রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৪

শহীদ মিনার তুমি কার? দলের না দেশের!


গুম, খুন, অপহরণের এই দেশে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন অপরাজনীতি। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে এমনি তো জনগণের যন্ত্রণার শেষ নেই, তারওপর আবার শহীদ মিনারের নোংরা রাজনীতিÑ তা কি মেনে নেয়া যায়? দেশের হাজারো মানুষের মতো আমারও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, শহীদ মিনার তুমি কার? আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নাকি দলকানা এতিম বামপন্থীদের।
মহান প্রভুর দরবারে ড. পিয়াস করিমের জান্নাত কামনা করে কিছু কথা লেখার চেষ্টা করছি- চাওয়া-পাওয়ার এই পৃথিবীতে কার না ইচ্ছে করে দীর্ঘদিন বাঁচতে? মৃত্যু অবধারিত তাই তো অকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সমাজবিজ্ঞানী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম। রাজনীতিবিদ না হয়েও যে হাজারো মানুষের মনের গহীনে স্থান দখল করে নেয়া যায় তার উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করে গেছেন। তার জানাযার নামাযে উপস্থিতিই বলে দেয়- তিনি কেমন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। দেশের এই ক্রান্তিকালে ড. পিয়াস করিমের বড়ই প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু মহান প্রভুর ইচ্ছায় তিনি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন ভিন্ন এক জগতে। তার এই শূন্যতা পূরণ হবার নয়। তারপরও ড. পিয়াস করিমের দিকনির্দেশনামূলক বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা জাতির পাথেয় হয়ে থাকবে চিরকাল।
বাংলাদেশের হাজারো মানুষ ড. পিয়াস করিমকে যেভাবে চিনত, আমিও সেভাবেই চিনতাম। তার সাথে সরাসরি কথা বলার খুবই ইচ্ছে আমার ছিলো, কিন্তু সময়ের অভাবে আর সে সুযোগ হয়নি। তবে টেলিভিশনের টকশোর মাধ্যমেই আমি তাকে চিনতাম। তার বাচনভঙ্গি, সুন্দর করে কথা বলার স্টাইল আর নির্ভয়ে সত্য ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরা আমাকে মুগ্ধ করতো। তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ করতো- দেশপ্রেম আর গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনামূলক জ্ঞান-গর্ব আলোচনা। গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকরা যে কোনো মত ও পথের বিশ্বাসী-অনুসারী হবে- এটাই তো স্বাভাবিক। ড. পিয়াস করিম কী গণতন্ত্রের বিপক্ষে কোনো ভূমিকা পালন করেছিলেন? যদি না-ই করে থাকেন, তাহলে কেন এরকম হলো ড. পিয়াস করিমের লাশ নিয়ে। কী অপরাধ ছিলো তার? সেই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই। তবে লীগ সরকারের কাছে আছে বলেই তার লাশকে শহীদ মিনারে নিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। ১৬ কোটি মানুষের ট্যাক্সের টাকা ব্যয় করে নির্মিত শহীদ মিনার কি শুধু বামপন্থী, আওয়ামীপন্থী আর ঘাদানিকদের নাকি এদেশের জনগণের। সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই রাষ্ট্রকে দিতে হবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্তম্ভের সাথে জড়িত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ১৬ কোটি মানুষের আবেগ। ৫২’র ভাষার জন্য যারা নিজের জীবনের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছিলেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যেই এই শহীদ মিনার। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই হৃদয়ে শহীদ মিনারের ভাবগাম্ভীর্য ধারণ করে আসছেন। বাংলাদেশের মানুষের আবেগের স্মৃতিস্তম্ভ শহীদ মিনার চত্বর কি কারো বাপ-দাদার তালুক নাকি ব্যক্তিগোষ্ঠীর নিজস্ব সম্পত্তি? ক্যাম্পাসের ভেতরে অবস্থান হওয়ায় রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র শহীদ মিনারের যেদখভালের দায়িত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু শহীদ মিনারে কারা যেতে পারবেন আর কারা যেতে পারবেন না, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কি শুধু তাদের? সেই প্রশ্নের উত্তরটাও একদিন না একদিন দেয়া লাগতে পারে। আজ আমার, তো কাল তোমার।
দেশের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে এই শহীদ মিনারের চত্বরে যাওয়ার। কিন্তু সংস্কৃতিচর্চা আর রাজনৈতিক প্রভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরকে যারা নিজেদের ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন তাদের খেয়ালখুশি মতোই কি নিয়ন্ত্রিত হবে? ১৬ কোটি মানুষের আবেগের এই শহীদ মিনারকে কি লীগ সরকারের নিকট ইজারা দেয়া হয়েছে? শহীদ মিনারের এই দখলদারিত্ব মুক্ত করতে হবে। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র আশ্বিন- এই চার মাসে যেমন এক বছর হয় না, তেমনিভাবে সারা জীবন কেউ ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করতে পারে না। মৃত্যু পথের যাত্রী আমরা সবাই। মরণের পরে আমাদের সবার মোহনা তো একটিই হবে। তাহলে কেন এত হিংসার রাজনীতি। আমরা কী পারি না একটু সহানুভূতি দেখাতে? সর্বস্তরের মানুষ যেন ড. পিয়াস করিমকে শেষবারের মতো দেখতে এবং তার প্রতি সম্মান দেখাতে পারেন সেজন্য সুশীলসমাজের পক্ষ থেকে লাশ শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখার কর্মসূচি দিয়েছিলো। কিন্তু বাধা হয়ে বসেছে লীগ সরকারের অনুসারীরা। তাদের বাড়াভাতে ছাই দিতেন পিয়াস করিম। তাদের ভাষায়- পিয়াস করিম পাকিস্তানী রাজনীতির অনুসারী, জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী। শহীদ মিনারে লাশ নেয়া হলে ভাষার মিনারকে অপবিত্র করা হবে। প্রশ্ন হলো, যারা এসব করছেন তারা কি পিয়াস করিমের রাজনৈতিক পরিচয় জানেন? পবিত্র আর অপবিত্র কীসে হয়, সেটা কি তারা বোঝেন? শহীদ মিনারের জন্ম দেয়া ভাষা মতিনের যখন তথাকথিত প্রটোকলের অজুহাতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়া না, তখন কি শহীদ মিনারকে অসম্মান করা হয়নি? তারা শুধু যে ড. পিয়াস করিমকে নিয়ে রাজনীতি করেছেন তা কিন্তু নয়, অতীতে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা মরহুম অলি আহাদের লাশ আনা ও রাখাকে নিয়েও একই মহল অপরাজনীতি করেছিলো। এর কারণ হচ্ছে অলি আহাদ আওয়ামী লীগবিরোধী ছিলেন। দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বরেণ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক, পত্রিকার সম্পাদক, কলামিস্ট ও আইনজীবীসহ বিশিষ্টজনদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে লীগ সরকারের মাস্তানরা। তাদের নিয়ে অশ্লীল ভাষায় কটূক্তি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি লীগ সরকারের অনুসারীরা। অবাঞ্ছিতদের তালিকায় রয়েছেন- কলামিস্ট ও টিভি টকশোর পরিচিত মুখ ড. মাহফুজ উল্লাহ, কবি ফরহাদ মজহার, ইংরেজি দৈনিক নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবির, দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, প্রফেসর ড. আমেনা মহসিন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মর্তুজা ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. তুহিন মালিক। লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলবেন, তাদেরই নাম ওঠবে রাজাকারের খাতায়- ধিক-শতধিক ঐসব জ্ঞানপাপীদের যারা সমাজের সর্বশ্রদ্ধেয় জাতির বিবেকবান মানুষকে খাটো করে প্রতিহিংসার রাজনীতি চর্চা করেন। পরিশেষে এতটুকু কথা লিখেই শেষ করতে চাই- লীগ সরকার ক্ষমতার দম্ভে ড. পিয়াস করিমের লাশকে শহীদ মিনারে নিয়ে যেতে বাধা দিয়েছে। ড. পিয়াস করিমের লাশ বিএনপি শহীদ মিনারের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে আমার মতে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে স্বয়ং মরহুম ড. পিয়াস করিমকে পছন্দ করেছেন বলেই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টির হাত থেকে তার লাশকে রক্ষা করেছেন।
মোঃ তোফাজ্জল বিন আমীন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads