শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৬

সীমান্ত হত্যা নির্যাতন : শীর্ষ ব্যক্তিদের আস্কারা


বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের গুলি চালানো বন্ধ হবে না- বিবিসির সঙ্গে সাক্ষৎকারে এ ধরনের বিবৃতি দিয়েছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান ইউ কে বানশাল। অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসফের গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত সে দেশের দেওয়া প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন বলে অভিযোগ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজেপি)। অথচ দুই দেশের স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহাপরিচালক পর্যায়ে কয়েকবারই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে সীমান্তে কেউ গুলি ছুড়বে না। ভারত এখন বলছে গুলি বন্ধ হবে না। বানশালের মতে বাংলাদেশীরাই অপরাধী। আর এ অপরাধ আটকাতে বিএসএফকে গুলি চালাতেই হবে। বিএসএফের এই রক্তাক্ত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান বলেন- সীমান্তের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। বিএসফের অস্ত্র প্রয়োগ বন্ধে প্রয়োজনে তাঁরা জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে নালিশ করবেন।
একবার-দুইবার নয়, বহুবার ভারত ও বাংলাদেশের স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীল মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সীমান্তে কোনো হত্যাকাণ্ডে হবে না, কেউ গুলি ছুড়বে না। দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে নেওয়া এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ রেখেছে, কিন্তু ভারত রাখেনি। গত এক বছরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ২১ জন বাংলাদেশী নাগরিক। ভারতের পুলিশের হাতে নিহত হয়েছেন একজন। ভারতীয় নাগরিকদের হাতে বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন ১০ জন। সীমান্তের ওপারের অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির হাতে নিহত হয়েছেন তিন বাংলাদেশী। সব মিলিযে গত এক বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), ভারতীয় পুলিশ, ভারতীয় নাগরিকের হাতে ৩৫ জন বাংলাদেশী সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি), পুলিশ, বাংলাদেশী নাগরিক কিংবা কোনো বাংলাদেশী দুষ্কৃতিকারীর হাতে একজন ভারতীয় নাগরিকও নিহত হয়নি! ভারত বরাবরই বলে, বাংলাদেশ তার অকৃত্রিম বন্ধু! এই কি বন্ধুর নমুনা?
বহুবার, বহু সময়, বহু বৈঠকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে বলেছে, ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ ভারতের অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশে ভক্তিতে গদগদ হয়েছে। বটবৃক্ষের মতো বৃহৎ এ বন্ধুর বাহুডোরে লেপ্টে থাকতে শ্রদ্ধায় নতজানু প্রদর্শন করেছে। অকৃত্রিম বন্ধুত্বের পরিচয় দিতে একজন বাংলাদেশীকে বিবস্ত্র করে হাত-পা বেঁধে নির্দয়ভাবে আঘাত করে গোপনাঙ্গে পেট্রল ঢেলে আদিম উল্লাসের পর আরো উদ্দাম প্রকাশ করতে বিবস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিকের ভিডিওচিত্র ধারণ করেছে বিএসএফ। এই অকৃত্রিম বন্ধুত্বের! বন্ধুত্বপনায় মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশ সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হয়েছেন রীতিমতো মুগ্ধ! সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে গত ২১ জানুয়ারি তিনি মন্তব্য করেন, সীমান্তে যা কিছু ঘটছে, তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। এসব অতীতে ঘটেছে, এখনো ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে সরকার মনে করে না।
ভারত তার অকৃত্রিম বন্ধুত্বের অপার এ নিদর্শন বারবার প্রদর্শন করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের হাবিবুর রহমানের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীর ক্ষেত্রে, দিনাজপুরের বিরামপুরের সাইফুল ইসলামসহ দুই দিন পর পর নিরীহ বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে। এই বর্বর বন্ধুত্ব প্রদর্শনের প্রতিবাদ ভারত কোনো সময়ই তেমনভাবে পায়নি। ফলে তার বন্ধুত্ব প্রদর্শন গাঢ়ত্ব পেয়েছে। আগে গুলি করে মেরে ফেলত; এখন মেরে ফেলার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে। আবার ঝুলিয়ে রাখা প্রদর্শন শেষ হলে পশুর মতো লটকিয়ে বিএসএফ ক্যাম্পে নিয়ে তোলে।
বাংলাদেশের প্রতি ভারতের তথাকপিত এই অকৃত্রিম বন্ধুত্ব দিনদিন বাড়তেই থাকবে, যত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ নতজানু মনোভাব পরিহার না করবে, রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার জন্য বা টিকে থাকার জন্য তীর্থের কাকের মতো ভারতের দিকে চেয়ে না থাকবে। মন্ত্রিত্ব বা পদের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশীদের দুর্গতিতে দুঃখিত হয়ে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা উদাত্ত কণ্ঠে যখন বলে উঠবেন, ‘অকৃত্রিম বন্ধুত্ব প্রদর্শনের এ বর্বরতা বন্ধ না হলে বাংলাদেশ সমুচিত জবাব দেবে’- তখনই হয়তো বন্ধ হবে ভারতের এই বর্বর প্রদর্শনী। গুলির বদলে গুলি, হত্যার বদলে হত্যা নীতিতে এগোনোর সামান্য ক্ষমতাও যদি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বিজিবিকে দেয়, তাহলে সব বাংলাদেশীই বিশ্বাস করে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের মতো ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও বিজিবিকে দেখলে বিএসএফ লেজ গুটিয়ে পালাবে। মদ খেয়ে পড়ে মাতাল হয়ে নিরীহ বাংলাদেশী হত্যার অসৎ উল্লাস চিরতরে ভুলে যাবে।
গুলি চলবে : বিএসএফ প্রধান ইউ কে বানশাল : ৭ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) প্রধান ইউ কে বানশাল বিবিসিকে দেওয়া এক দসাক্ষাৎকারে বলেন, “সীমান্তে গুলি চালানো বন্ধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। যত দিন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অপরাধমূলক কাজ হতে থাকবে, তত দিন অপরাধ আটকাতে হবে বিএসএফকেই। আর এটাই বিএসএফের দায়িত্ব।’
বিএসএফ কখন বা কেন গুলি করবে না, সে প্রসঙ্গে বানশাল বলেন, ‘বাংলাদেশী বাহিনী যদি তাদের নিজেদের সীমান্ত এলাকায় পাহারার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে, রাত্রিবেলা সীমান্ত এলাকায় চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে অপরাধীরা ভারতের দিকে আসতে পারবে না, বিএসএফকে গুলি করতে হবে না।’
বিএসএফ প্রধান ইউ কে বানশাল বিসিবির সঙ্গে ‘সীমান্তে গুলি চলবে’ সংক্রান্ত বিবৃতিটি এমন একসময় দিলেন, যখন বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ আরো কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, তিস্তা নদীর পানিবন্টন চুক্তি, ফেনী নদীর ওপর সড়ক নির্মাণসহ ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার ও বাংলাদেশ-ভারত সরাসরি রেলপথ নির্মাণে যখন দুই দেশের শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রে অনেকটা কাছাকাছি পৌছেছেন, বিএসএফ প্রধান বললেন, ‘সীমান্তে গুলি চলবে।’
এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, ইউ কে বানশাল যা বলতে চাচ্ছেন, তার সারমর্ম এককথায় বাংলাদেশীরা অপরাধী। তিনি ভারতীয়দের কিংবা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের কোনো অপরাধ দেখেননি। তিনি বলছেন, বাংলাদেশী বাহিনী যদি তাদের নিজেদের দিকে পাহারা কড়া করে, সীমান্তে রাতে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে অপরাধীরা ভারতের দিকে আসতে পারবে না। পৃথিবীর যেকোনো সীমান্তে চোরাচালান-সংক্রান্ত কোনো বিষয় না থেকে থাকে তাহলে সীমান্তটি যে দুই দেশের মধ্যে অবস্থিত, সে দুই দেশের নাগরিকরাই অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের নাগরিকরা যদি গরু আনতে ভারতে অনুপ্রবেশ করে, তাহলে তা অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু ভারতীয় যে নাগরিক গরুগুলো বাংলাদেশের হাত তুলে দেয় সে কি অপরাধী নয়। অথচ বানশাল বলছেন, বাংলাদেশীরাই অপরাধী। তিনি সোজাসাপ্টা বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অপরাধমূলক কাজ হতে থাকবে, ততক্ষণ সে। অপরাধ আটকাতে হবে বিএসএফকে- সেটাই বিএসএফর দায়িত্ব।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অপরাধমূলক কাজ যদি সংঘটিত হতেই থাকে এবং তা আটকানোর দায়িত্ব যদি বিএসএফের হয, তাহলে বিএসএফের গুলিতে গত এক বছরে ২১ বাংলাদেশী নিহত হলে অন্তত ১০ জন ভারতীয় অপরাধীও নিহত হওয়ার কথা। তা কি হয়েছে? চোরাচালানে অংশ নিচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশের নাগরিক, অথচ অপরাধী শুধু বাংলাদেশীরা। ভারতীয় অপরাধীরা কিছুই নয়? বানশাল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যা বলছেন, তা হলো, বাংলাদেশীরাই একমাত্র অপরাধী, তাদের দেখামাত্র গুলি করে।
বানশাল বিবিসির সঙ্গে দেওয়া ‘সীমান্ত গুলি চলবে’ শীর্ষক বিবৃত নিজে তৈরি করে দেননি। তাঁর এ বিবৃতি ভারতয় কর্তৃপক্ষের চিন্তা-চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। ভারত এত দিন যা বলেছে, তা ছিল প্রতারণামূলক আশ্বাস। এখন বিএসএফ প্রধান যা বলছেন, তাই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনের কথা। ভারত যে এ অঞ্চলে নিজেকে প্রভু মনে করে এবং তার আশপাশে ঘিরে থাকা দেশগুলোকে মনে করে ভৃত্য-তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল বানশালের বিবৃতিতে। ভারত তার চেতনার এই প্রকাশ আরো বৃদ্ধি করবে-যতক্ষণ পর্যন্ত না ভৃত্যের কাছ থেকে কঠোর জবাব পাবে। বাংলাদেশের সময় এসেছে কঠিন জবাব দেওয়ার। নতজান মনোভাব না দেখিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সীমান্তবাসী, সেইসঙ্গে দেশবাসী গর্জে উঠবে বানশালের মতো ভারতীয় কর্মকর্তাদের দুঃসাহস হবে না বলতে যে ‘সীমান্তে গুলি চলবে।’
রক্তক্ষয়ের কারণ : পেঁয়াজ-ফেনসিডিল : বেশির ভাগ ভারতীয় পেঁয়াজ ও গরুর মাংস খায় না। অথচ আমরা বাংলাদেশীরা সবচেয়ে বেশি খাই পেঁয়াজ ও গরুর মাংস। এ দুটি আবার একটি অন্যটির পরিপূরক। রান্না করা গরুর মাংসে আমাদের গৃহিণীরা মসলা হিসেবে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ ব্যবহার করার পরও গরুর ভুনা মাংসের সঙ্গে কচকচ করে পেঁয়াজ চিবানোর অভ্যাসও আমাদের বাংলাদেশীদের নিতান্ত কম নয়। এক কেজি গরুর মাংস রান্না করতে আমরা অন্ততপক্ষে ১০০ গ্রাম পেঁয়াজ ব্যবহার করি। সেই রান্না করা মাংস খেতে গিয়ে আমরা কাঁচা পেঁয়াজ খাই আরো ১০০ গ্রাম। অর্থাৎ এক কেজি গরুর মাংস পেট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাতে তেল, লবণ, পানি, দারুচিনি, এলাচি, লবঙ্গ, তেজপাতা, আদা রসুন, মরিচ, হলুদ, জিরা ও ধনিয়ার বাইরেও কমপক্ষে ২০০ গ্রাম পেঁয়াজ সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
বলাবাহুল্য, লবণ ও পানি ছাড়া পেঁয়াজসহ সব মসলার বাংলাদেশের অন্যতম জোগানদাতা ভারত। এ জোগান বৈধ-অবৈধ দুভাবেই হয়ে থাকে। একটা গরুতে যদি ৬০ কেজি মাংস হয় তাহলে সেই গরু জিহ্বার রসনা মিটিয়ে মসলা ও সালাদ হিসেবে পেটে যায় ১২ কেজি পেঁয়াজ সঙ্গে নিয়ে। গরুর মাংসের সঙ্গে পেঁয়াজের যেন অপূর্ব মিতালি। রসনায় এবং রন্ধনে।
আমরা যে শুধু গরুর মাংসের সঙ্গে পেঁয়াজ খাই এমন নয়। প্রায় সব কিছুর সঙ্গেই আমরা পেঁয়াজ খাই। আলুভর্তা থেকে শুরু করে বার্গার পর্যন্ত সব কিছুতেই আমাদের পেঁয়াজ লাগে। বিয়ে বাড়িতে সালাদের সঙ্গে পেঁয়াজ না থাকলে অতিথিদের মধ্যে কানাঘুষা চলে। অনেকে নিচু গলায় বলেও দেয়, পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকা, তাই হয়তো সালাদে পেঁয়াজ নেই।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি ধরা হয় ১৬ কোটি এবং এর মধ্যে যদি ছয় কোটি জনসংখ্যাকে পেঁয়াজ খাওয়ার আওতার বাইরে রাখা হয় তা হলেও বাংলাদেশের অন্তত ১০ কোটি লোক পেঁয়াজ খায়। একজন লোক যদি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ গ্রাম পেঁয়াজ খায় তাহলে বাংলাদেশে প্রতিদিন পেঁয়াজ লাগে ১০০ কোটি গ্রাম অর্থাৎ ১০ লাখ কেজি। এ ১০ লাখ কেজি পেঁয়াজের একটা বড় অংশ আসে সীমান্ত পথে ভারত থেকে। ফলে বিএসএফের ভাগ-বাটোয়ারায় সমস্যা হলে চালানো হয় গুলি।
বাংলাদেশে পেঁয়াজ যে চাষ হয় না এমন নয়। ফরিদপুরের ফরিদপুরি পেঁয়াজ, রাজশাহীর তাহেরপুরি পেঁয়াজ আর মানিকগঞ্জ ও পাবনার পেঁয়াজেরও বেশ নামডাক আছে। কিন্তু সেগুলো আকারে ছোট। একটা বড়সড় বরইর মতো। এর বিপরীতে ভারতীয় পেঁয়াজ বেশ নাদুসনুদুস। মাঝারি আকারের আপেলের মতো। তবে ঝাঁঝ কম। স্বাদও কম।
সে যা-ই হোক, আমরা বছরে যে পরিমাণ পেঁয়াজ খাই তাতে হয়তো মাসখানেকের চাহিদা পূরণ করে থাকে ফরিদপুর ও রাজশাহীর পেঁয়াজ। এর বাইরে প্রতি জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে যে পেঁয়াজ চাষ হয় তাতে আরো পনের দিন চলে। বাদ বাকি সাড়ে ১০ মাসের পেঁয়াজের চাহিদা আমরা মিটিয়ে থাকি বাইরের পেঁয়াজ দিয়ে। তার বড় অংশ আসে ভারত থেকে। বৈধ ও অবৈধভাবে। এতে তারা ব্যবসায়িকভাবে লাভবানও হচ্ছে।
ভারত প্রতি বছর তার লাখ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করে আসছে শুধু বাংলাদেশের চাহিদা মেটানো জন্য। তারা পেঁয়াজ তেমন না খেলেও বাংলাদেশীদের খাওয়ানোর জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পেঁয়াজ চাষ করে। সেই পেঁয়াজ তারা যেমন বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমাদের জন্য বৈধপথে পাঠায় তেমনি বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথেও পাঠায়। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পণ্য চোরাচালানের ক্ষেত্রে ফেনসিডিলের পরই সম্ভবত পেঁয়াজের স্থান। আর এই পেঁয়াজ চোরাচালানের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধীরা যেমন জড়িত তেমন জড়িত ভারতের অপরাধীরাও। অথচ বানশালের দৃষ্টিতে বাংলাদেশীরাই অপরাধী। ভারত ধোয়া তুলসি পাতা।
এক-এগারোর পর বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতের সরকারি মহল ও মিডিয়া প্রবল উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। তাদের উচ্ছ্বাসের প্রধান কারণই ছিল এক-এগারোর আগের পাঁচ বছরে ক্ষমতায় থাকা বিএনপির ক্ষমতায় আসতে না পারার বিষয়টি। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ভারত বিএনপি সরকারের কাছ থেকে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি তা বাস্তবায়নে আর কোনো বাধা নেই বলে তাদের উচ্ছ্বাসের মাত্রাটা ছিল অতিরিক্ত। ঢাকা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস, ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন, পাইলাইনের গ্যাস ইত্যাদি ইস্যু বর্তমান সরকারের কাছ থেকে খুব ভালোভাবে আদায় করতে পারার সুখ-স্বপ্নে তারা বিভোর হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে তখনই যখন তারা দেখতে পায় বর্তমান সরকারও বিগত বিএনপি সরকারের মতো কিছু প্রকল্পের বিষয়ে একই নীতিতে হাঁটছে।
বাংলাদেশী শীর্ষ ব্যক্তিদের আশকারা : বানশালের এ ধরনের বিবৃতির মূলে রয়েছে বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যক্তিদের আশকারামূলক কথার্বাতা। যেমন- ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আটরশিয়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের নির্মম নির্যাতনের ভিডিওচিত্র যেদিন দেশ-বিদেশে প্রকাশিত হয়, এর পরদিন (২১ জানুয়ারি) এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তে যা কিছু ঘটছে, তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। এসব অতীতে ঘটেছে, এখনো ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে সরকার মনে করে না।’ একজন বাংলাদেশীকে বিবস্ত্র করে হাত-পা বেঁধে বুটজুতা ও লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে আঘাত করছে-আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের দৃষ্টিতে এ জাতীয় ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটবে, সরকার এ বিষয়ে চিন্তিত নয়। একজন বাংলাদেশীকে উলঙ্গ করে তাঁর গোপনাঙ্গে পেট্রল ঢেলে উল্লাস করছে বিএসএফ-সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দৃষ্টিতে এ জাতীয় ঘটনা ভবিষ্যতে আরো ঘটবে। একজন বাংলাদেশীকে দিগম্বর করে ভিডিও করছে বিএসএফ-আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডিমন্ত্রী বলছেন, এ জাতীয় ঘটনা ঘটতেই থাকবে। রাষ্ট্র এতে চিন্তিত নয়।
ফেলানী, হাবিবুর কিংবা রাশেদুজ্জামানই নয়, পর্যালোচনায় দেখা যায়, মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ছিল বাংলাদেশীদের লাশের মিছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসারপর সীমান্ত এলাকায় ২০১২ সালে ৯৮ জন, ২০১৪ সালে ৭৪ জন এবং ২০১৬ সালে ৩১ জন নিহিত হয়েছেন। এ সময় বিএসএফের হাতে অহরণের শিকার হয়েছেন ৯০ বাংলাদেশী। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে বিএসএফ ৯৮ বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা ছাড়াও পিটিয়ে বা পাথর ছুড়ে আহত করেছে ৭৯ জনকে, অপহরণ করেছে ২৫ জনকে, নিখোঁজ হয়েছে ৯২ জন এবং বাংলাদেশে পুশইন করেছে ১১ জনকে। ২০১৫ সালে ৭৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা ছাড়াও পিটিয়ে আহত করেছে ৭২ জনকে, অপহৃত হয়েছে ৪৩ জন। ২০১৬ সালে ৩১ জন হত্যা, পিটিয়ে ও নির্যাতন করে আহত করেছে ৬০ জনকে। এ সময় অপহৃত হয়েছে ২২ জনকে বাংলাদেশী নাগরিক। আর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব মতে ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৪৭ জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যার কথা স্বীকার করেছে বিএসএফ। এসব ঘটনায় অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান বিবিসিকে সম্প্রতি বলেন, গত ১০ বছরে পরও সহিংস ঘটনা কমেনি।’ এহব ঘটনা পর্যালোচনা করে আদিলুর রহমান খান বিবিসিকে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তটি পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত।’
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠার পেছনে বিএসএফের বর্বরতা ভারত সরকারের প্রভুসুলভ মনোভাব, সে দেশের নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়া নিঃসন্দেহে দায়ী। কিন্তু বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের দায়-দায়িত্ব কম নয়। ভারত বিশাল রাষ্ট্র-এই ভয়ে আমরা যেন সব সময় ত্রস্ত থাকি। আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হয় মিনমিনে। ভারতের সুশীল সমাজ তাদের দেশের বিএসএফের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের সুশীল সমাজসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা পারলে বিএসএফের পক্ষ নেয়।
গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্য। আমাদের নীতি-নির্ধারকরা ঘটেছে, ঘটছে এবং ভবিষ্যতে ঘটবে বলে বিএসএফকে প্রকারান্তরে উসকে দিচ্ছে বাংলাদেশী নিধনে। এই নিধনযজ্ঞ সেদিনই শেষ হবে, যেদিন পুরো জাতি জেগে উঠবে। গর্জে উঠবে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তখন আর কোনো নেতা বলতে পারবেন না, সীমান্তের ঘটনায় সরকার চিন্তিত নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads