বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০১৬

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ইইউ পার্লামেন্টের শুনানি


ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সের পর এবার বাংলাদেশ সম্পর্কে বিতর্কের পাশাপাশি দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তথা ইইউ পার্লামেন্টে। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় বিরামহীনভাবে চলতে থাকা গুপ্তহত্যা এবং মতপ্রকাশের ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ বর্তমান বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইইউ পার্লামেন্ট। সাম্প্রতিক বিভিন্ন সশস্ত্র হামলার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার এবং রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নয়নের জন্যও তাগিদ দিয়েছেন পার্লামেন্টের সদস্যরা। কয়েকজন সদস্য এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার আহ্বানও জানিয়েছেন। 
শুনানিতে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে বক্তব্য রেখেছেন নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইইউ পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান বার্ট কোয়েল্ডার্স। তিনি বলেছেন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়নের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউ-এর ভালো সম্পর্ক থাকলেও দেশটির উদ্বেগজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাখ্যাদানকালে মিস্টার বার্ট কোয়েল্ডার্স বলেছেন, পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের পর থেকে। তিনি আরো বলেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। এ উদ্দেশ্যে বাছবিচারহীন গ্রেফতার বন্ধ করার পাশাপাশি বাকস্বাধীনতা ও সব নাগরিকের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।  দেশটিতে চলতে থাকা সকল নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হতে হবে। দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেছেন, উদ্বেগজনক মানবাধিকার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরায় সংলাপে বসার সময় এসেছে। এসব বিষয়ে ইইউ যে অব্যাহতভাবে পরিস্থিতির নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে যাবে সে কথাও জানিয়েছেন বার্ট কোয়েল্ডার্স। 
গত কয়েক সপ্তাহের সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেদা বলেছেন, এসব হামলায় আক্রান্ত হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের পক্ষের লোকেরা। এ ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ইইউ পার্লামেন্টকে আহ্বান জানাতে বলেছেন তিনি। ওদিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ক প্রতিনিধি দলের ভাইস চেয়ারম্যান নিলা গিল বলেছেন, বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের পর আল কায়েদা ও আইএসসহ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সেগুলোর দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার এসব আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করে চলেছে। শুধু তাই নয়, সরকার নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোকে নির্বাচনী হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করছে।   
বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করে ইইউ পার্লামেন্টের সদস্যরা বলেছেন, আমরা দেশটিকে সহিংসতায় নিমজ্জিত হতে দিতে পারি না। তারা আরো বলেছেন, প্রধান বিরোধী দলগুলো ২০১৪ সালের  নির্বাচন বর্জন করায় দেশটিতে বড় ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় ইইউ-এর উচিত, ঢাকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনায় বসা এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সংলাপে বসার তাগিদ দেয়া। সরকারকে বলতে হবে দেশটিতে যেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বাছবিচারহীন গ্রেফতার বন্ধ করা হয়। না হলে বাংলাদেশ যে উগ্রপন্থার আঞ্চলিক শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হতে পারে সে ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছেন ইইউ পার্লামেন্টের সদস্যরা। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকদিনের ব্যবধানে ইইউ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কিত আলোচনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে বক্তব্যের বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও গুপ্তহত্যা ও ক্রমবর্ধমান সহিংসতা থেকে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার সম্ভাব্য পন্থা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পাশাপাশি পরামর্শও দেয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করে সরকার যে সব দোষ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা বিরোধী দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং এর ফলে বাংলাদেশে যে উগ্রপন্থার চরম বিকাশ ঘটার আশংকা দেখা দিচ্ছে সে সম্পর্কেও বলেছেন ইইউ পার্লামেন্টের সদস্যরা, যাদের মধ্যে নেদারল্যান্ডেসের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও রয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা দরকার, ক’দিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বার্ষিক রিপোর্টেও একই ধরনের বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। সুতরাং সব মিলিয়েই ধরে নেয়া যায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ একটি প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যার পেছনে সরকারের দায়দায়িত্ব এবং ভূমিকাই প্রধান। উল্লেখযোগ্য অন্য একটি বিষয় হলো,  সর্বশেষ উপলক্ষে ইইউ পার্লামেন্ট সদস্যরা বক্তব্য রাখলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ বিশ্বের কোনো দেশই এ পর্যন্ত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেয়নি। প্রতিটি রাষ্ট্র বরং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে- যাতে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। মঙ্গলবারের অধিবেশনে ইইউ পার্লামেন্ট সদস্যরাও একই আহ্বান জানিয়েছেন। তারা সেই সাথে ইইউকেও তাগিদ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসার জন্য। 
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পরপর ইইউ পার্লামেন্ট বলেছে এবং আমরাও মনে করি, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে গুপ্তহত্যা ও সহিংসতাসহ বাংলাদেশের সকল সংকট স্বল্প সময়ের মধ্যে কেটে যাবে এবং দেশ গণতান্ত্রিক, নিরপেক্ষ ও উদার দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারবে। অমন আশার ভিত্তিতেই আমরা ইইউ পার্লামেন্টের পরামর্শে সাড়া দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads