মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

কী বার্তা দিয়ে গেলেন জন কেরি


গত ২৯ আগস্ট ’১৬ইং তারিখে বাংলাদেশে মাত্র নয় ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে এসেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সুধী সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারীরা সেসব বৈঠকে নিজ নিজ অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এসব আলোচনায় জঙ্গিবাদ যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে সুশাসনের বিষয়ও। কেরি তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রভূত উন্নতি সাধন করতে হবে। তবে একথা ঠিক যে বিশ্বে বর্তমানে নানানবিধ কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। কেরি আভাস দিয়ে গেছেন যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসদমনে সাফল্য অর্জন করতে হলে গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করতে হবে। আর অংশগ্রহণমূলক সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবার একথাও ঠিক যে, কোনো রাষ্ট্র স্বৈরতন্ত্রে থাকবে, নাকি গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে, সে সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র নিতে পারে। স্বৈরতন্ত্রের ব্যক্তির স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। আর গণতন্ত্রে নাগরিকদের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। বাংলাদেশেও শাসকদের উপলব্ধি করার দরকার আছে যে, তাদের গণতন্ত্রের পথেই ফিরতে হবে। আর তা করতে হবে খুব শীগগীরই।
বাংলাদেশে সরকার -অনুগত মিডিয়া ও তাদের চোঙ্গাবাজ পন্ডিতরা যেভাবে সর্বক্ষেত্রে সরকারের ‘বিরাট’ সাফল্যের কথা প্রচার করছেন, তা যে প্রকৃত সত্য নয়, সেটা বিদেশিদের বুঝতে দেরি হচ্ছে না। এক সময় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়ভার ভারতের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এতে দ্বিমত করার বোধকরি কিছু নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন এখন দেখতে পাচ্ছে যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার রোধে তেমন কিছুই করতে পারছে না। আর তার ফলে এই জঙ্গিবাদ শহরগুলো থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। গত পহেলা জুলাই গুলশানের হোলে আর্টিজান ক্যাফেতে জঙ্গি হামলায় ২২ জন নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত পুলিশ এ সম্পর্কে কোনো খবরই জানতো বলে মনে হয় না। আর তার ফলেই ওবামা প্রশাসন দিল্লির ওপর আর ভরসা না করে বাংলাদেশের ব্যাপারটা নিজেদের হাতেই তুলে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আর সে কারণেই জন কেরি তার ঢাকা সফরকালে জঙ্গিবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পারস্পরিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জন কেরি আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের জিহাদিরা এ দেশের লোক হলেও তাদের সঙ্গে আইএস সহ আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে। কেরি আরও জানিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে। এই তথ্য জন কেরি জোর দিয়েই প্রকাশ করেছেন। এই তথ্যে সরকার অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কারণ তারা বরাবরই বলে আসছিল যে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই বা আইএসের কোনো তৎপরতা নেই। এরপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জন কেরির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেছেন যে, বাংলাদেশের জঙ্গি সঙ্কট সম্পূর্ণ স্থানীয়। আর এগুলো করছে স্থানীয় ইসলামপন্থীরাই। তবে প্রধানমন্ত্রী মনে হয়, তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তিনি এখন বলতে শুরু করেছেন যে, বিএনপিই এই জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী। তারাই জঙ্গিদের মদত দিচ্ছে।
আবার জন কেরির সফরের পরপরই তার দলের চোঙ্গাবাজরা এখন দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী করায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বীরউত্তম মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছেন। এর আগে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক কেড়ে নেওয়া হবে, যেন তিনি মুক্তিযুদ্ধই করেননি। আবার জন কেরির ঢাকা সফরের পরপরই জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তা কার্যকর করা হয়েছে। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এর আগে জন কেরি মীর কাসেম আলীকে ফাঁসি না দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন। এ কথা মনে রাখা ভালো যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি। আর তাই তার ঢাকা সফরের আগে সরকার জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্যের একটা দৃশ্যপট তৈরি করার চেষ্টা করেছে। তার ঢাকা আসার আগেই গুলশান হামলার কথিত অন্যতম  ‘হোতা’ তামিম চৌধুরীকে এক অপারেশনে বধ করেছে। পুলিশের ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এই অভিযান পরিচালনা করেছে। জানা যায়, এই ইউনিটে যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। এদিকে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মরহুম জামায়াত নেতা গোলাম আযমের পুত্র আবদুল্লাহিল আযমীকে ডিবি পুলিশ তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে বলে পরিবার  থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশ তার গ্রেফতার সম্পর্কে এ পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সহযোগিতার সম্পর্ক তা অনেকটা রুটিনের মতো। কিন্তু এখন সকল স্বাধীন দেশের একমাত্র শত্রু ‘মৌলবাদী ইসলামীরা’। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলা বহুগুণে বেড়ে গেছে। ঐ নির্বাচনে দেশের কোনো বিরোধী দল অংশগ্রহণ করেনি। কারণ অবাধ নির্বাচন হওয়ার সকল রাস্তা সরকার নির্বাচনের আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা থেকে এটা নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে, এখানকার সরকার সবার অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের পথ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। অথচ সেই নির্বাচনই এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ সকল সভ্য দেশও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিরাম এই আহ্বানই জানিয়ে আসছে। এমন কি জাতিসংঘও ২০১৪ সালের ঐ অংশগ্রহণহীন হতাশাব্যঞ্জক নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে আসছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতি ভারতের উদার সমর্থন এখন বেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক নৌ-শ্রমিক ধর্মঘটে আশুগঞ্জে ভারতের বিপুল পরিমাণ করিডোর পণ্য আটকা পড়ে যায়। আবার বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভারতীয় ঋণে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঘোর বিরোধী। প্রতিদিনই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন চলছে।
এদিকে আবার জন কেরির ঢাকা ও দিল্লি সফরের সময়ই ভারত তার বিহার প্রদেশের বন্যার পানি সরিয়ে দিতে ফারাক্কার সবগুলো গেট খুলে দেয়। ফলে বাংলাদেশে হঠাৎ করেই ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়। আর তাতে প্রায় চার কোটি মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন। তারা হারিয়েছেন ফসল, ঘরবাড়ি, জমি, গবাদি পশু, সহায় সম্পদ। সুতরাং কেরি কি ভারতকে এ কথা বোঝাতে সক্ষম হবেন যে, বাংলাদেশে দ্রুত কেনো একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দরকার। ভারতের সামনে এখন দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো, তারা আওয়ামী সরকারকে বোঝাতে পারে যে, অবিলম্বে সরকার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করুক। দ্বিতীয় পথটি হলো, দিল্লি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আরও বেশি করে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব তৈরি করতে পারে এবং আরও বেশি গুম-খুনের পরিবেশ সৃষ্টি করে সন্ত্রাসবাদের পথ প্রশস্ত করতে পারে। এটিও দিল্লির জন্য স্বস্তি এনে দেবে না।
আবার সরকার যদি নির্বাচন দিতে চায়ও, তাহলেও তাতে চালাকির চেষ্টা করলে তাতে ফল কিছুই হবে না। সরকার যদি বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে নির্বাচন দিতে চায় এবং এমপিরা এমপি পদে বহাল থেকেই নির্বাচন করে, তা হলে সে নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নেবে না। সেক্ষেত্রে এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যাতে সরকার ও বিরোধী দল সমান সুযোগ পায়। এদিকে সরকার এমন চেষ্টাও করতে পারে, যাতে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হয়ে পড়েন। তখন খণ্ডিত বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে এসে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করার চেষ্টাও হতে পারে। আর জামায়াতকে তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর জামায়াত আর নির্বাচনে নিজেদের নির্বাচনের যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেনি। এর মাজেজাও সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। বিএনপি চরম পন্থা নেওয়ার দল নয়। কিন্তু তাদের কৌশল হবে, কেউ যদি এই সরকারকে হঠাতে পারে, তবে বিএনপি তাদের সমর্থন করবে।
তবে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছে না। তাদের এই ভুল উপলব্ধি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা হয়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads