শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬

মন্দের ভিড়ে হাঁসফাঁস


আজকের নিবন্ধ দু’জন অতি সাধারণ মানুষের কথা দিয়ে শুরু করবো। একজন জামাল, বাড়ি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এলাকায়। গোপালগঞ্জে। দ্বিতীয়জনের নাম গিয়াস উদ্দিন, ঘনিষ্ঠজনেরা ডাকে ঘেসু মিয়া। তারও বাড়ি গোপালগঞ্জের আশপাশে। শরিয়তপুরে। জামাল রাজধানীর কোনো একটি এলাকায় সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে মাছ বিক্রি করে। আমার সঙ্গে পরিচয়ের কারণও সেটাই। অন্যদিকে গিয়াস উদ্দিন ওরফে ঘেসু মিয়া সিএনজি চালায়। ১৯৯৯ সালের দিক থেকে আমি তার বাহনটি ভাড়ায় ব্যবহার করে আসছি। তখন ছিল বেবি ট্যাক্সি, এখন হয়েছে সিএনজি। ঘেসু মিয়াকে আগে বলে রাখলে তো বটেই, মোবাইলে খবর দিলেও ঠিক সময়ে আমার বাসায় চলে আসে। আমার ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনদের সবার বাসাই তার চেনা। ফলে অমুকের বাসায় যেতে হবে বলাটাই যথেষ্ট। ঘেসু মিয়াকে বেশি কাজে লাগে ঈদুল আযহার দিন। কুরবানীর গোশতের প্যাকেটগুলো হাতে ধরিয়ে দিলেই পৌঁছে যায় আত্মীয়-স্বজনদের বাসায়।
পাঠকরা তাই বলে ভাববেন না যে, বিনা টাকায় এই সার্ভিসটুকু পাওয়া যায়। আমাকে মিটারের চাইতে দ্বিগুণের মতো বেশি ভাড়া দিতে হয়। ঈদের সময় তো বখশিসের ব্যাপার-স্যাপার রয়েছেই। এসব ছাড়াও সময়ে সময়ে নানাভাবে তাকে সাহায্য করতে হয়। যেমন তার একমাত্র মেয়ের জামাই আবদুস সালামকে অন্তত খান চারেক অফিসে এ পর্যন্ত পিয়নের চাকরি যোগাড় করে দিয়েছি। কিন্তু কোথাও বেশিদিন টিকতে পারে না সে। তাকে নাকি বেতনে ঠকানো হয়! সে কারণে বারবার চাকরি বদল করে সালাম। লেখাপড়া না জানলেও চেহারা-সুরত ভালো এবং কথাবার্তায় স্মার্ট বলে নতুন নতুন চাকরি পেতে অসুবিধা হয় না তার। ভালো চেহারা এবং স্মার্ট হওয়াটাই অবশ্য বিপদও ডেকে এনেছে সালামের জন্য। সেদিন ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় হাঁফাতে হাঁফাতে ঘেসু মিয়া এসে জানালো, সাদা পোশাকের কারা যেন আবদুস সালামকে ধরে নিয়ে গেছে। তার সঙ্গে নাকি জঙ্গিদের ‘কালেকশন’ আছে! এই একটি বিষয়ে আমি কোনো সাহায্যই করতে পারলাম না ঘেসু মিয়াকে।
আফসোস করে ঘেসু মিয়া বললো, আজ যদি ‘রেজ্জাক’ ভাই থাকতো! আওরঙ্গ দাদাও তো মরে গেছে। উল্লেখ্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের কথা বলেছিল ঘেসু মিয়া। শরিয়তপুরের মানুষ হিসেবে আবদুর রাজ্জাককে শুধু চিনতো না, মাঝে-মধ্যে তার কাছে যাতায়াতও করতো ঘেসু মিয়া। এমনকি মন্ত্রী থাকার সময়ও বেশ কয়েকবার তার কাছে আবদুর রাজ্জাকের কথা শুনতে হয়েছিল। তার মতো ভালো মানুষই নাকি হয় না। এখন সে আবদুর রাজ্জাকও নেই, শরিয়তপুরের আরেক নেতা হেমায়েত হোসেন আওরঙ্গও দু’ বছর আগে মারা গেছেন। ফলে মহা বিপদে পড়েছে ঘেসু মিয়া। ‘আমার জামাইয়ের কি হবে স্যার’ বলতে বলতে সেদিন বিদায় নিয়েছিল সে! এটা মাস তিনেক আগের ঘটনা। ক’দিন আগেও শুনলাম, জামাই সালাম এখনো জেলখনাতেই আছে। ঘেসু মিয়া সেই সাথে জানালো, তার ভাগ্য ভালো যে, মহল্লার অমুক-অমুকের মতো তার জামাইকেও ক্রস ফায়ারে দেয়া হয়নি। জামাই বেঁচে আছে- এতেই খুশি ঘেসু মিয়া।
এবার জামালের কথা। সে বিপদে পড়েছে তার এক ভাতিজাকে নিয়ে। বড় ভাইয়ের এই ‘যুয়ান পোলাডা’ গ্রামের কলেজে পড়ে। কলেজ থেকে ফিরেই লেগে যায় মাটি কাটার কাজে। ওটাই তার আয়  রোজগারের একমাত্র উপায়। এলাকার সবাই জানে ও চেনে জামালের ভাতিজাকে। সেই তাকেও মাস খানেক আগে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। অভিযোগ, সে নাকি ‘জামাত-শিবিরের লোক’! জামাল জানালো, গোপালগঞ্জের হেন কোনো এলাকা নেই যেখানে ছাত্র-যুবকদের এভাবে ‘জামাত-শিবিরের লোক’ বানানো না হচ্ছে। অনেককে নাকি জেএমবিও বানাচ্ছে পুলিশ!
প্রসঙ্গক্রমে রাজধানীর অন্য একজনের কথা না বললে কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ক’দিন আগে গুলশান এলাকার একটি হোটেলের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি তার চাকরি হারানোর ভয়ে রয়েছেন। কারণ, জঙ্গি হামলা প্রতিরোধে তৎপর সরকার নাকি স্ক্যানিং মেশিন ও গেটসহ এমন বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে, যা স্থাপন করতে হলে ওই হোটেলের মালিককে অন্তত লাখ পঞ্চাশেক টাকা ব্যয় করতে হবে। কোন দেশ থেকে ঠিক কোন ব্র্যান্ডের মেশিনপত্তর আনতে হবে সেটাও বলে দেয়া হয়েছে। কোনো হেরফের করা চলবে না। ওদিকে এত বেশি টাকা ব্যয় করার সাধ্য নেই হোটেল মালিকের। সে কারণে তিনি হোটেলই বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে আমার পরিচিত ম্যানেজার তো বটেই, আরো অনেকেই চাকরি চলে যাই যাই অবস্থায় পড়েছেন। আলাপে জানা গেলো, একই নির্দেশ রাজধানীর অন্য হোটেলগুলোকেও দেয়া হয়েছে, যেসব স্থানে বিদেশীরা যাতায়াত এবং খাওয়া-দাওয়া করেন।
এখানে নির্দেশের অন্তরালের কিছু বিষয় লক্ষ্য করা দরকার। প্রথমত, জঙ্গি হামলার বিষয়টিকে সরকার অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সম্ভাব্য হামলা যাতে না ঘটতে পারে সে জন্য প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তার ব্যাপারেও সরকার লক্ষ্য রাখতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা ব্যবস্থার আয়োজন নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো বিশেষ বিশেষ দেশ থেকে শুধু নয়, স্ক্যানিং মেশিন ও সিকিউরিটি গেটসহ সবকিছু আমদানি করতে হবে বিশেষ ব্র্যান্ডের অর্থাৎ বিশেষ দু-একটি কোম্পানির। যেহেতু সেভাবেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেহেতু অন্য একটি অনুমানও না করে পারা  যায় না। বলা হচ্ছে, পুরো আয়োজনের পেছনে ‘কমিশন’ ধরনের ব্যাপার-স্যাপার থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আর বর্তমান সরকারের অধীনে ‘বিএনপি-জামায়াতের’ লোকজন যে অন্তত এই ব্যবসার সুযোগ পাবেন না সে কথা তো বলাই বাহুল্য!
এ পর্যন্ত এসে কাছাকাছি অন্য একটি প্রসঙ্গে যেতেই হবে। তারও আগে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে রাখা দরকার। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে আমার বাসায় ডাকাতি হয়েছিল। এরপর বেশ কয়েকবার আমাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নেয়া হয়েছে। প্রথম দিনই একজন সহকারী কমিশনার বা এসি আমার স্ত্রীর একটি মোবাইল ফোন দেখালেন। সেটটি ছিল নোকিয়া ব্র্যান্ডের। এটা ডাকাতির মাত্র দু’দিন পরের ঘটনা। অর্থাৎ দু’দিনের মধ্যেই পুলিশ ফোন সেটটি উদ্ধার করেছিল। কিভাবে- সেটাও ক’দিন পর জানালেন ওই এসি। সামনে থাকা একটি ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখে তিনি বললেন, আপনার স্যামসাং-এর মোবাইল সেটটি এখন মাদারীপুর থেকে ঢাকার দিকে আসছে। গত তিন-চারদিন ধরেই এটা অর্থাৎ যার হাতে সেটটি রয়েছে সেই ব্যক্তি মাদারীপুর থেকে ঢাকা হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত যাতায়াত করছে। কথাটা কিভাবে জানা সম্ভব হলো প্রশ্ন করায় এসি জানালেন, প্রতিটি ফোনসেটেই একটি আইএমইআই নম্বর থাকে। নম্বরটি কারো পক্ষে নষ্ট করা সম্ভব নয়। বিক্রির সময় রসিদে ব্যবসায়ীরা সাধারণত আইএমইআই নম্বর উল্লেখ করে। এটা সরকারের নির্দেশ। আর এই নম্বর জানা গেলে ফোনসেটটির লোকেশন বা অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। বাংলাদেশ পুলিশের কাছে সে টেকনোলজি রয়েছে। এই টেকনোলজি ব্যবহার করেই আমার স্ত্রীর নোকিয়া সেটটি উদ্ধার করেছিল পুলিশ। বলা দরকার, স্ত্রীর সে নোকিয়া তো বটেই, আমার হারানো স্যামসাং সেটটিও আমি ফিরে পাইনি। সবই নাকি পুলিশ ‘হজম’ করেছিল।
ডাকাতির ঘটনাটা বিনা কারণে বলা হচ্ছে না। প্রধান কারণ একথা জানানো যে, যে কোনো মোবাইল সেটে আইএমইআই নম্বর থাকাটা জরুরি। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের আমলে পরিস্থিতি হয়ে গেছে সম্পূর্ণ অন্য রকম। দিন কয়েক আগে সংবাদপত্রের এক রিপোর্টে দেখলাম, দেশে নকল মোবাইল ফোনসেটের বাধাহীন ব্যবসা ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ব্যবসায়ী নামের কিছু জালিয়াত চক্র বিদেশ থেকে চোরাই পথে আনা অতি নিম্ন মানের মোবাইল সেটের কভার পরিবর্তন করে সেগুলোর গায়ে নামি-দামি ব্র্যান্ডের নাম ও লোগো লাগিয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনলাইন শপিং-এর আড়ালে বেশি দামের ফোন অবিশ্বাস্য পরিমাণে কম দামে বিক্রি করছে তারা। এমন ঘটনাও জানা গেছে, যেখানে ৮৫ হাজার টাকা দামের একটি আইফোন বিক্রি হয়েছে মাত্র সাত হাজার টাকায়। প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়া প্রলুব্ধ ক্রেতা এত কম দামে বিক্রির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে না পেরে নগদ মূল্যে ফোনসেটটি কিনেছিলেন। প্রতারক কোম্পানি তার কাছে সেটা পৌঁছেও দিয়েছে। কিন্তু ব্যবহার করতে গিয়েই ক্রেতাকে বুঝতে হয়েছে, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। কারণ, তার মোবাইলের স্ক্রিন কাজ করছিল না। অন্য অ্যাপসগুলোও ছিল অকার্যকর। ওই গ্রাহক ফোনে বিক্রয়কারী কোম্পানির সন্ধান পাননি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোম্পানিটি ভুয়া ঠিকানা দিয়েছিল। সার্ভিস সেন্টারে গিয়েই গ্রাহক প্রথম জানতে পেরেছেন, তাকে আসলে দামি আইফোনের নামে অত্যন্ত নিম্ন মানের একটি সেট গছিয়ে দেয়া হয়েছে। সেটিও এমন এক সেট যা মেরামত করা সম্ভব নয়।
এটা প্রতারণার অসংখ্য ঘটনার মধ্যে মাত্র একটি। এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন আরো অনেক সাধারণ ক্রেতাই। শুধু অনলাইনে নয়, মার্কেটের দোকানেও চলছে প্রতারণার এই ব্যবসা। রাজধানীতে তো বটেই, দেশের উপজেলা পর্যায়ের মার্কেটগুলোতে পর্যন্ত নকল মোবাইল সেটের রমরমা ব্যবসা চলছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। দৈনিকটির রিপোর্টে জানানো হয়েছে, জালিয়াত চক্রকে সুকৌশলে সাহায্য করছে বিভিন্ন ফোন কোম্পানি। সময়ে সময়ে এসব কোম্পানি মূল্যহ্রাসসহ লোভনীয় নানা অফার দিচ্ছে। এতে একদিকে গ্রাহকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন, অন্যদিকে ঘোষিত অফারের সুযোগ নিয়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করছে জালিয়াত চক্রগুলো। তাদের জালে ফেঁসে যাচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। রিপোর্টে রাজধানীর বড় বড় কয়েকটি মার্কেটের নাম উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, মূলত এই মার্কেটগুলোর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকেই সারাদেশে নকল ও নিম্ন মানের মোবাইল সেট সরবরাহ করা হয়। এসব সেটের ব্যবসা চলে পাইকারি বাজারের নিয়মে। সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে শুধু নয়, রাজধানীর ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিশেষ করে মফস্বলের মোবাইল ব্যবসায়ীদের পক্ষেও কোনটি নকল আর কোনটি সঠিক তা বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। যেহেতু মোবাইলের গায়ে বড় বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানির লোগো থাকে এবং সরবরাহও করা হয় বড় বড় মার্কেট থেকে সেহেতু ক্রেতা থেকে ক্ষুদে ও মফস্বলের ব্যবসায়ী পর্যন্ত সকলেই জালিয়াত চক্রের জালে সহজে ফেঁসে যান। জালিয়াত চক্রগুলোর দাপটে সৎ ও প্রকৃত মোবাইল ব্যবসায়ীরাও অসহায় হয়ে পড়েন। সব জেনেও তারা কিছুই করতে পারেন না। কারণ, এই জালিয়াতদের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। তাদের অনেকে নিজেরাও চুটিয়ে ব্যবসা করছে। একই কারণে পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সাহায্য পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সমিতির পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এভাবে প্রতি বছর সারাদেশে কম করে হলেও এক কোটি ফোন সেট বিক্রি হচ্ছে। এসব ফোন সেট আসছে চীন ও ভারতসহ কয়েকটি দেশ থেকে। এসব সেটের মধ্যে দু’ হাজার টাকা মূল্যের সেটগুলো বিক্রি হয় ৬০ শতাংশের বেশি। দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মূল্যের সেট বিক্রি হয় প্রায় ৪০ শতাংশ। গরীব ও নিম্নবিত্তের মানুষেরাই এসব ফোনসেটের প্রধান ক্রেতা। তারা তো প্রতারিত হচ্ছেই, পাশাপাশি রয়েছেন সেই সব গ্রাহকও, যারা বেশি দামের ফোন সেট অল্প টাকায় কেনার জন্য প্রলুব্ধ হন। না বুঝেই কিনে ফেলেন।
এভাবে সব মিলিয়েই দেশের মোবাইল ফোনসেটের বাজারে এক ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থার কুফলও সমগ্র জাতির জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রথমত বেআইনী তথা চোরাচালানের অবৈধ পথে দেশের বাজারে ঢুকছে বলে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণের রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আসে নিরাপত্তার দিকটি। এসব সেটে ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্টার বা ইআইআর থাকে না। ফলে সরকার বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে সেটগুলোর ব্যবহারকারীদের খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। সম্ভব হচ্ছেও না। জঙ্গি-সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা তাই সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে। হয়তো পার পাাচ্ছেও। তৃতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। কারণ, বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব সেটের মধ্যে থাকা রেডিয়েশনের গতি ও মাত্রা স্বাভাবিক ফোনের তুলনায় চার-পাঁচ গুণ বেশি। ফলে ফোনসেটের ব্যবহারকারীরা ক্যান্সারসহ জটিল ও মারাত্মক অনেক রোগের শিকার হবে। বাস্তবে হচ্ছেও, যে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানার জন্য কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে সরকার কিন্তু নকল ফোনসেট আমদানি ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী শুধু একটি আইএমইআই ডাটাবেজ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন, যার মাধ্যমে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসির ওয়েবসাইট থেকে যে কোনো ফোনসেট সম্পর্কে জানা যাবে।
অন্যদিকে তথ্যাভিজ্ঞরা মনে করেন,  বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। এর মাধ্যমে সাধারণ ক্রেতাদের লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পাঠকরাও ভেবে দেখতে পারেন, মোবাইল সেট বা এ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে ক’জনের পক্ষে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী দূরের কথা, বিটিআরসির মতো সংস্থার কর্মকর্তাদের কাছে নালিশ করতে যাওয়া সম্ভব। তারা তো এমনকি থানায়ও যেতে পারেন না। কখনো সাহস করে গেলেও পুলিশের সাহায্য পান না।
এজন্যই প্রতারণা প্রতিহত করতে হলে সরকারের উচিত এমন পদক্ষেপ নেয়া, যাতে চোরাই পথে নিম্ন মানের নকল মোবাইল সেট দেশের বাজারেই ঢুকতে না পারে। এসব ফোনের পেছনে তৎপর জালিয়াত চক্রগুলোর বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কারণ, তারা শুধু সরকারকেই রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে না, সমগ্র জাতিকেও ঠেলে দিচ্ছে বিপর্যয়ের মুখে।
বলা দরকার, দেশ ও জনগণের তো বটেই, সরকারেরও ভালোর জন্য মোবাইল ফোনসেটের প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করা হয়েছে। কারণ, মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সমিতির উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে বছরে এক কোটি ফোন সেট আমদানি ও বিক্রির কথা জানানো হয়েছে। এক কোটির অর্থ একশ’ লাখ। এই একশ’ লাখের মধ্যে কয়েক হাজার সেটেও যদি বিস্ফোরক দ্রব্য আনা হয়ে থাকে তাহলে গুলশানের মতো কয়েকটি এলাকার হোটেলে পঞ্চাশ লাখ টাকা দামের স্ক্যানিং মেশিন বা সিকিউরিটি গেট স্থাপন করে কতটা সুফল পাওয়া যাবে তা পাঠকরাও ভেবে দেখতে পারেন। মানতেই হবে, সরকার আসলে ‘গোড়ায় গলদ’ রেখে জঙ্গি হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এভাবে কি জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ সুফলপ্রসূ হতে পারে? সাধারণ মানুষকে অবশ্য যথেচ্ছভাবে বিপদে ফেলা যাচ্ছে। একই কারণে হাঁসফাঁস করতে হচ্ছে তাদের।
আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads