মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর


গত সোমবার ১০ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। অনেক কারণেই এ সফর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সফরকে ঘিরে জল্পনা-কল্পনাও কম করা হয়নি। প্রকাশিত বিভিন্ন খবরে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনের ব্যাপারে নিজেদের কর্মকাণ্ডের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়েছে। সন্ত্রাস বিরোধী চলমান আন্তর্জাতিক যুদ্ধের প্রধান শক্তি বা নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র যে সরকারকে প্রশংসা করবে সে কথা ধরেই নেয়া হয়েছিল। এই সমর্থন একেবারে শর্তহীন হয়েছে কি না তা জানার জন্য অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে অন্য একটি সত্যও অপ্রকাশিত থাকেনি যে, জন কেরি বলেছেন, বাংলাদেশে গড়ে ওঠা জঙ্গিদের সঙ্গে আইএস-এর সম্পর্ক ও যোগাযোগ আছে। উল্লেখ্য, মাত্র কিছুদিন আগে ঢাকা সফরে আগত মার্কিন সহকারী পরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালও একই সম্পর্কের কথা বলে গেছেন। সরকার যথারীতি সেটা অস্বীকার করেছে। একই কারণে সহকারী পরাষ্ট্রমন্ত্রীর পর পর জন কেরির এই মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় আইএস-এর বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে, অন্যদিকে আইএস নেই এমন যুক্তি দেখিয়ে সরকার বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের পুরো বিষয়টিকে সরকার অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবেও দেখাতে চাচ্ছে।
আমরা মনে করি, সরকারের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু আইএস তথা আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদীদের সম্পর্ক ও যোগসাজশের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে সেহেতু সরকারের উচিত প্রকৃত সত্য জনগণকে জানানো। সরকারকে একই সঙ্গে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে- যে বিষয়ে বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বারবার আহবান জানানো হয়েছে। আমাদের ধারণা, আইএস-এর বিষয়টিকে সামনে আনার মাধ্যমে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকারান্তরে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থানকেই শক্তি ও সমর্থন যুগিয়ে গেছেন। এখন দেখার বিষয়, সরকার তার এতোদিনকার কৌশল ও কর্মকাণ্ডে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনে কি না।
প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার ব্যাপারেও জন কেরি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে জন কেরি পৃথকভাবে বৈঠক করার পরিপ্রেক্ষিতে। বিএনপির মহাসচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বৈঠকে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জন কেরি বলেছেন, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার এবং দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন অর্জন করবে তেমনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জন কেরি।
আমরা মনে করি, এখানেও কথাটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা দরকার। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এ সত্যই প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার দাবি করলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না। জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। স্মরণ করা দরকার, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র বৈধতা দেয়নি। ফলে পরোক্ষভাবে হলেও বর্তমান সরকারও দেশটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ওয়াশিংটনের শীতল সম্পর্কের বিষয়টিও বিভিন্ন সময়ে জানাজানি হয়েছে। আমাদের মতে সরকারের উচিত জন কেরির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জানিয়ে দেয়া মনোভাব ও অবস্থানের মূল কথা অনুধাবন করা এবং সে অনুযায়ী সব দলকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের পথে পা বাড়ানো। স্মরণ করা দরকার, ইতপূর্বে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়াল এবং ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাটও বিভিন্ন উপলক্ষে বলেছেন, গণতন্ত্রহীনতার কারণে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দুর্বিষহ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনৈতিক সংকটও কাটিয়ে উঠতে হবে। এ ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়া যে সমাধানের পন্থা উপস্থাপন করেছেন এবং ক্ষমতাসীনরা যে তার কোনো একটিও গ্রহণ করেননি- সে বিষয়েও নিশ্চয়ই জানানো হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে।
আমরা মনে করি, জন কেরির ১০ ঘণ্টার সফর কেবলই আনুষ্ঠানিকতার বিষয় ছিল না। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে আইএসকে টেনে আনা থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের মনোভাব ও অবস্থান পরিষ্কার করে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকটিও ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের মতে সব মিলিয়েই সরকারের জন্য নতুন করে চিন্তা করার এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। সরকারের উচিত জঙ্গিবাদ দমনে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সচেষ্ট হওয়া। পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে সব দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। সরকার সদিচ্ছার প্রমাণ দিলে এ সব বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো যে সরকারের পাশে দাঁড়াবে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। আমরা মনে করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়ার জন্যই সরকারের উচিত বিদ্যমান সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে সততার সঙ্গে উদ্যোগী হওয়া।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads