শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

খবর নেই সেই বিশেষজনের


কে সেই বিশেষজন এবং কেন তার খোঁজ-খবরের জন্য এত আগ্রহ সে সম্পর্কে জানানোর আগে অতি সংক্ষেপে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সাম্প্রতিক ঢাকা সফরকেন্দ্রিক একটি বিষয়ের উল্লেখ সেরে নেয়া যাক। গত ২৯ আগস্ট মাত্র ১০ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার এ সফর অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রায় এক ঘণ্টার পৃথক বৈঠক। কারণ, খালেদা জিয়া এই সময়ে তেমন কেউ নন, যার সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পৃথক বৈঠক করতে হবে। বৈঠকে কি আলোচনা হয়েছে সে সম্পর্কে জানা গেছে বিএনপির মহাসচিবের কাছ থেকে। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, বৈঠকে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জন কেরি বলেছেন, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার এবং দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন অর্জন করবে তেমনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জন কেরি।
এখানে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, কথাটার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এ সত্যই প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার দাবি করলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না। জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। স্মরণ করা দরকার, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র বৈধতা দেয়নি। ফলে পরোক্ষভাবে হলেও বর্তমান সরকারও দেশটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ওয়াশিংটনের শীতল সম্পর্কের বিষয়টিও বিভিন্ন সময়ে জানাজানি হয়েছে। জন কেরির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জানিয়ে দেয়া মনোভাব ও অবস্থানের মূল কথা অনুধাবন করে সরকার সে অনুযায়ী সব দলকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের পথে পা বাড়াবে কি না তা দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
এ পর্যন্ত এসে পাঠকদের মনে হতে পারে যেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর প্রসঙ্গে লেখার জন্যই আজকের নিবন্ধটি পরিকল্পিত হয়েছে। অন্যদিকে নিবন্ধের উদ্দেশ্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য জানানো। তথ্যটি হলো, প্রধানমন্ত্রীর প্রায় সমান গুরুত্ব দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করলেও জন কেরি কিন্তু সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক দূরে থাকুক, সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেননি। রওশন এরশাদ অবশ্য প্রতারণামূলক কৌশলে খবরের শিরোনাম হয়েছেন। তার প্রেস সেক্রেটারির স্বাক্ষরিত বিবরণীতে জানা গেছে, জন কেরির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রওশন এরশাদ নাকি নারীর উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আসল সত্য জানাজানি হয়েছে পরদিনই। অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকদের বদৌলতে জানা গেছে, ধানমন্ডির একটি মিলনায়তনে জন কেরি গিয়েছিলেন সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য। নিজে ‘সুশীলা’ না হলেও সেখানে রওশন এরশাদও গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। সভাশেষে জন কেরি যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে রওশন নিজের পরিচয় দিয়ে ‘কেমন আছেন’ ধরনের দু-একটি কথা বলার চেষ্টা করেছেন। এটুকুকেই তিনি তার প্রেস সেক্রেটারিকে দিয়ে  বৈঠকের খবর বানিয়ে ছেড়েছেন! বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতুক-তামাশা কম হয়নি।
হঠাৎ রওশন এরশাদকে টেনে আনার পেছনে কারণ সৃষ্টি করেছেন আসলে তার স্বামী, সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং এখনো জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বেশ কিছুদিন ধরে তার কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। অথচ সুযোগ বা উপলক্ষ পেলে সরকারকে তো বটেই, তিনি এমনকি নিজের স্ত্রী এবং এককালের ‘ফার্স্ট লেডি’ রওশন এরশাদকেও আক্রমণ করতে ছাড়েন না। নানা কারণেই সাবেক এ স্বৈরশাসককে সাধারণভাবে একটি ‘ফানি ক্যারেক্টার’ হিসেবে তুলে ধরার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টিতে আমার কিন্তু ভিন্নমত রয়েছে। কারণ, ঘটনাক্রমে কখনো কখনো কৌতুক অভিনেতার মতো কাজকর্ম করলেও বাস্তবে এ এরশাদই ভারতীয়করণ থেকে সেনাবাহিনীকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বানানো পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ‘অবদান’ রেখে গেছেন। পরবর্তীকালে জেনারেল (অব.) মইন উ তাকে অনুসরণ করেছেন মাত্র। সে ব্যাপারেও এরশাদের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ।
কথাটা আমাদের নয়, বিভিন্ন সময়ে এ সম্পর্কে জানান দিয়েছেন স্বয়ং এরশাদ। যেমন গত ১২ এপ্রিল দলীয় এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ জানাতে গিয়ে বলেছেন, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে অর্থাৎ জনাব এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানানো হবে মর্মে চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিতে জাতীয় পার্টিকে আনুপাতিক হারে মন্ত্রিত্ব দেয়ারও শর্ত ছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ জাপার সঙ্গে ওয়াদা বরখেলাপ করে। এ পর্যন্ত এসেই থেমে যাননি সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। অন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও উল্লেখ করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘আমাদের কারণেই ওয়ান-ইলেভেন হয়েছিল’। অর্থাৎ এরশাদ এবং (আওয়ামী লীগসহ) তার অন্য সঙ্গীরাই ওয়ান-ইলেভেন ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রতারণা করায় তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। এরশাদ প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, ‘আমি ডার্টি পলিটিক্স (নোংরা রাজনীতি) করি না। যেটা সত্য তা-ই বলি। সেটা অপ্রিয় হলেও বলি, প্রিয় হলেও বলি।’
বলা দরকার, যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হলেও জনাব এরশাদের এসব বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিন্তু তেমন আলোড়ন ওঠেনি। কারণ, তিনি আসলে নতুন কোনো কথাই বলেননি। শুধু একটি কথা নিয়ে অবশ্য বিশেষ কারণে কিছুটা আলোচনা হয়েছে। সে কথাটা হলো, ‘আমাদের কারণেই ওয়ান-ইলেভেন হয়েছিল’। এটা সত্য হলে ২০০৬ সালের অক্টোবরে সংঘটিত লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের দায়দায়িত্বও এরশাদদের ওপরই বর্তায়। আর সাবেক এ জেনারেল যেহেতু ‘ডার্টি পলিটিক্স’ করেন না এবং অপ্রিয় হলেও সত্য কথাই বলেন সেহেতু আওয়ামী লীগের পক্ষেও দায় এড়ানোর সুযোগ থাকতে পারে না।
এটা খুবই গভীর একটি বিষয় বলেই এখানে বরং এরশাদ-বর্ণিত সেই চুক্তি বা সমঝোতার ব্যাপারে কিছু তথ্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। বস্তুত মিথ্যাচারের কারণে যতো অভিযোগই তার বিরুদ্ধে থেকে থাকুক না কেন, এই একটি বিষয়ে তিনি সত্য বলেছেন। কারণ, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছিল ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। ঘটনাস্থল ছিল লন্ডন। এ ব্যাপারে এরশাদ নিজেই ঘোষণা দিয়েছিলেন লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর। সে সময়ও গুঞ্জনে শোনা গিয়েছিল, শেখ হাসিনার সঙ্গে লন্ডনে এরশাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ছাড়াও জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় ফিরে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে তিনি ‘বোন’ ডেকেছেন। এরশাদ একই সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, আওয়ামী মহাজোট বিজয়ী হলে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। রাষ্ট্রপতি বানানোর শর্তেই জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন এরশাদ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে এরশাদ বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হতে ‘প্রস্তুত’ আছেন!
এরশাদের বিভিন্ন বক্তব্য ও ঘোষণা সে সময় ১৪ দলীয় জোটে তীব্র টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছিল। বাম দলগুলো ১৪ দলে না থাকার হুমকি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ অবশ্য প্রথম থেকেই কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এরশাদকে ‘কোনোক্রমেই’ বাদ দেয়া সম্ভব নয়। এমন এক কঠোর অবস্থান থেকেই ১৪ দলকে ‘অটুট’ রেখে জোটের সম্প্রসারণ করার অর্থাৎ একই সঙ্গে ১৪ দল এবং আওয়ামী মহাজোট নিয়ে তৎপরতা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। দুটিরই নেতৃত্ব গিয়েছিল আওয়ামী লীগের দখলে।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এভাবেই এক বিচিত্র কৌশল নিয়ে এগিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে যুক্তি দেখাতে গিয়ে দলটির সভাপতি মন্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘বড় অপরাধীর’ বিরুদ্ধে ‘ছোট অপরাধীকে’ সঙ্গে নেয়ায় দোষের কিছু থাকতে পারে না। এক প্রশ্নের জবাবে আবদুর রাজ্জাক ‘বড় অপরাধী’ বিএনপির তুলনায়  স্বৈরশাসক এরশাদকে ‘ছোট অপরাধী’ বানিয়ে ছেড়েছিলেন। অর্থাৎ বিএনপিকে নির্বাচনে হারানোর লক্ষ্য নিয়ে দলটি এরশাদের সঙ্গে ঐক্য করেছিল। সে সময় একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের টকশোতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, জাতীয় পার্টিকে মহাজোটে নেয়ার বিষয়টি নাকি ‘ভোটের বোঝাপড়া’- এটা আদর্শগত কোনো জোট নয়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাওয়াটাই ছিল বড়কথা। ‘হর্স ট্রেডিং’ বা দর-কষাকষি কাকে বলে, সে কথা আওয়ামী লীগের ‘ঝানু’ নেতাদের শিখিয়ে ছেড়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। জাতীয় পার্টির জন্য আওয়ামী লীগকে ৫০টি আসন ছাড়তে হয়েছিল। এরশাদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করেছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতারা রাখ-ঢাক না রেখে বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় যেতে চান। আর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ তৎকালীন চারদলীয় জোটকে নির্বাচনে হারাতে হলে এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ অনেকভাবেই করে দেখেছিলেন তারা। ১/১১-এর পর কিছুদিন পর্যন্ত মনে হয়েছিল যেন দমন-নির্যাতনে দুর্বল হয়ে পড়েছে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে আসার পাশাপাশি দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেখানে মইন-ফখরুদ্দিনদের ‘নিয়ে আসা’সহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছিল, বিএনপি সেখানে ছিল সুবিধাজনক অবস্থানে। বিএনপিতে ভাঙন ঘটানোর এবং বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে জোট থেকে বের করে আনার কোনো চেষ্টা ও পরিকল্পনাও সফল হয়নি। ঘটনাপ্রবাহে চারদলীয় জোট বরং আরো ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছিল। সে কারণে আওয়ামী লীগকে শুধু নয়, বিএনপি বিরোধী অন্য সকল পক্ষকেও নতুন করে হিসাব মেলাতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি। এর কারণ, নির্বাচনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গী অন্য দলগুলোর তুলনায় জাপা ছিল বেশি সম্ভাবনাময় একটি দল। সে সময় পর্যন্ত সর্বশেষ তথা অষ্টম সংসদেও জাতীয় পার্টির ১৪ জন এমপি ছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যে দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট করেছিল একমাত্র রাশেদ খান মেনন ছাড়া সে দলগুলোর প্রধান নেতারাও কখনো নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেননি।
ঘটনাপ্রবাহের ওই পর্যায়ে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা, জনপ্রিয়তা ও উদ্দেশ্যসহ নানাদিক। কারণ, ‘বড় দল’ আওয়ামী লীগ সাধারণত খুব সহজে কারো সঙ্গে হাত মেলায়নি। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে এসে সে দলটিই যখন আগ বাড়িয়ে নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তখন আর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। কথাটা কঠিন সত্যও ছিল। কারণ, ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকে চারদলীয় জোট সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ তার সমর্থনে এক পা-ও এগিয়ে অসেনি। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কথায় কথায় হরতাল চাপানো থেকে দিনের পর দিন ধরে বর্জনের মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর করে ফেলার মতো বিভিন্ন উদাহরণের ভিড়ে যাওয়ার পরিবর্তে অল্প কথায় বরং বলা যায়, বিরোধী দলের নেত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনা কোনো একটি প্রশ্নেই জনগণের স্বার্থে সামান্য ‘অবদান’ রাখার প্রমাণ দিতে পারেননি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজীরও শেখ হাসিনাই বারবার স্থাপন করেছিলেন। এভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেননি বলেই শেখ হাসিনা জনগণের আস্থা অর্জন করতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। নিজেদের তো বটেই, ‘বন্ধুরাষ্ট্র’সহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার জরিপেও দেখা গিয়ছিল, আওয়ামী লীগ অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। মূলত এই হতাশা থেকেই ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে এসে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নাম সর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে সামনে এসেছিল অন্য একটি সত্যও- আওয়ামী লীগ যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়।
এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গিয়েছিল ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বানচাল করে দেয়ার কর্মকাণ্ড থেকে। চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার চেষ্টায় ক্রমাগত ব্যর্থতার পর নির্দলীয় এবং দুর্বল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতেই কেন লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালানো হয়েছিল- এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে একটু চিন্তা করলেই আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের দিকটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারণ, নির্বাচনে অংশ নেয়ার সামান্য ইচ্ছা থাকলেও যে কারো তখন নির্বাচনমুখী কার্যক্রমেই ব্যস্ত হয়ে ওঠার উচিত ছিল। অন্যদিকে লগি-বৈঠার হত্যা ও তাণ্ডব চালানোর পাশাপাশি দাবির পর দাবি তুলে আওয়ামী লীগ এবং তার সঙ্গি-সাথীরা শুধু ঝামেলাই বাড়িয়েছিল। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করেছিল তারা পাল্লা দিয়ে। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক দিনগুলোতে এমন কোনো বড়ো দাবির কথা বলা যাবে না যা পূরণ করা হয়নি। কিন্তু অযৌক্তিক ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক প্রতিটি প্রধান দাবি পূরণ করার পরও আওয়ামী জোট ঘাড় বাঁকিয়ে রেখেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিটি উদ্যোগকেই তারা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ব্যর্থ করে দিয়েছে। জোটের পক্ষ থেকে সেই সঙ্গে বঙ্গভবন অবরোধ করার এবং বঙ্গভবনের ‘অক্সিজেন’ বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল গৃহযুদ্ধেরও ভয় দেখিয়েছিলেন। সব মিলিয়েই আওয়ামী জোটের উদ্যোগে পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের কাছেও তখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথিত পরিবেশ সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য হলে আর যা-ই হোক মানুষ হত্যার মতো নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড চালানো এবং দাবির পর দাবি তুলে ঝামেলা বাধানো হতো না। শেখ হাসিনা নিজেও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, জেনারেল মইন উ ও ড. ফখরুদ্দিনদের সরকার তাদেরই আন্দোলনের ‘ফসল’- তারাই তাদের ক্ষমতায় এনেছেন!
কিন্তু বিএনপিকে অনুসরণ করে ১৪টি দলকে নিয়ে জোট গঠন করলেও আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়নি। এজন্যই আওয়ামী লীগ এরশাদের দিকে হাত না বাড়িয়ে পারেনি। এরশাদও সুযোগ নিতে ছাড়েননি। নিজে রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছেন, জাপার জন্য আদায় করেছেন কম-বেশি ৫০টি আসনের নিশ্চয়তা। শুধু তা-ই নয়, পাছে এরশাদ বেঁকে বসেন- এই ভয়ে জাপা নেতাদের ‘সুধা সদনে’ ডেকে আনার ঝুঁকি এড়াতে আওয়ামী লীগের নেতারাই সে সময় এরশাদের ‘প্রেসিডেন্ট পার্কে’ গিয়ে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন!
কিন্তু দলটি আওয়ামী লীগ বলেই ‘চুক্তি’ অনুযায়ী এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানায়নি। আরেক ‘বৃদ্ধ’ জিল্লুর রহমানের কাছে তাকে হেরে যেতে হয়েছিল। এসব দুঃখ-বেদনা এরশাদ আরো অনেক উপলক্ষেই প্রকাশ করেছেন। যেমন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের পর আওয়ামী লীগের এমপিরা যখন জাতীয় সংসদে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বক্তব্য রাখার পাল্লা দিচ্ছিলেন তখন, ৩ মার্চ জাতীয় পার্টির এক অনুষ্ঠানে অনেকটা গোপন তথ্য ‘ফাঁস’ করে দেয়ার ঢঙে এরশাদ বলেছিলেন, সেনাবাহিনী ‘সহযোগিতা না করলে’ আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘জীবনেও’ ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। এজন্যই সেনাবাহিনীর প্রতি আওয়ামী লীগের ‘কৃতজ্ঞ’ থাকা উচিত। সেবারও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলেছিলেন এরশাদ।
বর্তমান পর্যায়ে প্রশ্ন উঠেছে অবশ্য অন্য কারণে। কে জানে, ঠিক কোন কাজে ব্যস্ত রয়েছেন তিনি, যার জন্য তার কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ের কারণ হলো, এরশাদ সাধারণত ‘অকাজ’ই বেশি করেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচারণা রয়েছে।

আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads