শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ধর্মনিরপেক্ষতার এ কেমন উদাহরণ!


প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে মানব সভ্যতায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা সংকট। তবে ভারতে গরুর গোস্ত খাওয়া নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা অবাক হওয়ার মত। ১৫ সেপ্টেম্বর এনডিটিভি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মেওয়াটে গরুর গোস্ত খাওয়ায় দুই বোনকে ধর্ষণ করা হয়। এবার পশ্চিম বাংলার সোন্ডালিয়া স্টেশনে ঘটলো আরেক নৃশংস ঘটনা। ঈদের দিন গরুর গোস্ত নিয়ে ট্রেনে ওঠায় ৩ শিশু ও ৪ মহিলাকে চলন্ত ট্রেন থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে দুই আরপিএফ জওয়ানের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন ২ শিশুসহ ৭ জন। ঘটনার প্রতিবাদে এবং দোষী রেল পুলিশের শাস্তির দাবিতে সোন্ডালিয়া স্টেশনে ট্রেন অবরোধ করে ঘণ্টা দুয়েক ধরে বিক্ষোভ পালন করে স্থানীয় বাসিন্দারা। গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে ঘটনাটি ঘটেছে পূর্ব রেলের বারাসাত-হাসনাবাদ শাখার সোন্ডালিয়া স্টেশনে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওইদিন সোন্ডালিয়া গ্রামে কোরবানির গোস্ত আনতে গিয়েছিলেন হাড়ওয়া এলাকার ৪ জন মহিলা, তাদের সঙ্গে ৩টি বাচ্চাও ছিল। গোস্ত নিয়ে ফেরার পথে তারা ওই ঘটনার শিকার হন।
আলো ঝলমলে বিজ্ঞান-মনস্ক বর্তমান সভ্যতায় শুধুমাত্র গরুর গোস্তের কারণে নারীদের ধর্ষণ করা হবে এবং চলন্ত ট্রেন থেকে নারী ও শিশুদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন লাথি মেরে ফেলে দেবে, তা কোনো বিবেকবান মানুষ কি মেনে নিতে পারবেন? কিন্তু বাস্তবতা হলো, এমন নৃশংস ও অমানবিক ঘটনা ঘটে চলেছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে। সাংবিধানিকভাবে ভারত তো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রও বটে। কিন্তু গরুর গোস্ত খাওয়া নিয়ে ভারতের মুসলিম নাগরিকদের ওপর একের পর এক যে নৃশংস ঘটনা ঘটছে, তারপরেও কি মানুষকে এ কথা মেনে নিতে হবে যে, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র? ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর ধর্মীয় কারণে যে নির্যাতন চলছে তা ভারতের সংবিধানের সুস্পষ্ট লংঘন। তাই ভারতের মুসলমানদের সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় বর্তমান বিজেপি সরকারের ওপর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি  এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানসহ যে কোনো নাগরিকের জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান তথা সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব পালন থেকে তিনি গাফেল থাকতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে শুধু সংবিধানের কাছে নয়, ইতিহাসের কাঠগড়ায়ও তিনি দোষী বলে সাব্যস্ত হবেন।
ধর্ম তো শান্তির কথা বলে, মানবিকতার কথা বলে। ধর্মের লক্ষ্য তো হিংসা-বিদ্বেষ, দূর করে, প্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করে যথার্থ মানব পরিগঠন এবং পরিণতিতে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিভিন্ন সমাজে এর ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুবাদী সংগঠনগুলো গরু জবাই নিষিদ্ধ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছে। তবে গত বছরের (২০১৫) মে মাসে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে গরু রক্ষা আন্দোলন আরো জোরদার হয়েছে। তখন থেকে এ পর্যন্ত ভারতের কয়েকটি রাজ্যে গরু জবাই ও গোস্ত বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
আমরা সবাই তো এ কথা জানি যে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। এ পৃথিবীর মানুষ আমিষ ও নিরামিষ উভয় প্রকার খাদ্যই খেয়ে আসছে মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই। আর আমরা এ কথাও জানি যে, আমিষের উৎস পশু ও মৎস্য এবং নিরামিষ খাদ্যের উৎস তরুলতা-বৃক্ষ। এবং আমরা এ কথাও জানি যে পশু ও মৎস্যের মত তরুলতা-বৃক্ষেরও জীবন আছে। তাই প্রশ্ন জাগে, আমিষের উৎস পশু জবাই-এর ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হচ্ছে কেন? এই বাধা কি মানবিক চেতনা কিংবা ধর্মীয় নির্দেশনার কারণে? ভারতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ধর্মীয় ভাবনার কারণে মুসলমানদের গরু জবাইতে বাধা দেয়া হচ্ছে। তাহলে তো আমাদের ধর্মের কাছেই ফিরে যেতে হয়। আসলেই কি গরু জবাইতে ধর্মের বাধা নিষেধ আছে? প্রকৃত ব্যাপার হলো, হিন্দু ধর্মের গ্রন্থগুলো আমিষ তথা মাংস ভক্ষণের অনুমতি দেয়। ধর্মগ্রন্থসমূহে উল্লেখ আছে যে, হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরা, আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতেন। হিন্দু ধর্মের আইনের গ্রন্থ মনুশ্রুতি’র ৫ম অধ্যায়ে ৩০ নং শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে- “খাবার গ্রহণকারী সে সব পশুর মাংসই খায় যা খাওয়া যায়, তবে এতে সে কোনো মন্দ কিছু করে না। এমন কি সে যদি এটা দিনের পর দিনও করে যায়; কেননা ঈশ্বরই কতককে ভক্ষিত হওয়ার জন্য এবং কতককে ভক্ষক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।” মনুশ্রুতি’র একই অধ্যায়ে ৩১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে “উৎসর্গের শুদ্ধতার জন্য মাংস ভক্ষণ যথার্থ, এটা ঈশ্বরের বিধান হিসেবে প্রচলিত।” এছাড়া মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ৮৮ নং অধ্যায়েও শ্রাদ্ধের সময় গরুর মাংস পরিবেশনের কথা বলা হয়েছে। উদ্ধৃতির সংখ্যা আরো বাড়ানো যেতে পারে, তবে এর বোধহয় আর প্রয়োজন নেই। আসলে আমিষ ও নিরামিষ উভয় জাতীয় খাদ্যই মানুষের জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ। মানুষ তার রুচি-অভিরুচিও প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করবে। ধর্ম এখানে অযৌক্তিক কোনো বাদ সাধেনি। খাদ্য নিয়ে বিভিন্ন সময় যে বিতর্ক বা বিতন্ডা বিভিন্ন জায়গায় সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পেছনে মদদ জুগিয়েছে মতলববাজ কিছু সমাজপতি, ধর্মগুরু ও রাজনীতিবিদ। এদের ব্যাপারে মানুষের সতর্ক থাকা প্রয়োজন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সামাজিক দায়িত্ব পালনও মানবিক কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ভারতের গুজরাটে মুসলমানদের গরুর গোস্ত খাওয়ার বিরুদ্ধে কুরআনের অপব্যাখ্যা দিয়ে যে বিলবোর্ড টানানো হয়েছে তা মোটেও ধর্মসম্মত কাজ হয়নি। কারণ হিন্দু ধর্মের আইনের গ্রন্থ মনুশ্রুতিতেও পশুর মাংস খাওয়ার পক্ষেই কথা বলা হয়েছে। আসলে ওইসব বিলবোর্ড বা প্রচারণা অনাকাক্সিক্ষত সাম্প্রদায়িক চেতনা কিংবা রাজনীতির মন্দ মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত হতে পারে। আমরা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি আহ্বান জানাবো- ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে ধর্মের বিধিবিধান জেনে শুনেই ধর্ম পালন করুন। ধর্ম জ্ঞান অর্জনের কথা বলে, জ্ঞানের আলো না থাকলে ধর্মের আলো পাওয়া যায় না। অতীতে অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে মতলববাজ সমাজপতি, ধর্মগুরু ও রাজনীতিবিদরা মানব সমাজের অনেক ক্ষতি করেছেন। এই সুযোগ আর তাদের দেওয়া যায় না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads