মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৪

ফের ভর্তি হবেন শিক্ষামন্ত্রী?


কিছুকাল আগে ঝগড়াটে স্বভাবের শিক্ষামন্ত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি বাহাস হয়ে গেলো। পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে, পরীক্ষকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে শিক্ষামন্ত্রী এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ ও গোল্ডেন জিপিএ’র বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। ক্লাস রুমে কী পড়াশুনা হচ্ছে বা হচ্ছে না, শ্রেণীকক্ষে কী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, কারা সে শিক্ষা দিচ্ছেন, প্রকৃত মেধাবীরা শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন কিনা-সেটি শিক্ষামন্ত্রী বা সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়নি। তারা পরীক্ষকদের ঢালাওভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যে, খাতায় লিখুক বা না লিখুক, ভুল-শুদ্ধ যাই লিখুক, শিক্ষার্থীরা টেনেটুনে ২৮ নম্বর পেলে, তাকে ৩৩ পাইয়ে পাস করিয়ে দিতে হবে। আর কোনো ছাত্র যদি ফেল করে তাহলে ক্লাসরুম শিক্ষককে নয়, জবাবদিহি করতে হবে পরীক্ষককে।
এরকম একটি আত্মঘাতী, শিক্ষাঘাতী, ভবিষ্যত প্রজন্মঘাতী বিধি-বিধানের মধ্য দিয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে আনা হয়েছে। জিপিএ-৫, গোল্ডেন জিপিএ এবার লাখের ঘর ছাড়িয়ে গেছে। পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সরকার বলেছে, ভবিষ্যতে শতভাগ শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে আনা হবে। সে সংবাদ আরও উদ্বেগের। শুধুমাত্র পাসই যে প্রকৃত শিক্ষার মাপকাঠি নয়, সেটি উপলব্ধি করার ক্ষমতা এই সরকারের মধ্যে কারও আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু বেশি সংখ্যায় শিক্ষার্থী পাস করেছে এর ভেতরে বিরাট গৌরব দেখতে শুরু করেছে সরকার, বিশেষভাবে শিক্ষামন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত যেমন, সমালোচনা শুনলেই- রাবিস, স্টুপিড বলে গালিগালাচ করতে শুরু করেন, তেমনি নব্য আওয়ামী লীগার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও কান্ডজ্ঞান হারিয়ে বসেন। ভাবখানা এমন এত ছাত্র পাস করিয়ে আনলাম, তারপরে আবার মানের প্রশ্ন কেনো। যেনো পরীক্ষায় পাসের একটা সার্টিফিকেটই জীবনের প্রধান নিয়ামক। বাংলাদেশে এখন অভিযোগ আছে যে, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থের বিনিময়ে উচ্চ শিক্ষার সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। কিন্তু সেইসব সার্টিফিকেটধারী কর্মক্ষেত্রে কি দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করতে পারবে? সেটি বলতে গেলে একেবারে অসম্ভব। প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, দেদারছে নকল হচ্ছে, শতকরা হিসাবে ছাত্ররা প্রায় শতভাগ পাস করছে-তাতে জাতির কী কল্যাণ হয়েছে, সেদিকে কেউই মনোযোগ দিচ্ছে না।
কিন্তু এর একটি বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেলো সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে। হাজারে হাজারে জিপিএ-৫ধারী এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো। কিন্তু প্রতিযোগিতা থেকে তারা অনেক দূরে ছিটকে পড়ে গেছে। ইংরেজী বিষয়ে পাস মার্কস পেয়েছে মাত্র দুইজন ছাত্র। আসন সংখ্যা ছিলো ১৩৫। যদি ৩০০ ছাত্র পাস মার্কস পেতো তাহলে তাদের মধ্য থেকে মেধাক্রম অনুযায়ী ১৩৫জনকে ভর্তি করা হতো। বাকিরা বাইরেই থাকতো। কিন্তু দু’জন পাস করায় বিপাকে পড়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এখন পাসের শর্ত শিথিল করে তাদের ছাত্র ভর্তি করতে হবে।
এ নিয়ে সমাজে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদেরা এসএসসি ও এইচএসসি লেভেলে পাঠদান বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। ভর্তি পরীক্ষায় এই ফলাফলের অর্থ দাঁড়ায়, ক্লাসরুম পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষার উপর তেমন কোনো গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না। ফলে জিরোকে হিরো বানাবার প্রচেষ্টা হিসেবে শিক্ষার্থীদের অধিক মেধাবী বলে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তাতে আখেরে যে কোনো লাভ হয় না, সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো।
ভর্তি পরীক্ষার এই ফলাফল নিয়ে যখন সমাজের ভেতরে তোলপাড়, শিক্ষাবিদ মহলে সমালোচনা, তখন শিক্ষামন্ত্রী রাগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভ্রান্ত ভর্তি নীতির কারণে ভর্তি পরীক্ষায় এমন বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদের বক্তব্য ছিলো ভর্তি পরীক্ষার প্রয়োজন কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গ্রেড অনুযায়ী ছাত্র ভর্তি করে নিলেই তো পারতো। অর্থাৎ শিক্ষামন্ত্রীর বাজে মালের কারখানায় যা উৎপাদিত হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করে জাতির বারোটা বাজাক। সে বারোটা বোধকরি অনেক আগে বেজেও গিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছেন যে, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা এই পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন। এবং ভর্তি পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন করা হয়, তার সবই পাঠ্যপুস্তক ভিত্তিক। কোনো শিক্ষার্থী যদি পাঠ্যপুস্তক যথাযথভাবে পড়ে, তাহলে তার জন্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মোটেও কঠিন ব্যাপার নয়। আমরাও তো এসএসসি, এইচএসসি লেভেলে সেভাবেই পড়াশুনা করেছি। পাঠ্য বইয়ে যা কিছু আছে, তার সব কিছুই মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। শিক্ষকরাও কখনও পরীক্ষায় কী আসবে, না আসবে, সেদিকে না তাকিয়ে পাঠ্যপুস্তকে কী আছে, সেদিকেই অধিক মনোযোগ দিয়েছেন। তাদের ঐকান্তিক যতেœ পাঠ্যপুস্তকের বিষয়াদি আমরা উপেক্ষা করতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি পাঠ্যপুস্তককে ভিত্তি ধরে থাকেন, তাহলে দোষের কী আছে, বোঝা গেলো না।
পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ইংরেজী চিঠির ড্রাফট করতে বাইরে থেকে ইংরেজি জানা লোক হায়ার করে অনতে হয়। সেটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সম্মানজনক নয়। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের বিলুপ্তি অনিবার্য। এ থেকে আর একটি জিনিস বোঝা যায় যে, শিক্ষার মানের পতন একদিনে ঘটেনি। অনেক আগে থেকেই আমাদের এ অধঃপতন শুরু হয়েছে। তার উপরে দলীয়করণের মনোবৃত্তিতে মেধাবীদের সরকারি চাকরির সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। ফলে একশ্রেণীর মেধাহীনের দল, এখন প্রশাসনে জাকিয়ে বসেছে। আর তারই পরিণতিতে ইংরেজী জানা লোক হায়ার করতে হচ্ছে।
শিক্ষাবিদ মহলে এ নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হলো। যখন প্রশ্ন উঠলো যে, এসএসসি ও এইচএসসি পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মান নেমে গেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে, এতে বাকোয়াজ শিক্ষামন্ত্রী একেবারে তিরিং-বিরিং করে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, শিক্ষার মান অনেক উন্নত হয়েছে। আগে শিক্ষার কোনো মানই ছিলো না।
নাহিদ সাহেব কোন মানের শিক্ষার্থী ছিলেন, কোন শিক্ষকের কাছে পাঠ গ্রহণ করেছেন- সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আমরা যারা শিক্ষামন্ত্রীর সমসাময়িককালীন এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছি, তারা নিশ্চয় মন্ত্রীর ‘শিক্ষার কোনো মানই ছিলো না’ এই বক্তব্যের সাথে একমত হবেন না। আমাদের শিক্ষকেরা সে অর্থে হাত ধরে শিক্ষাদান করেছেন। আমি পড়েছি টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এলাসিন তারেক যোগেন্দ্র হাই স্কুলে। অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার পর মুখস্থ বিদ্যার বদলে কীভাবে যেকোন বিষয়ে ইংরেজীতে রচনা লেখা যায়, তার ব্যাকরণ ও শব্দ প্রয়োগ কীভাবে যথার্থ হবে, সেটি বারবার অনুশীলন করে শিক্ষকরা শিখিয়েছেন। মানই যদি না থাকতো, তাহলে আমরা দেশ-বিদেশে লেখাপড়া করতে পারতাম না। অবিরাম খাবি খেতে খেতে কোথায়ও হারিয়ে যেতাম।
তবে কোথায়ও কোথায়ও যে মান ছিলো না, সেটা শিক্ষামন্ত্রীর কথা থেকে বোঝা যায়। তখনও ভালো স্কুল, খারাপ স্কুল ছিলো, ভালো ছাত্র, খারাপ ছাত্র ছিলো। শিক্ষামন্ত্রী সম্ভবত সে শেষোক্তদের দলে ছিলেন। মানসম্পন্ন লেখাপড়া তিনি করতে পারেননি। তাতে দোষের কিছু নেই। আবার গৌরব করারও কিছু নেই। শিক্ষামন্ত্রী সম্ভবত তেমন কোনো মানহীন শিক্ষার ভেতর দিয়েই বেরিয়ে এসেছেন। তার যাবতীয় আচরণে সে কথাই প্রমাণিত হয়।
শিক্ষামন্ত্রীর এ ধরনের উক্তিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ফেসবুকে কেউ কেউ লিখেছেন, আগে তো শিক্ষার কোনো মান ছিলো না, এখন যেহেতু শিক্ষামন্ত্রীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চাুল হয়েছে, অতএব শিক্ষামন্ত্রীর উচিত মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য আর একবার স্কুল, কলেজ পেরিয়ে শিক্ষা গ্রহণ নেওয়া। এ নিয়ে অনেকে অনেক রসালো মন্তব্যও করেছেন। কিন্তু শিক্ষার বারোটা বাজাবার জন্য এই মন্ত্রী যে কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন। তার খেসারত জাতিকে দীর্ঘদিন ধরে দিতে হবে।
সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত পাঠ্য বইয়ে শিক্ষার যাবতীয় সর্বনাশা আয়োজন সম্পন্ন করেছে। এই গোটা পর্যায়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম বিশ্বাস ভূলুণ্ঠিত। ফলে দেশাত্ববোধ, আত্মমর্যাদা, আত্মঅনুসন্ধান সবকিছুই তিরোহিত হয়ে গেছে। ইতিহাসের ভ্রান্ত বা খ-িত রূপ জানতে পারছে শিক্ষার্থীরা। যেসব মনীষীরা ছাত্রদের জন্য আদর্শ হয়ে উঠতে পারতেন, প্রেরণার উৎস হয়ে উঠতে পারতেন, মুছে দেওয়া হয়েছে তাদের নাম। যে ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, সে সংগ্রামের ইতিহাসও জানতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। সরকারের কূকীর্তির এটাও অংশ। আর সে কারণেই সমাজের ভেতরে মূল্যবোধের অবক্ষয়। আমরা শিকড়হীন ভাসা পানির মতো অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছি। সমাজের শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে ভবিষ্যত প্রজন্ম ও দেশের স্বার্থে এই গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads