আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিষের বাঁশী’ (প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ১৯২৪) কাব্যগ্রন্থের ‘সেবক’ কবিতায় লিখেছেন, ‘সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়,/ নাই কি রে কেউ সত্য-সাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?-/ শিকলগুলো বিকল করে পায়ের তলায় মাড়ায়,-/ বজ্র-হাতে জিন্দানের ঐ ভিত্তিটাকে নাড়ায়?/ নাজাত-পথের আজাদ মানব নেই কি রে কেউ বাঁচা,/ ভাঙতে পারে ত্রিশ কোটির এই মানুষ-মেষের খাঁচা?/ ঝুটার পায়ে শির লুটাবে, এতই ভীরু সাঁচা?-’। এই কবিতায় তিনি এমন এক সেবককে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, যিনি মনে করেন- ‘বন্দি থাকা হীন অপমান’ হাঁকবে যে বীর তরুণ/শিরদাঁড়া যার শক্ত তাজা, রক্ত যাহার অরুণ,/সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের,/ খোদার রাহায় জান দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের।/ দেশের পায়ে প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের, সত্য মুক্ত স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের।”
কাজী নজরুল ইসলাম উপনিবেশবাদী বৃটিশদের হাতে বন্দী ভারতের স্বাধীনতার জন্য সেবকের আহ্বান জানাচ্ছিলেন, সত্য-সাধকের সন্ধান করছিলেন, যে কারাগারের দুয়ার ভেঙে হাঁক দিয়ে উঠতে পারে, সেবক আমি, সেবক তোদের ভাইরা আমার। সে ভারত স্বাধীন হয়েছিল। তবে একটি রাষ্ট্র হিসেবে নয়। ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্র হিসেবে। তার জন্য শেষ পর্যন্ত ভারতবাসীকে যুদ্ধ করতে হয়নি। তারা বৃটিশের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে ঐ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু নজরুলের মতো এমন হাজার হাজার স্বাধীনচেতা মানুষকে তার জন্য অনেক জেল-জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল।
আর আমরা আলোচনার টেবিলে বসে বাংলাদেশ স্বাধীন করিনি। নয় মাস ধরে আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছি। অনেক রক্তক্ষয় আর ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে সে যুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু রাষ্ট্র স্বাধীন হলেই যে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন পূরণ হবেÑ এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে স্বাধীন রাষ্ট্রে কোটি কোটি মানুষ স্বৈরশাসকদের নির্যাতন নিষ্পেষণে রুদ্ধবাক হয়ে গেছে, হয়ে আছে। সত্য প্রকাশ মানেই হয়ে গেছে জীবনের অবসান। গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। স্বাধীন দেশেও মানুষের মৌলিক অধিকার হয়েছে হচ্ছে পদদলিত। আমরা তার সামান্যই খবর রাখি।
খবর সামান্য রাখলেও আমরা বাংলাদেশের এখন একই অবস্থায় নিপতিত হয়েছি। শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতার লোভের কাছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। ক্রমেই ধ্বংসের অতল গহ্বরে নেমে যাচ্ছে সমাজ। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রাজনীতিক, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে নাগরিক নিরাপত্তা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। কোথায়ও এর কোনো প্রতিকারও নেই। এক হায়েনার কাছ থেকে পালাতে গিয়ে পড়ছে আর এক হায়েনার কবলে। সে আরও হিংস্র। আরও ভয়ঙ্কর। দস্যুতার কবলে পড়া এখন নাগরিকদের নিয়তি। সরকারের মদতে-প্রশ্রয়ে এখন জন্ম নিয়েছে একটি লুটেরা শ্রেণী। যারা দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। সরকার এখানে নিতান্তই দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। আর এদের খাঁই মেটাতে সরকার জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে যাচ্ছে। বোঝা দিচ্ছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটি দিচ্ছে। আমরা এই ভারে ক্রমেই ন্যুব্জপৃষ্ঠ হয়ে পড়ছি।
সমাজ থেকে নীতি-নৈতিকতা এখন উধাও। মৌলিক মূল্যবোধগুলো ভেঙে খানখান। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের মতো এখানে অনাচারই আচারে পরিণত হয়েছে। দাগী অপরাধী ও আদালতে দণ্ডিতরা মন্ত্রিসভা আলোকিত করে আছেন। খুনের মামলার আসামীরাও সংসদ সদস্য হিসাবে থাকেন বহাল তবিয়তে। কার্যত সরকার দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলে নির্বিঘ্নে যে- কোনো অপরাধ করে পার পাওয়া যায়, বিচার হয় না। সরকার প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী লুটেরাদের সমর্থন দেয়। তাদের পক্ষে সাফাই গায়। ফলে এরা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। কী অপরাধ এখন আমাদের সমাজে ঘটছে না, সেটা খুঁজে বের করা মুশকিল। যেসব অপরাধ এক সময় কল্পনাও করা যেত না, তা এখন ঘটছে অহরহ।
নারীরা তো বটেই তিন বছরের কন্যা শিশুও বাইরে তো বটেই ঘরেও নিরাপদ নয়। তারা হামেশাই শিকার হচ্ছেন খুন-ধর্ষণের। কিন্তু কোথায়ও এর কোনো প্রতিকার পাওয়ার উপায় নেই। সরকার ব্যস্ত বিরোধী দলকে কেবল গালিগালাজআর নির্যাতন করা নিয়ে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে তাদের না-হক এক গীত শুনতে শুনতে কান ঝালা পালা হয়ে গেছে। শত মুখে বছরের পর বছর ধরে এসব শুনতে শুনতে মানুষ অতীষ্ঠ হয়ে গেছে। নয় বছর যারা ক্ষমতার বাইরে, তারাই নাকি সব কিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তাহলে বিগত নয় বছর ধরে তারা কি বসে বসে আঙুল চুষেছেন? এখানে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হাড় ভেঙে দেওয়ার জন্য সরকার দলের লোকেরা জঙ্গি মিছিল করে। এক একজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শত শত হয়রানিমূলক মামলা দেয়। বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আক্রোশের বশবর্তী হয়ে ডজন ডজন মামলা দিয়ে কারাগারে বন্দী রাখে।
অথচ দুর্নীতিবাজ চোর বাটপারদের বিরুদ্ধে, শিশু ধর্ষকদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলে না। বরং দুর্নীতিবাজদের, খুনী-ধর্ষকদের আড়াল করার জন্য কত কোশেশই না করে। এই যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনা। প্রথম কয়েক দিন অর্থমন্ত্রীর হম্বিতম্বি শুনলাম। তদন্ত কমিটিও গঠন করা হলো। সে কমিটি রিপোর্টও দিলো। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলও সে রিপোর্ট নিজের বগলতলে আটকে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত। সকল তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই টাকা লুটে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত আছেন। তাদের নামও দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা রিপোর্টে। কিন্তু তাদের রক্ষার জন্য যেন মরিয়া হয়ে আছে সরকার। ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে একেবারে ধোয়া তুলশি পাতা বানিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ তাকেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল সবার আগে। সে সম্পর্কিত রিপোর্ট এখন প্রকাশ করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলছেন, সে রিপোর্ট প্রকাশ করতে অনেক সময় লাগবে। এজন্য আসলে অর্থমন্ত্রীকেই বিচারের আওতায় আনা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ব্যাংকগুলো থেকে লুট হয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। আবার দলীয় লোকদের ঋণ রিশিডিউলের নামে আরও লক্ষ কোটি টাকাকে করা হয়েছে মন্দ ঋণ। যা আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ যেন লুটের এক মহোৎসব চলছে দেশজুড়ে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে গোড়া থেকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যে মৌলিক নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে শিশু বেড়ে ওঠে, সেগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে পাঠ্যপুস্তক থেকে। সদা সত্য কথা বলিবে, গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিবে, কানাকে কানা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও নাÑ এই ধরনের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো পাঠ্যবই থেকে উধাও হয়ে গেছে। ফলে দেশে মূল্যবোধে ব্যাপক ধস নেমেছে। এছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি একবারে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে পাঠ্যপুস্তকে। এদেশের স্বাধীনতার যে হাজার বছরের ইতিহাস, তার কিছুই জানতে পারছে না আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ফলে এক উন্মূল উদ্বাস্তু প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। যারা জানে না, কী তার ইতিহাস-ঐতিহ্য, কী তার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়।
এর পরিণতি যা হবার তাই হচ্ছে। বখে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। এখন যারা কিশোর, তারাও পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তুলেছে অপরাধী গ্যাং। এরা নানা ধরনের অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে ছিনতাই, ডাকাতি, খুনোখুনি, ইভ টিজিং, ধর্ষণ- কী অপরাধ তারা করছে না। এই দলে আছে উচ্চবিত্তের সন্তানসহ নিম্নবিত্তের সন্তানেরা। এ এক ভয়ঙ্কর অবস্থা! এজন্য কোনো কোনো এলাকায় আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কেন এমন হলো? এর প্রধান কারণ, এই কিশোরেরা দেখতে পাচ্ছে যে, তাদের ‘বড় ভাইয়েরা’ যদি একই ধরনের কাজ করে পার পেয়ে যেতে পারে, তাহলে তারা পারবে না কেন। সমাজপতিরা ভেবেও দেখছেন না, কেন এমন হলো। তারা অপরাধীদের প্রশ্রয় দিয়েই যাচ্ছেন। তার বিষময় ফল এখন ফলতে শুরু করেছে। আর তার মূল্য দিতে হয়েছে সমাজের সকলকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ অনেক। এ অভিযোগ আগেও ছিল। তবে তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখা হতো। আর দোষী সদস্যের বিরুদ্ধে সে সময় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো বলে তা নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল। এখন তা আর নিয়ন্ত্রণযোগ্য নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেশি মাত্রায় দলীয়করণের ফলেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর হয়েছে তাদের বিরোধী দল ঠ্যাংগানোর কাজে ব্যবহার করার ফলে। তারা খুন, ধর্ষণ, গুম, মুক্তিপণ আদায়সহ সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে মানুষ এখন আশ্রয়হারা। আর সারাদেশে নারী নির্যাতন এখন সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তিন বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধা পয়ন্ত কেউ বাদ পড়ছে না। কিন্তু প্রতিকার হচ্ছে না। আবার এদিকে সরকারের কোনো মনোযোগ আছে বলেও মনে হয় না। কারণ এ ধরনের ঘটনায় আজ পর্যন্ত কারও দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়নি। আর এর পেছনেও আছে সরকার দলের ক্যাডাররা। ফলে তাদের সাত খুন মাফ।
কিন্তু এই অবস্থা তো চলতে পারে না। আমাদের বিশ্বাস, সমাজ থেকে প্রতিবাদী বিবেকবান মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি। প্রতিবাদে তাদের সোচ্চার হতেই হবে। তাই কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় আবারও বলতে চাই: ‘বিশ্ব-গ্রাসীর ত্রাস নাশি আজ আসবে কে বীর এসো/ ঝুট শাসনে করতে শাসন, শ্বাস যদি হয় শেষও।/ -কে আছ বীর এস!’
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
কাজী নজরুল ইসলাম উপনিবেশবাদী বৃটিশদের হাতে বন্দী ভারতের স্বাধীনতার জন্য সেবকের আহ্বান জানাচ্ছিলেন, সত্য-সাধকের সন্ধান করছিলেন, যে কারাগারের দুয়ার ভেঙে হাঁক দিয়ে উঠতে পারে, সেবক আমি, সেবক তোদের ভাইরা আমার। সে ভারত স্বাধীন হয়েছিল। তবে একটি রাষ্ট্র হিসেবে নয়। ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্র হিসেবে। তার জন্য শেষ পর্যন্ত ভারতবাসীকে যুদ্ধ করতে হয়নি। তারা বৃটিশের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে ঐ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু নজরুলের মতো এমন হাজার হাজার স্বাধীনচেতা মানুষকে তার জন্য অনেক জেল-জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল।
আর আমরা আলোচনার টেবিলে বসে বাংলাদেশ স্বাধীন করিনি। নয় মাস ধরে আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছি। অনেক রক্তক্ষয় আর ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে সে যুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু রাষ্ট্র স্বাধীন হলেই যে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন পূরণ হবেÑ এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে স্বাধীন রাষ্ট্রে কোটি কোটি মানুষ স্বৈরশাসকদের নির্যাতন নিষ্পেষণে রুদ্ধবাক হয়ে গেছে, হয়ে আছে। সত্য প্রকাশ মানেই হয়ে গেছে জীবনের অবসান। গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। স্বাধীন দেশেও মানুষের মৌলিক অধিকার হয়েছে হচ্ছে পদদলিত। আমরা তার সামান্যই খবর রাখি।
খবর সামান্য রাখলেও আমরা বাংলাদেশের এখন একই অবস্থায় নিপতিত হয়েছি। শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতার লোভের কাছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। ক্রমেই ধ্বংসের অতল গহ্বরে নেমে যাচ্ছে সমাজ। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রাজনীতিক, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে নাগরিক নিরাপত্তা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। কোথায়ও এর কোনো প্রতিকারও নেই। এক হায়েনার কাছ থেকে পালাতে গিয়ে পড়ছে আর এক হায়েনার কবলে। সে আরও হিংস্র। আরও ভয়ঙ্কর। দস্যুতার কবলে পড়া এখন নাগরিকদের নিয়তি। সরকারের মদতে-প্রশ্রয়ে এখন জন্ম নিয়েছে একটি লুটেরা শ্রেণী। যারা দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। সরকার এখানে নিতান্তই দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। আর এদের খাঁই মেটাতে সরকার জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে যাচ্ছে। বোঝা দিচ্ছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটি দিচ্ছে। আমরা এই ভারে ক্রমেই ন্যুব্জপৃষ্ঠ হয়ে পড়ছি।
সমাজ থেকে নীতি-নৈতিকতা এখন উধাও। মৌলিক মূল্যবোধগুলো ভেঙে খানখান। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের মতো এখানে অনাচারই আচারে পরিণত হয়েছে। দাগী অপরাধী ও আদালতে দণ্ডিতরা মন্ত্রিসভা আলোকিত করে আছেন। খুনের মামলার আসামীরাও সংসদ সদস্য হিসাবে থাকেন বহাল তবিয়তে। কার্যত সরকার দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলে নির্বিঘ্নে যে- কোনো অপরাধ করে পার পাওয়া যায়, বিচার হয় না। সরকার প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী লুটেরাদের সমর্থন দেয়। তাদের পক্ষে সাফাই গায়। ফলে এরা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। কী অপরাধ এখন আমাদের সমাজে ঘটছে না, সেটা খুঁজে বের করা মুশকিল। যেসব অপরাধ এক সময় কল্পনাও করা যেত না, তা এখন ঘটছে অহরহ।
নারীরা তো বটেই তিন বছরের কন্যা শিশুও বাইরে তো বটেই ঘরেও নিরাপদ নয়। তারা হামেশাই শিকার হচ্ছেন খুন-ধর্ষণের। কিন্তু কোথায়ও এর কোনো প্রতিকার পাওয়ার উপায় নেই। সরকার ব্যস্ত বিরোধী দলকে কেবল গালিগালাজআর নির্যাতন করা নিয়ে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে তাদের না-হক এক গীত শুনতে শুনতে কান ঝালা পালা হয়ে গেছে। শত মুখে বছরের পর বছর ধরে এসব শুনতে শুনতে মানুষ অতীষ্ঠ হয়ে গেছে। নয় বছর যারা ক্ষমতার বাইরে, তারাই নাকি সব কিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তাহলে বিগত নয় বছর ধরে তারা কি বসে বসে আঙুল চুষেছেন? এখানে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হাড় ভেঙে দেওয়ার জন্য সরকার দলের লোকেরা জঙ্গি মিছিল করে। এক একজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শত শত হয়রানিমূলক মামলা দেয়। বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আক্রোশের বশবর্তী হয়ে ডজন ডজন মামলা দিয়ে কারাগারে বন্দী রাখে।
অথচ দুর্নীতিবাজ চোর বাটপারদের বিরুদ্ধে, শিশু ধর্ষকদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলে না। বরং দুর্নীতিবাজদের, খুনী-ধর্ষকদের আড়াল করার জন্য কত কোশেশই না করে। এই যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনা। প্রথম কয়েক দিন অর্থমন্ত্রীর হম্বিতম্বি শুনলাম। তদন্ত কমিটিও গঠন করা হলো। সে কমিটি রিপোর্টও দিলো। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলও সে রিপোর্ট নিজের বগলতলে আটকে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত। সকল তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই টাকা লুটে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত আছেন। তাদের নামও দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা রিপোর্টে। কিন্তু তাদের রক্ষার জন্য যেন মরিয়া হয়ে আছে সরকার। ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে একেবারে ধোয়া তুলশি পাতা বানিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ তাকেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল সবার আগে। সে সম্পর্কিত রিপোর্ট এখন প্রকাশ করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলছেন, সে রিপোর্ট প্রকাশ করতে অনেক সময় লাগবে। এজন্য আসলে অর্থমন্ত্রীকেই বিচারের আওতায় আনা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ব্যাংকগুলো থেকে লুট হয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। আবার দলীয় লোকদের ঋণ রিশিডিউলের নামে আরও লক্ষ কোটি টাকাকে করা হয়েছে মন্দ ঋণ। যা আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ যেন লুটের এক মহোৎসব চলছে দেশজুড়ে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে গোড়া থেকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যে মৌলিক নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে শিশু বেড়ে ওঠে, সেগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে পাঠ্যপুস্তক থেকে। সদা সত্য কথা বলিবে, গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিবে, কানাকে কানা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও নাÑ এই ধরনের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো পাঠ্যবই থেকে উধাও হয়ে গেছে। ফলে দেশে মূল্যবোধে ব্যাপক ধস নেমেছে। এছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি একবারে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে পাঠ্যপুস্তকে। এদেশের স্বাধীনতার যে হাজার বছরের ইতিহাস, তার কিছুই জানতে পারছে না আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ফলে এক উন্মূল উদ্বাস্তু প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। যারা জানে না, কী তার ইতিহাস-ঐতিহ্য, কী তার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়।
এর পরিণতি যা হবার তাই হচ্ছে। বখে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। এখন যারা কিশোর, তারাও পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তুলেছে অপরাধী গ্যাং। এরা নানা ধরনের অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে ছিনতাই, ডাকাতি, খুনোখুনি, ইভ টিজিং, ধর্ষণ- কী অপরাধ তারা করছে না। এই দলে আছে উচ্চবিত্তের সন্তানসহ নিম্নবিত্তের সন্তানেরা। এ এক ভয়ঙ্কর অবস্থা! এজন্য কোনো কোনো এলাকায় আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কেন এমন হলো? এর প্রধান কারণ, এই কিশোরেরা দেখতে পাচ্ছে যে, তাদের ‘বড় ভাইয়েরা’ যদি একই ধরনের কাজ করে পার পেয়ে যেতে পারে, তাহলে তারা পারবে না কেন। সমাজপতিরা ভেবেও দেখছেন না, কেন এমন হলো। তারা অপরাধীদের প্রশ্রয় দিয়েই যাচ্ছেন। তার বিষময় ফল এখন ফলতে শুরু করেছে। আর তার মূল্য দিতে হয়েছে সমাজের সকলকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ অনেক। এ অভিযোগ আগেও ছিল। তবে তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখা হতো। আর দোষী সদস্যের বিরুদ্ধে সে সময় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো বলে তা নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল। এখন তা আর নিয়ন্ত্রণযোগ্য নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেশি মাত্রায় দলীয়করণের ফলেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর হয়েছে তাদের বিরোধী দল ঠ্যাংগানোর কাজে ব্যবহার করার ফলে। তারা খুন, ধর্ষণ, গুম, মুক্তিপণ আদায়সহ সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে মানুষ এখন আশ্রয়হারা। আর সারাদেশে নারী নির্যাতন এখন সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তিন বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধা পয়ন্ত কেউ বাদ পড়ছে না। কিন্তু প্রতিকার হচ্ছে না। আবার এদিকে সরকারের কোনো মনোযোগ আছে বলেও মনে হয় না। কারণ এ ধরনের ঘটনায় আজ পর্যন্ত কারও দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়নি। আর এর পেছনেও আছে সরকার দলের ক্যাডাররা। ফলে তাদের সাত খুন মাফ।
কিন্তু এই অবস্থা তো চলতে পারে না। আমাদের বিশ্বাস, সমাজ থেকে প্রতিবাদী বিবেকবান মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি। প্রতিবাদে তাদের সোচ্চার হতেই হবে। তাই কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় আবারও বলতে চাই: ‘বিশ্ব-গ্রাসীর ত্রাস নাশি আজ আসবে কে বীর এসো/ ঝুট শাসনে করতে শাসন, শ্বাস যদি হয় শেষও।/ -কে আছ বীর এস!’
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী