কারা? সেটাও তো এই ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের জরুরী সরকার। শুধু তাই নয়। তাকে দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তাকে আর দেশে ফিরতে দেয়া হ’ল না কেন? আজ আওয়ামী লীগ যে তারেককে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না সেটা তো জরুরী সরকারেরই ধারাবাহিকতা।
আরেকটি কথা বলে শেষ করব। আওয়ামী লীগ যে কিভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের জন্য ধরনা দেয় এবং ভারত যে কি শক্তভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে সেটি মোনায়েম সরকারের লেখা গোটাটাই আপনারা জানতে পারলেন।
গত ১১ জানুয়ারী বুধবার একটি আলোচনা সভায় অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, “এক-এগারোতে পরিকল্পিতভাবে জরুরী অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনার সব কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানেন। অথচ কেউ তাদের বিচারের কথা বলে না।” ১২ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার দৈনিক ‘দিনকাল’ প্রকাশিত ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর ন্যায়বোধের কাছে জবাবদিহিতা করা উচিত। সেই ন্যায়বোধের কারণেই এ ব্যাপারে তার পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এমাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন কিভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সবই জানেন। তার মতে, ঐদিন যেটা ঘটেছিল সেটা ছিলনা কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ। সেটি ছিল একটি সামরিক অভ্যুত্থান। কারণ ঐ সরকারে কে কে উপদেষ্টা হবেন তার একটি তালিকা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তার মতে এখন দেশে যে রাজনীতি চলছে সেটি মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের দেখিয়ে দেয়া পথেই চলছে। তিনি পুনরায় উল্লেখ করেন যে, ওয়ান-ইলেভেনে যা ঘটেছিল সেটি ছিল একটি সামরিক অভ্যুত্থান। সেই সময় সর্বত্র ছিল সেনাবাহিনীর উপস্থিতি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তা হ’লে তারা কি করবে সেটি আমি জানিনা। তবে শেখ হাসিনার উচিত ছিল ক্ষমতায় আসার পর তাদের বিচার করা। কোন আইনে, সংবিধানের কোন ধারা মতে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, অর্থাৎ এই দুইমাস মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনরা ক্ষমতায় থাকলেন তার জবাব বাংলাদেশের জনগণকে দিতেই হবে। কোনধারা বলে, কোন আইনে মইনুদ্দিন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেন তার কৈফিয়তও বাংলার জনগণ একদিন আদায় করবে। আর বিচার করতে হ’লে এক-এগারোর পূর্বাপর ঘটনাবলীল নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এবং বিচার হওয়া উচিত।
একই আলোচনা সভায় বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বর্তমান সরকার ওয়ান-ইলেভেনের বেনিফিশিয়ারী। ঐ সরকারের আমলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিপুল শ্রদ্ধা জানিয়ে গয়েশ্বর বলেন, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অমর এবং স্মরণীয় রাখার জন্য তাদের গেজেট প্রকাশ করুন। যারা গুম হয়েছেন, যারা গুম হয়ে খুন হয়েছেন তাদেরকে শহীদের মর্যাদা দিন এবং তাদের গেজেটও প্রকাশ করুন। গয়েশ্বর এই মর্মে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন যে, ওয়ান-ইলেভেনের মত আরেকটি ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের চারিদিকে ঘুরছে। এই ষড়যন্ত্র আরও শক্তিশালী।এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিএনপি’র নেতা-কর্মীকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, যেহেতু আওয়ামী লীগ ১/১১-এর বেনিফিশিয়ারী তাই তারা এক-এগারোর কুশীলবদের বিচার করবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাদের বিচার কোনোদিনই হবে না। বাংলার মাটিতে তাদের বিচার একদিন হবেই।
দিনকালের ঐ রিপোর্ট মোতাবেক গয়েশ্বর স্মরণ করিয়ে দেন যে, একটি পর্যায়ে এক এগারোর নায়করা পালাবার পথ পাচ্ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পালাবার পথ করে দেয়। যেহেতু মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করে দেয় তাই আওয়ামী লীগও তাদেরকে জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য পালাবার নিরাপদ রাস্তা, অর্থাৎ সেফ একজিট দেয়। সে জন্যই আওয়ামী লীগ বলে যে ওয়ান-ইলেভেন আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল।
॥ দুই ॥
এতক্ষণ ধরে আমরা এক-এগরো সম্পর্কে বিএনপি’র বক্তব্য পড়লাম। কিন্তু এই বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের মোনায়েম সরকারের বয়ানে। তার গ্রন্থ আত্মজৈবনিক, ভাষাচিত্র, ফেব্রুয়ারী ২০১৪-তে তিনি এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। ঐ গ্রন্থের ২৬৪ থেকে ২৬৮ পৃষ্ঠায় বিধৃত অংশে তিনি লিখেছেন, “ওয়ান-ইলেভেনের গণবিস্ফোরণের পর শেখ হাসিনা তখন কারারুদ্ধ। সে সময় শেখ হাসিনার মুক্তির বিষয়ে নানারকম খবর শোনা যেত। ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জনের বিদায় ভোজে উপস্থিত ছিলেন মোস্তফা ফারুক মাহমুদ। তিনি ছিলেন ভারতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি পিনাক রঞ্জনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, খবরটি কতদূর সত্য। বিদায়ী হাইকমিশনার পিনাকী জানালেন, খবরটি সত্য নয়।
এরপর মোনায়েম সরকার লিখছেন, আমরা আরও খবর পেলাম, শেখ হাসিনাকে জেলের ভেতর হত্যা করা হতে পারে। ঠিক হ’ল ঢাকা থেকে আমি (মোনায়েম চৌধুরী) কলকাতা যাব, আর লন্ডন থেকে গাফফার চৌধুরী কলকাতা আসবেন। সেই মোতাবেক মোনায়েম সরকার কলকাতা যান। সেখানে ‘বাংলা স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক মানস শেখ বললেন, দাদা এসেছেন যখন, তখন দিল্লীটা ঘুরে যান। তখন আমি দিল্লী গেলাম। (এরপর যতগুলো ক্ষেত্রে ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সব ক্ষেত্রেই মোনায়েম সরকারকে বোঝানো হয়েছে)। চেষ্টা করলাম তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মূখার্জীর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন ব্যস্ত। তার ব্যক্তিগত সচিব পরামর্শ দিলেন কলকাতা যেয়ে দেখা করতে। তখন দেখা করলাম মুচকুন্দ দুবের সঙ্গে। তখন তার একটি রিসার্চ সেন্টার ছিল। সেই রিসার্চ সেন্টারের পাশে অবস্থিত একটি ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের পাশে একটি রেস্তোরায় আমরা বসলাম। তাঁর কাছ থেকে জানতে চাইলাম, এ অবস্থায় আপনি কি করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর সিকিউরিটি এ্যাডভাইজার নারায়ণের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বললেন, আমরা পাকিস্তান আর্মী আর বার্মার আর্মীর সঙ্গে ডিল করি। সে রকম বাংলাদেশ আর্মীর সঙ্গেও ডিল করব।’ তা’হলে কি করা যায়? মুচকুন্দ দুবে সাফ জানালেন, ‘সেটা আমি জানিনা।’
তখন আমি বাংলাদেশে কাজ করা ভারতের প্রাক্তন হাইকমিশনার দেব মূখার্জীকে ফোন করে জানতে চাইলাম, আই. কে. গুজরালকে বললে কি কিছু হবে? বললেন, হতে পারে। আই. কে. গুজলার ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ৫ জনপদ রোডে থাকতেন। তার পিএকে ফোন করলাম। তার পিএ বললেন, ‘আগামীকাল বিকাল ৫টায় ৫নং জনপদ রোডের বাসায় চলে আসুন।’
॥ তিন ॥
সুপ্রিয় পাঠক ভাই-বোনেরা, এতক্ষণ আমরা এক এগারো সম্পর্কে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরলাম। এই বিবরণ পড়ার পর আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, এরা যা বলেছেন তার এক বিন্দুও আমাদের কথা নয়। বিবরণী লম্বা হয়ে গেছে। কিন্তু লম্বা বিবরণী না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। কারণ সম্মানিত পাঠকের কাছে আমরা পূর্ণ সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, অর্ধসত্য উপস্থাপন করে তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চাইনি। তবে দেখা গেল যে, ওয়ান-ইলেভেন সম্পর্কে দেশের সবচেয়ে বড় দু’টি দল একেবারে পরস্পর বিরোধী কথা বলছে। বিএনপি বলছে যে, শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ জানতো যে, ওয়ান-ইলেভেন আসছে। আর সেজন্য তারা উপদেষ্টাদের লিষ্টও প্রস্তুত করে রেখেছিল। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ বলছে যে, এক-এগারোর জেলে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছিল। এখন মানুষ বিশ্বাস করবে কার কথা?
প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে উঁকি দেয়, সেটি হ’ল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এক-এগারোর ষড়যন্ত্র যদি হয়ে থাকে তাহলে তারা কিভাবে এবং কেন বলেছিলেন যে, এক-এগারো তাদের আন্দোলনের ফসল? যদি তখন যদি শেখ হাসিনাকে হত্যারই চেষ্টা করা হয়ে থাকে তাহলে আট বছর ধরে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এক-এগারোর কোনো কুশীলবেরই বিচার হ’লনা কেন? প্রধান সেনাপতি মইন উ আহম্মদ, প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা (মন্ত্রী) ড. ইফতেখার আহমদ চৌধুরীসহ প্রায় সকলেই নিরাপদ বহির্গমনের পথ পেয়ে দেশের বাইরে চলে গেলেন কিভাবে? আর এর সব কিছুই আওয়ামী সরকারের আমলে সম্ভব হ’ল কিভাবে? শেখ হাসিনা যেমন জেল থেকে বেরিয়ে দেশের বাইরে চলে গেলেন, তেমনি বিদেশ থেকেও নিরাপদে ফিরলেন কিভাবে? পক্ষান্তরে বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র বিএনপি’র দুই নাম্বার নেতা তারেক রহমানকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিল কারা? সেটাও তো এই ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের জরুরী সরকার। শুধু তাই নয়। তাকে দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তাকে আর দেশে ফিরতে দেয়া হ’ল না কেন? আজ আওয়ামী লীগ যে তারেককে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না সেটা তো জরুরী সরকারেরই ধারাবাহিকতা।
আরেকটি কথা বলে শেষ করব। আওয়ামী লীগ যে কিভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের জন্য ধরনা দেয় এবং ভারত যে কি শক্তভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে সেটি মোনায়েম সরকারের লেখা গোটাটাই আপনারা জানতে পারলেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন