বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৪

তাহলে মানবিকতার ভিন্ন সংজ্ঞাটি কী?


জীবনে উৎসব আছে, আছে আনন্দ-বিনোদনও। বিভিন্ন কারণে এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব মানুষ স্বীকার করে নিয়েছে। তবে সব উৎসব ও আনন্দ-বিনোদন এক রকম নয়। মানব সমাজে অর্থহীন উৎসব ও আনন্দ-বিনোদন যেমন আছে, তেমনি আছে গভীর অর্থবোধক কিংবা ভাবব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ উৎসবও। মানুষের জীবনদর্শনগত পার্থক্যের কারণে উৎসবে ও বিনোদনে তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।
গত সোমবার বাংলাদেশের মানুষ ত্যাগের পবিত্র চেতনায় পালন করেছেন কোরবানীর ঈদ। এই ঈদের সাথে জড়িয়ে আছে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। নবী  ইবরাহিম (আঃ)কে স্বপ্নযোগে মহান আল্লাহ প্রিয় বস্তু কোরবানী করতে বললেন। ইবরাহিম (আঃ) উপলব্ধি করলেন প্রিয় সন্তান ইসমাইল (আঃ)কে কোরবানী করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি যার সর্বোচ্চ লক্ষ্য তার পক্ষে ত্যাগের এমন উদাহরণ সৃষ্টি কোনো কঠিন বিষয় নয়। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আল্লাহর ইচ্ছার কথা জেনে পুত্র ইসমাইল এবং স্ত্রী বিবি হাজেরাও কোরবানীতে একমত হয়ে গেলেন। আল্লাহর রাহে আপন সন্তানকে কোরবানী দেয়ার এমন কঠিন পরীক্ষায় একটি পরিবার যে উদাহরণ সৃষ্টি করলো তা ভাবতে গেলে ইসলামী পরিবার ব্যবস্থার দার্শনিক ভিত্তি ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অনুপম এমন উদাহরণের যে তাৎপর্য ও শিক্ষা, তা বর্তমান সময়ে আমাদের ব্যক্তি চরিত্রে এবং পারিবারিক জীবনযাপনে কতটা উপলব্ধি করা যায়? মহান স্রষ্টা তো আমাদের সৃষ্টি করে দিশাহীন অবস্থায় ছেড়ে দেননি। তিনি মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্য নবী-রাসূল তথা দিশারী পাঠিয়েছেন। পাঠিয়েছেন অভ্রান্ত জ্ঞানের উৎস ও আলোকবর্তিকা হিসেবে ঐশীগ্রন্থ আল কুরআন। জীবন সংগ্রামে এবং প্রতিদিনের কর্মপ্রবাহে আমরা যদি নবীকে মেনে চলি এবং ঐশীগ্রন্থের আলোয় পথ চলি তাহলে মাটির এই পৃথিবীতে শান্তির উদ্যান রচনা সহজ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এই সহজ বিষয়টি যেন আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। ফলে আমাদের জীবযাপন ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। আস্থার সংকটে জীবন ও সমাজ সন্দেহ ও সংশয়ে ক্লিষ্ট হচ্ছে। এমন সমাজ তো  মানুষের উপযোগী হতে পারে না। অনুপযোগী এমন সমাজে মানুষের জীবনযাপনকে এক ধরনের আযাব হিসেবেই বিবেচনা করতে হয়। আযাবের এমন জীবন থেকে তো আমরা মুক্তি চাই। কিন্তু কীভাবে? বিভ্রান্ত মানুষকে এমন পরিস্থিতিতে পথ চলার পাথেয় দেয় আসমানি কিতাব। ঈমানকে দৃঢ় করে কিতাবের জ্ঞানে পুষ্ট হয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারলে এ পৃথিবী আবার মানুষের অনাবিল হাসিতে ভরে উঠতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, শুধু অবিশ্বাসীরাই নয়, তথাকথিত কিছু আধুনিক মুসলিমও এখন কুতর্ককেই জ্ঞানচর্চা বলে বিবেচনা করছেন। মানবসভ্যাতার উত্থান ও নিপর্যয়ের ইতিহাস পাঠে তাদের তেমন আগ্রহ নেই। সত্যনিষ্ঠভাবে উত্থান ও পতনের কারণগুলো বিবেচনা করতেও তারা রাজি নন। মানব জাতির বর্তমান ট্রাজেডির মূল কারণটা এখানেই নিহিত রয়েছে।
বর্তমান সময়ে অনেকেই মানবতা নিয়ে কথা বলেন, কথা বলেন, প্রাণীজগত ও জীববৈচিত্র্য নিয়েও। এসব প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তারা ইসলামের কিছু বিষয়কে সমালোচনা করে থাকেন। বিদগ্ধজনের মতোই তারা কথা বলতে চেষ্টা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে কোরবানীর উৎসবকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তারা বেশ অজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। নাহলে তারা কেমন করে কোরবানী ঈদের মতো ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বিশেষ তাৎপর্যম-িত মহিমান্বিত একটি উৎসবকে নৃশংস-উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করতে চান? আমরা জানি কোরবানী ঈদের দৃশ্যমান মূল বিষয়টি হলো ‘পশু জবাই।’ তথাকথিত বিদগ্ধজনরা এই পশু কোরবানীতে নৃশংসতার চিত্র খুঁজে পান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পশু জবাই কি শুধু মুসলমানদের কোরবানী ঈদেই হয়? নাকি বছরের প্রতিটি দিনেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সব সমাজেই পশু জবাই হয়ে থাকে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি, কোরবানী ঈদের সময় ছাড়াও বছরের প্রায় সবদিনই আমাদের এই জনপদে পশু জবাই হয়ে যাচ্ছে। এতে কিন্তু পশুর বংশ নির্বংশ হয়ে যাচ্ছে না। বরং পশু থেকে মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে, পশুর চামড়া, শিং ও হাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু শিল্প, যা আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সাহায্য করছে। আর কোরবানী ঈদের কারণে আমাদের দেশে পশু পালন ও রক্ষণাবেক্ষণকে কেন্দ্র করে সারা বছরই বহু মানুষ এই খাতে কর্মতৎপর রয়েছে। এক কথায় কোরবানী ঈদ, আমাদের অর্থনীতি ও সমাজের জন্য এক বড় আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রসঙ্গত এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, বাংলাদেশের হতদরিদ্র নাগরিকরা সারা বছর গোশত খেতে না পারলেও কোরবানী ঈদে ধর্মীয় চেতনাসমৃদ্ধ বণ্টন ব্যবস্থার সুবাদে তারা শুধু গোশত খাওয়ার সুযোগই পায় না, গোশত জমা করা এবং তা বিক্রির মাধ্যমে কিছুটা অর্থকড়িও হাতে পায়। গভীর তাৎপর্যমন্ডিত এমন একটি উৎসবকে যারা নৃশংস উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করতে চান, তাদেরকে জ্ঞানপাপী ছাড়া অন্য কোনো নামে অভিহিত করা যায় কি? প্রসঙ্গত কেউ কেউ নিরামিশের গুণগান করে থাকেন। আমিষ তথা গোশত খাওয়ার বিষয়টাকে কিছুটা নৃশংস কাজ হিসেবেও কেউ কেউ মনে করে থাকেন। কেউ কেউ একথাও বলে থাকেন যে, গোশতের বদলে শাকসবজি খাওয়াটাই উত্তম। এতে পশুদের সংহার করতে হয় না। এসব জ্ঞানী ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলতে চাই, প্রাণ সংহার কি শুধু পশুদেরই হয়, শাক-সবজি কিংবা উদ্ভিদের হয় না? বিজ্ঞানের কল্যাণে তো এতদিনে আপনাদের এ বিষয়টি জানার কথা যে, পশু-পাখিদের মতো উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। আর যদি প্রাণের কথাই বিবেচনায় আনেন, তাহলে একটু অঙ্ক করে দেখুন তো-১০০ মানুষের খাদ্যের জন্য একটি গরু যথেষ্ট হলেও ওই ১০০ মানুষের খাদ্যের জন্য কত শত উদ্ভিদের প্রয়োজন হবে? একজন কোমল হৃদয়ের মানুষ শত শত উদ্ভির কর্তনে ব্যথা না পেলেও একটি পশুর কর্তনে এতবেশি ব্যথিত হবেন কোন যুক্তিতে? তাই মুসলমানদের কোরবানী উৎসবকে যারা নৃশংস-উৎসব হিসেবে প্রোপাগান্ডা চালাবার কসরত করেন, তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা কি অসঙ্গত হবে?
ভেজেটেরিয়ান ও নন-ভেজেটেরিয়ান প্রসঙ্গে প্রাণী জগতের বৈচিত্র্য সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। আমরা জানি, মানুষের কল্যাণে নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে এই পৃথিবীতে। বেঁচে থাকার জন্য তো খাদ্যের প্রয়োজন হয়। জৈবিক এই সত্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। মানুষ যেমন খায়, তেমনি বাঁচার জন্য খেতে হয় সিংহ, বাঘ এবং হরিণ, গরু ও ছাগলকেও। আমরা তো মুখ দিয়েই খাদ্য গ্রহণ করে থাকি। আর খাদ্য গ্রহণে দাঁতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সব প্রাণীর দাঁত কি একই রকম? লক্ষণীয় বিষয় হলো- গরু, ছাগল বা হরিণের দাঁত ফ্লাট বা সমান। নিরামিশ বা তৃণভোজী। এসব প্রাণীর জন্য সূচালো বা তীক্ষè দাঁতের প্রয়োজন নেই। ফ্লাট বা সমান দাঁতই যথেষ্ট। আর মাংসাশী প্রাণী সিংহ ও বাঘের দাঁত লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাদের দাঁত বেশ সূচালো। তারা কেবল প্রাণীর মাংস খায়, উদ্ভিদ নয়। আর মানুষের দাঁতের গঠন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ফ্লাট তথা সমান ও সূচালো উভয় ধরনের দাঁতই মানুষের মুখে বিদ্যমান। মানুষ যেমন শাক-সবজি বা তৃণলতা খায়, তেমনি খায় মাংসও। তাই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানুষের মুখে দু’ধরনের দাঁতেরই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এই উদাহরণ থেকে মানুষের সৃষ্টি রহস্য ও খাদ্য বৈচিত্র্য সম্পর্কে কি কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় না? এখানে অবশ্য মানুষের স্বাস্থ্যগত প্রসঙ্গ ও রুচির বৈচিত্র্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব কারণে কেউ শাক-সবজি এবং মাংস খেতে পারেন। আবার কেউ শুধু শাক-সবজি খেয়েও জীবন অতিবাহিত করতে পারেন। তাই মুসলমানদের কোরবানী উৎসব নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
কোরবানী ঈদের ছুটিতে টেলিভিশন পর্দায় চোখ রেখে থাকলে যে কোনো বিবেকবান মানুষই একটু বিস্মিত হবেন। কারণ যে কোনো অনুষ্ঠানেরই একটি থিম বা লক্ষ্য থাকে। কোরবানী ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন চ্যানেলে সপ্তাহ ধরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রায় সবগুলো অনুষ্ঠানেই যেন সতর্কভাবে কোরবানী ঈদের থিমকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এমন দৈন্যের কি কারণ থাকতে পারে? আমরা তো টিভি পর্দায় বড়দিনের অনুষ্ঠান, দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান, মে দিবসের অনুষ্ঠানসহ আরো অনেক অনুষ্ঠান দেখে থাকি। ওইসব অনুষ্ঠানে আমরা থিম বা লক্ষ্যের উচ্চারণ লক্ষ্য করি। বিষয়টি আমাদের কাছে সঙ্গত ও স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। কিন্তু মুসলমানদের ঈদ উৎসবের ক্ষেত্রে বিপরীত দৃশ্য কেন নির্মাণ করা হয়? এখানে থিমবিবর্জিত অনুষ্ঠান নির্মাণকে এক ধরনের প্রতারণা বা প্রহসন বলেই বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা।
টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ, প্রযোজক কিংবা অনুষ্ঠান নির্মাতারা একটু আত্মসমালোচনার দায়িত্ব পালন করলে ভালো হয়। আমরা মনে করি, প্রতিটি জিনিসকেই প্রকৃতির মতো স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সেটা কোরবানী, ঈদ অনুষ্ঠান বা অন্য যে কোনো কিছুই হোক না কেন। যথা বিষয়কে যথাযথভাবে তুলে ধরাই কি মানুষের মানবিক কর্তব্য নয়? নাকি মানবিকতার ভিন্ন কোনো সংজ্ঞা আছে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads