মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৬

রাস্তা বন্ধ


 এই জনপদে এখন সবার জন্যই রাস্তা বন্ধ। প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, এমপি, সরকারি বড় কর্মকর্তা, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কোনো কোনো সরকারি তাঁবেদার সংবাদপত্রের সম্পাদক আর সাধারণ নাগরিক সবার জন্যই এখন রাস্তা বন্ধ। কারও জন্যই বোধকরি আর কোনো সরল পথ খোলা নেই। গত ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবের ছবিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চতুর্দিকের সকল রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আশেপাশের ভবনগুলোর ছাদে মার্চ করতে করতে উঠে এসেছিল ডজন ডজন পুলিশ বাহিনী। চারদিকে পুলিশের হুইসিলে তটস্থ অবস্থা। ট্র্যাফিক জ্যাম কতোদূর বিস্তৃত হয়েছিল, জানি না। অসহায় মানুষ বন্ধ রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে শাপ-শাপান্ত করছিল।
এ শুধু ৩২  নম্বরের চিত্র নয়। মন্ত্রী সভার কেউ কোথায়ও যাবার জন্য বের হন, তখনই চতুর্দিকের রাস্তাঘাটের এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় আটকে ঘামতে থাকেন। তারা কী মনোভাব ব্যক্ত করেন, সেটা এখন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে দেবার কোনো লোক আছে বলে মনে হয় না। এক সময় হয়তো প্রধানমন্ত্রী অনুমান করেছিলেন, এই জনভোগান্তির কথা। তাই তার শান্ত্রী, অমাত্যদের বলেছিলেন যে, নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আমাকে যেনো জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা না হয়। সে রকম কথার কথায় কেউ কান দেয়নি। বরং কোনো এক সংবাদপত্রে বলা হয়, জনগণের যতো ভোগান্তিই হোক না কেনো তার নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে এখন তাই সবচেয়ে বেশি জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। আর তাই বিভিন্ন প্রকল্প তিনি এখন উদ্বোধন করছেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। জনগণের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন না।
পুলিশ-নির্ভর সরকারে পুলিশ এখন সব কিছুর নিয়ন্তা। তারা মন্ত্রীদের সতর্ক করে দিয়েছেন, তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে। সতর্ক করা হয়েছে, মন্ত্রীদের গানম্যানদেরও। ফলে মন্ত্রীরাও আর ঘরের বার খুব একটা হচ্ছেন না। আগে যেমন নানা আলতু-ফালতু অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে খবর হবার চেষ্টা করতেন, এখন সে ধারা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পুলিশ সতর্ক করে দেওয়ার মানে কী। মানে হলো, পুলিশের পক্ষে এতো নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। যে পুলিশ সাধারণ মানুষকে উল্টো পথে যেতে বাধা দেয়, সে পুলিশই মন্ত্রী-যন্ত্রীদের রাস্তার উল্টো পথ দিয়ে নিয়ে গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। কিন্তু পুলিশ কেনো ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে  কৈফিয়ত তলব করার সাহস বোধকরি কোনো মন্ত্রীরও নেই। তাহলে আইন ভেঙে তিনিও রং লেনে যাবার অনুমতি পুলিশকে দিতেন না। মন্ত্রী যদি রং লেনে যেতে পারেন, তাহলে আমি কেনো পারবো না? আমাকে কেনো ট্র্যাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? বলিহারি বটে সরকার! তাই দেখি, আগে যেখানে টিভির টক-শোতে মন্ত্রী-এমপিরা যেতেন, এখন সেখানে যান পুলিশের ছোট-বড় কর্মকর্তারা। পুলিশি রাষ্ট্রে এমনই হবার কথা। সরকারি তাঁবেদার টেলিভিশনগুলোর মান এমন অবস্থায় নেমে এসেছে!
রাস্তায় বের হলে কেবলই জনগণকে ‘তফাত যাও’ হুইসিল শুনতে হয়। বড় সাহেব যাচ্ছেন, দূরে থাকো। পথ ছাড়ো। এ বড় সাহেবকে সব সময় মন্ত্রী হবার দরকার নেই। সচিব, যুগ্মসচিব, পুলিশ কর্মকর্তা হলেও চলবে। তার অধিকার আছে, জ্যামে রং লেনে দিয়ে পার হয়ে যাবার। এখানেই শেষ নয়। ঢাকা মহানগরীতে উত্তর-দক্ষিণে যা কিছু রাস্তা আছে, পুবে-পশ্চিমে তেমন রাস্তার অভাব। আর যাও-বা কিছু আছে, এখন তারও প্রায় সব বন্ধ। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড পুবে-পশ্চিমে টানা। এটি প্রশস্তও। কিন্তু এই সরকার আসার পর থেকে সে সড়ক স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে এর উত্তর দিকে মেট্রো শপিং মলের পাশ দিয়ে যে সরু রাস্তা গেছে ডানে বামে ঘুরে, ধানমন্ডির হাজার হাজাার যানবাহনকে যেতে হয় সে পথ দিয়ে। তীব্র তুমুল যানজটে নাভিশ্বাস অবস্থা।
এই অবস্থা শুধু ধানমডন্ড ৩২ নম্বরেরই নয়। গোটা ধানমন্ডি জুড়েই একই অবস্থা। সকল সড়কের মুখে লোহার পোল দিয়ে ব্যারিকেড লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, রাত এগারোটার পর ‘রাস্তা বন্ধ’। আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ। কে এই কর্তৃপক্ষ, সে হদিশ কেউ দিতে পারে না। কিন্তু সত্যি সত্যি গেট বন্ধ হয়ে যায়। পোলের অপর মাথার আংটার সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হয় তালা। ধানমন্ডির ভেতরে কাউকে যদি ছিনতাইকারী তাড়া করে, তবে তার বের হবার পথ নেই বললেই চলে। বেঘোরে ছিনতাইকারীর গুলি বা ছুরিতে প্রাণ দেয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকবে না।  কিন্তু এমনকি. জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে ধানমন্ডির মানুষ ঢুকবে বা বের হবে কোন পথ দিয়ে? ততোক্ষণে রোগী মারা যেতে বাধ্য। এ কাজ পুলিশ করেছে, সাইনবোর্ডে তেমন কথার উল্লেখ দেখিনি। পুলিশ যদি না করে থাকে, তবে তারা এই অবৈধ ব্যারিকেড কেনো সরিয়ে ফেলছে না?
আবার ধানমন্ডির দেখাদেখি এটা এখন বাড্ডা রামপুরাসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়ও চালু করা হরা হয়েছে। সেসব যায়গায় আরও এলাহি কাণ্ড। আমি আমার নিজের বাসায় আমার নিজের যানবাহনে যাব, কিন্তু রাত এগারোটা হলে প্রবেশ নিষেধ। যেতে হলে টোল দিতে হবে। পত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম, রামপুরা বাড্ডা প্রভৃতি এলাকায় এমন ব্যবস্থা চালু করেছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা। পুলিশের বোধকরি এখানে কিছুই করার নেই। আসলে সরকার সমস্ত দেশটাকে যেমন, তেমনি রাজধানীকেও এক বৃহৎ কারাগারে পরিণত করে ফেলেছে। এখানে প্রবেশ যেমন নিষেধ, বেরুবার পথও তেমনি রুদ্ধ।
এই অবস্থা শুধু আবাসিক এলাকায়ই নয়। একই চিত্র পাওয়া যাবে বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতেও। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় দৈনিক সমকাল অফিস থেকে সরাসরি এসে আগে ওঠা যেতো বিজয় সরণি বা ব্যাংগস ফ্লাইওভারে। এখন সে পথ বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। এই বন্ধ আবার কোনো অস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। একেবারে স্টিলের পোল গেড়ে, স্টিল শীট দিয়ে আটকে দিয়েছে পথ। সোজা ওঠা যাবে না ফ্লাইওভারে। আপনাকে ফ্লাইওভারে উঠতে হলে বামে গিয়ে ঘুরে আসতে হবে সাতরাস্তার মোড়। আবার সাতরাস্তার মোড় পার হলে নবনির্মিত হাজারো ত্রুটির ফ্লাইওভার ধরে নেমে আসছে শত শত যানবাহন। তীব্র যানজটের সে ভিড়ে দাঁড়াতে হবে আরও ঘণ্টাখানেক। তারপর একসময় গিয়ে হয়তো উঠতে পারবেন ফ্লাইওভার নামক নরকে। কারণ এই ফ্লাইওভার পার হতে আপনার সময় লাগতে পারে আরও এক ঘণ্টার বেশি সময়। ফ্লাইওভারের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত নিñিদ্র যানজট তেজগাঁর রাস্তা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। নিষ্ক্রিয় পুলিশ নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। বাকি আল্লাহ ভরসা। উল্লেখ্য, এই ফ্লাইওভারটিও পুবে-পশ্চিমে বিস্তৃত। যেটি স্বাভাবিকভাকে চালু থাকলে নগরে যানজট অনেকখানি নিরসন করা সম্ভব হতো।
তেমনি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত আর একটি সড়ক পরীবাগের বিপরীতে ভিআইপি সড়কের পুব পাশের রোডটি। সেখানে আছে আবাসিক এলাকা। আছে পুলিশের কি একটা কম্যুনিটি সেন্টার। পনানা অনুষ্ঠান চলে দিনরাত। কিন্তু ভিআইপি রাস্তা ধরে সেপথে যাবার কোনো উপায় নেই। আপনি হয়তো বাংলামোটর থেকে হলি ফ্যামিলির রাস্তা পেরিয়ে বাঁয়ে ঢুকবেন। কিন্তু না, ‘রাস্তা বন্ধ’। এ আয়োজনও কোনো কোনো সাময়িক ব্যবস্থা নয়। তেজগাঁও শিল্প এলাকার রাস্তার মতোই স্টিলের পিলার গেড়ে স্টিলের শীট দিয়ে একেবারে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তেজগাঁয় তবু বাঁদিকে বেরিয়ে সাতরাস্তার দিকে যাবার একটি পথ আছে, এখানে তাও নেই। এ পথে ঢুকতে হলে আপনাকে শেরাটন মোড় হয়ে বামের একটি সরু গলিতে ঢুকতে হবে। সেপথ দিয়ে শুধূু গাড়ি যায়ই না, আসেও। ফলে ঐটুকু সরু পথে রিকশা-গাড়ি-স্কুটারের ভিড়। পার হতে গলদঘর্ম। অথচ বন্ধ করে দেয়া প্রশস্ত রাস্তাটি খুলে দিলে এখানকার যানজট বহুলাংশে দূর হতে পারতো। তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের এই রাস্তা কেনো বন্ধ করে দেওয়া হলো, কে তার জবাব দেবে?
আর একটি উদাহরণ দিয়ে এই লেখাটি শেষ করতে চাই। সেটি হলো মিন্টো রোডের ভেতর দিয়ে মন্ত্রিপাড়ার প্রশস্ত সড়ক। নবনির্মিত সাতরাস্তা-রমনা থানা ফ্লাইওভার থেকে নেমে খানিক দূর এগিয়ে অফিসার্স ক্লাব বামে রেখে রাস্তাটি চলে গেছে ডান দিকে। শেরাটন হয়ে সোজা বেরিয়ে গেছে ভিআইপি রোডে। কেউ যেতে পারেন শাহবাগের দিকে, কেউ যেতে পারেন ফার্মগেটের দিকে। সপ্তাহ দুই আগে ফ্লাইওভার থেকে নেমে সে রাস্তায় ঢুকতে গেছি। দেখি কাাঁটাতারের বেড়া আর বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তারোধ করে উদ্যত সঙ্গীন হাতে দাঁড়িয়ে আছে ডজন দুই শান্ত্রী। বললো, কোথায় যাবেন? বললাম, এই পথ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাই। তাদের মধ্য থেকে একজন সামনে এসে বললেন, না, এই পথ দিয়ে যেতে পারবেন না। এই পথ দিয়ে যেতে পারবে, শুধু এসবি আর সিআইডি। সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। রাস্তা বন্ধ।
গাড়ি ঘুরিয়ে উত্তর দিকে সামনে এগিয়ে গেলাম। রমনা থানা ডাইনে রেখে পুলিশ কম্যুনিটি সেন্টারের সামনে দিয়ে এগিয়ে গেলাম। যদি সোজা যেতে পারতাম, তাহলে পড়তাম ভিআইপি রোডে। সেটি তো স্থায়ীভাবে বন্ধ। আবার বামের সেই সরু পথ ধরতে হলো। শেরাটনের পুব পাশের গোলচত্বরের সামনে এসে গাড়ির সমুদ্রের মধ্যে পড়লাম। ঐ ১০০ গজ পাড়ি দিতে ঘণ্টা দেড়েক লাগলো। কিন্তু এই রাস্তা বন্ধ রাখার খামখেয়ালির কি কোনো জবাবদিহিতা নেই?

পাদটীকা :
আমার পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক এসবি-সিআইডি পথের অভিজ্ঞতা বলছিলেন। তিনি আমার মতো পাতলা দুবলা নন। গাট্টাগোট্টা চেহারার হৃষ্টপুষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক। সঙ্গে জিপ গাড়ি। ব্যারিকেডের সামনে গিয়ে হাতের ইশারায় ডাক দিলেন এক পুলিশ সদস্যকে। বললেন, এই সব ঠিক আছে তো? পুলিশ সদস্যটি তাকে স্যালুট দিয়ে গেট খুলে দিলো। তিনি নির্বিঘ্নে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সহজ পথে পৌঁছে গেলেন। অর্থাৎ নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনিতে ফসকা গেরোটা রয়েই গেছে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads