শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

বান কি মুনের উপলব্ধি এবং আহ্বান


বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মানুষের জীবনে যে সুখ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারতো, তা হয়নি। বরং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহারে মানব জাতির বৃহত্তর অংশ এখন শোষিত-বঞ্চিত এবং বিপর্যস্ত। ভারসাম্যহীন এই বিশ্বে এখন দাপুটে কয়েকটি রাষ্ট্রের হুমকি-ধমকিতে বাকি রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অকার্যকর হয়ে উঠেছে। অনাকাক্সিক্ষত এমন বিশ্বব্যবস্থায় জাতিসংঘের ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা পালনের কথা ছিল। কিন্তু তেমন ভূমিকা পালনে জাতিসংঘ সমর্থ হয়নি। এমন ব্যর্থতার কারণ জাতিসংঘের গঠন-কাঠামো এবং বিধি-বিধানের মধ্যেই নিহিত। ফলে জাতিসংঘ তার সমীহ ও মর্যাদা সবই হারিয়ে বসে আছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো শুধু ভুক্তভোগি সংক্ষুব্ধ মানুষ নয়, জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুনও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘গুটি কয়েক ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের হাতেই আমাদের এই সমগ্র বিশ্ব জিম্মি থাকবে কিনা?’ বিভিন্ন দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেছেন, ‘সমালোচনাকারীদের বন্দী করবেন না। তাদের নির্যাতন করবেন না।’ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গত ২০ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ ভাষণে মুন এসব কথা বলেন। ডেইলি ন্যাশন পরিবেশিত খবরে বলা হয়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সর্বময় ক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে জাতিসংঘের সংস্কার প্রশ্নটি জোরালোভাবে সামনে এনেছেন মুন। তাঁর মতে, এই সংস্থার ক্ষমতা গুটিকয়েক রাষ্ট্রের হাতে কুক্ষিগত থাকায় গোটাবিশ্ব ওই কয়েকটি রাষ্ট্রের হাতে জিম্মি। বিশ্বের সবদেশের সম্মতিই যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। মুনের মতে, জাতিসংঘের স্বচ্ছ ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। পরবর্তী মহাসচিবকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। নিরাপত্তা পরিষদের সর্বময় ক্ষমতাকে ইঙ্গিত করে বান কি মুন বলেন, ‘প্রায়শই আমি দেখেছি যে, বিশ্বের বহু দেশের সমর্থিত কোনো প্রস্তাব সাধারণ সম্মতির নামে গুটিকয়েক রাষ্ট্র বাতিল করতে পারে। ভেটো ক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে মুন বলেন, ‘কখনো কখনো একটি রাষ্ট্রই অনেক দেশের সমর্থিত একটি প্রস্তাব বাতিল করে দিতে পারে।’ গুটিকয়েক রাষ্ট্রের সাধারণ সম্মতিকে কোনোভাবেই সর্বসম্মতি ধরে নেয়া যায় না উল্লেখ করে মুন আরো বলেন, ‘যে বিশ্বসংস্থাকে নিয়ে আমাদের এতো আশা-আকাক্সক্ষা, তা ঠিক কেমন করে পরিচালিত হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে বিশ্বের সব মানুষের। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিদায়ী ভাষণে বান কি মুন বিশ্বের সব মানুষের অধিকারের কথা বললেন। কিন্তু জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিশ্বের সব মানুষের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে কাজ করতে পারেননি। জাতিসংঘের গঠন-কাঠামো ও বিধি-বিধান তাকে সক্ষম হতে দেয়নি। ফলে বিদায় বেলায় তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি জাতিসংঘের গঠন-কাঠামো ও পরিচালনার বিষয়ে সমালোচনা করেছেন।
জাতিসংঘের স্বচ্ছ ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে সংস্কারের আহ্বানও জানিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সংস্কারের উদ্যোগ নেবে কে? জাতিসংঘের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কি এমন উদ্যোগ নেবে? এমন সুমতি তাদের হবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ পৃথিবীকে ইচ্ছেমতো শাসনের স্বাদ যারা পেয়েছেন, তা তারা নৈতিকবোধের কারণে ছেড়ে দেবেন- এমনটি তাদের কাছ থেকে আশা করা যায় না। কারণ সাম্প্রতিককালে তারা তেমন কোনো উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেননি। তাই এক্ষেত্রে গুটিকয় রাষ্ট্রের বাইরে বাকি যে রাষ্ট্রগুলো আছে তাদেরই কার্যকর ভূমিকা পালনে বুদ্ধিদীপ্ত পথে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান জাতিসংঘে সংস্কারের কাজে নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো এগিয়ে না এলে তাদের হয়তো বিকল্প সংস্থার কথাও ভাবতে হতে পারে। সেই পথে যাওয়া অবশ্যই চ্যালেঞ্জের, তবে অসম্ভব কিছু নয়। মানবজাতির কল্যাণে এই পৃথিবীকে শান্তিময় আবাসস্থলে পরিণত করতে হলে সঙ্গত ও যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প আছে কী?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads