মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০১৬

ক্রসফায়ার : পরিচয় জানা নেই


আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়মুক্তি দেয়ার কারণে দেশে প্রতিদিন ঘটছে ক্রসফায়ারের ঘটনা। আমরা যতবার বলছি যে, অপরাধী যেই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় এনে বিচার করে শাস্তির বিধান করা হোক। কিন্তু এ পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বিনাবিচারে যে কাউকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে একটা যুক্তি খাড়া করা হয় যে, তার নামে থানায় বেশ কয়েকটি মামলা ছিল। থানায় মামলা থাকলেই সে অপরাধী হয়ে যায় না। আদালতে সেটা প্রমাণ করতে হয়। একথা হিসাবে ধরলে সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিরোধী দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে এক এক জনের নামে শ’য়ে শ’য়ে মামলা করেছে। তবে কি তাদের সকলকে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেবে সরকার?
পুলিশ নানা উদ্দেশ্যে মানুষকে হয়রানি করার জন্য মামলা করে। অধিকাংশ সময় মামলায় নামও থাকে না। কয়েকজনের নাম দিয়ে বলা হয়, আসামী অজ্ঞাত আরও কয়েক শ’ বা কয়েক হাজার। তারপর গ্রেফতার বাণিজ্যের জন্য তাদের কোনো মামলায় আসামী দেখানো হয়। কখনও কখনও আবার ধরা হয় সন্দেহবশত, ৫৪ ধারায়। আদালত থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও এই ৫৪ ধারার মারাত্মক অপব্যবহার করছে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে কাউকে তুলে নিয়ে গিয়ে সোজা অস্বীকার করে বসছে যে, ঐ নামে কাউকে তারা আটক করেনি। পরে তার লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কখনও কখনও পুলিশ এর কোনো দায় নিচ্ছে না। আবার কখনও কখনও বলছে ক্রসফায়ারে ঐ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এখন প্রতিদিনই এ রকম নিকৃষ্ট নজির সৃষ্টি হচ্ছে।
পুলিশের কথিত এমনই এক ক্রসফায়ারে গত ১৮ তারিখে মারা গেছেন সাতক্ষীরার মুকুল রানা নামের এক যুবক। তার হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পুলিশের দাবি অদ্ভূত। তাদের ভাষ্য হলো, ১৮ জুন দিবাগত রাতে তিনজন মোটর সাইকেল আরোহীকে সন্দেহ করে চ্যালেঞ্জ করলে গুলী বিনিময়ের ঘটনায় ঐ ব্যক্তি (মুকুল রানা) নিহত হন। দেখা গেছে, মুকুলের দেহে ১০টি গুলীর ছিদ্র রয়েছে। তবে মোটর সাইকেলের অন্য দুই আরোহীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এটা কি কোনো বিশ্বাসযোগ্য কথা? মোটর সাইকেলের আরোহী তিনজন। তারা পুলিশের দিকে গুলী করল। আবার পুলিশও তাদের দিকে এলামেলো গুলী চালালো। আর তাতে নিহত হলেন শুধু মুকুল রানা। শুধু তার শরীরেই পুলিশের ছোঁড়া ১০টি গুলী লাগলো। আর বাকি দু’জন নির্বিঘ্নে অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে চলে গেলেন? আবার পুলিশ যাদের লক্ষ্য করে গুলী ছঁড়লো, তাদের মধ্যে কে অপরাধী ছিল, তা পুলিশ জানতো না। তাহলে শুধু মুকুল রানার গায়েই লাগলো ১০টি গুলী? নাকি খুব কাছে থেকে মুকুল রানার গায়ে গুলী ছুঁড়ে তাকে ঝাঁজরা করে দেয়া হলো?
এখানে এর চাইতেও বড় প্রশ্ন হলো, পুলিশ কাকে ক্রসফায়ারে দিল, তার সঠিক পরিচয়ও তারা জানতো না। ব্লগার অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের তারা একটি কিনারা করতে পেরেছে, এমন বাহাদুরি নেয়ার জন্যই কি মুকুল রানাকে খুন করা হলো? ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেছেন, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে ঐ ব্যক্তির নাম যে মুকুল রানা, তা তারা জানতেন না। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী তারা নিশ্চিত যে, মুকুল রানা আনসারউল্লাহ বাংলা টীমের (এবিটি) সামরিক শাখার শীর্ষ নেতা ছিলেন। পুলিশ বলেছে, তার অনেকগুলো নাম ছিল। আর সেগুলো হলো, সাকিব ওরফে শরীফ, ওরফে সালেহ, ওরফে আরিফ, ওরফে হাদি-১। কিন্তু তার প্রকৃত নাম যে মুকুল রানা সেটাই পুলিশ জানতো না। আর তাকে হত্যার পর যে গল্প ফাঁদা হলো, সেটারও কোনো বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি নেই। পুলিশ বললো, তাদের ভাষায় এই শরীফুল ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে টিএসসি এলাকায় নিহত অভিজিৎ রায়ের হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অতএব বিচারের দরকার নেই। তাকে গুলী করে মেরে ফেলা যায়। এই ভাবনাটা একেবারেই আদিম সমাজের। কোনোভাবেই সভ্য সমাজের নয়।
কিন্তু প্রকৃত সত্য ভিন্ন। মুকুল রানার বাড়ি সাতক্ষীরার ধূলিহর ইউনিয়নের বালুইগাছা গ্রামে। তার শ্বশুরবাড়ি যশোরের বসুন্দিয়ার জগন্নাথপুরে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি স্ত্রী মহুয়া আক্তারকে সঙ্গে নিয়ে ভ্যানে করে বাড়ি থেকে বসুন্দিয়া বাজারে আসছিলেন। বসুন্দিয়া মোড়ে পৌঁছলে ১০-১২ জন লোক হঠাৎ করে রিকাশা ভ্যানের সামনে এস মুকুলকে জাপটে ধরে। এ সময় তার স্ত্রী মহুয়া দৌড়ে পাশের দোকানে গিয়ে বাড়িতে ফোন করেন। ভ্যানচালক জানান, ঐ লোকগুলো মুকুলের দুই হাতে হাতকড়া পড়ায়। কোনো কথা বলার আগেই তারা মুকুলকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে যায়। মুকুল এই ঘটনার মাত্র তিন দিন আগে মহুয়াকে বিয়ে করেন। ঘটনার দুদিন পর মুকুল রানার শ্যালক আমীর হোসেন যশোরে কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর থেকে মুকুল কোথায় কীভাবে আছেন, তারা তা জানতে পারেননি।
মুকুলের বাবা জানান, ১৯ তারিখে ছেলের বিয়ে হয়। ২০ তারিখ বৌভাতের পর ছেলে ও ছেলের বৌয়ের সঙ্গে তিনি জগন্নাথপুর যান। ঘটনার দিন ছেলে তাকে আগেই রওয়ানা হতে বলেন। তিনি যশোরের কেশবপুরে পৌঁছনোর পর তাকে জানানো হয়, তার ছেলেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। তিনি মুকুলের শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে মামলা করার পরামর্শ দেন। তিনি জানতে পারেন, মুকুলের খোঁজে তার শ্যালক মুজিবুর রহমান বিশ্বাস ঢাকায় গেছেন। পরে শোনেন, মুজিবুরকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
এ বিষয়ে পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, গত ১৯ মে ‘জননিরাপত্তার স্বার্থে এদের ধরিয়ে দিন’ শিরোনামে বিজ্ঞপ্তি সব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারের পরও কেন তার পরিবারের তরফ থেকে কোনো খোঁজখবর করা হয়নি? সেখানেও তো শরীফুলের (মুকুল রানা) ছবি ছিল। তার অর্থ কি এই নয় যে, প্রকৃত পরিচয়হীন মুকুল আগে থেকেই পুলিশের হেফাজতে ছিল? তার পরিবার যোগাযোগ করলে হয়তো তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হতো না। কেন মুকুলের পিতা আবুল কালাম আজাদ ছবি প্রকাশের পরও খোঁজ-খবর করেননি, সে সম্পর্কে আজাদ বলেন, তার ছেলের নাম তো শরীফুল নয়। আর আমি জানি, তাকে ডিবি তুলে নিয়ে গেছে। তাহলে আবার কেন তাকে ধরিয়ে দিতে ছবি ছাপা হবে, সেটা নিয়ে আমি দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। আর মুকুলকে ডিবি তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি সাতক্ষীরার প্রভাবশালী লোকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। সাতক্ষীরার অবস্থা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিরীহ মানুষ ভয় পায়।
জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানে যুক্ত ডিবির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার এক পত্রিকাকে বলেছেন, নিহত শরীফুল (মুকুল রানা) যে অভিজিৎ হত্যায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই ভিডিও ফুটেজ পুলিশের কাছে আছে।
তিনি বলেন, ভিডিও ফুটেজের অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার অংশগুলো ‘তদন্তের স্বার্থে’ প্রকাশ করা হচ্ছে না। তাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত আরও যে খুনিরা আছেন, তারাও পালিয়ে যেতে পারেন। তিনি বলেন, শরীফুলের (মুকুল রানা) সঙ্গে মহুয়ার বিয়ের সম্বন্ধ করেন মহুয়ার ভাই মুজিবুর। তাকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন তিনি কারাগারে আছেন। মুজিবুর আনসারউল্লাহ বাংলা টীমের দাওয়াতি শাখার সদস্য। তিনি পেশায় একজন ইউনানি চিকিৎসক। যেসব রাসায়নিক সবাই কিনতে পারেন না, সরকারি নিবন্ধনভুক্ত ইউনানি চিকিৎসকেরা সেগুলো কিনতে পারেন। এসব রাসায়নিক দিয়ে বিষ্ফোরক বানানো সম্ভব। ঐ কর্মকর্তা সম্ভবত এই সুযোগে বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিলেন। কারণ ইউনানি চিকিৎসা গাছগাছড়া-নির্ভর
তবে এখানে ঘটলো আরও একটি গোঁজামিলের ঘটনা। নিহত ব্লগার অভিজিতের বাবা ড. অজয় রায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রতিক্রিয়ায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, এখানেও পুলিশ এক ধরনের নাটকের আয়োজন করলো। কারণ এর আগে পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে, অভিজিতের হত্যাকারীদের সবাই বিদেশে চলে গেছেন। এখন আবার কোথা থেকে তার একজনের সন্ধান মিললো। সে কি পুলিশের ক্রসফায়ারের শিকার হওয়ার জন্যই বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এসেছিল? আবার পুলিশ এটা পর্যন্ত জানতে পারলো যে, শরীফুলের (মুকুল রানা) সঙ্গে মহুয়ার বিয়ে ঠিক করে দিয়েছে মহুয়ার ভাই মুজিবুর। এত কিছু জানার পরও তার প্রকৃত নাম যে মুকুল রানা এই কথাটিই জানতে পারেনি আমাদের অতি দক্ষ পুলিশ বাহিনী। অথচ পরিবারের পক্ষ থেকে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে এসে লাশ নিয়ে গেছে। তার ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর পুলিশের এখন আবার একটি বাক্যবিন্যাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর তা হলো, ‘তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাবে না।’ এরা এসব কথা সকল ক্ষেত্রেই বলতে শুরু করেছেন। বলতে বলতে মনে হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে তারা শুধু বাগাড়ম্বরই করছেন, কাজের কাজ কিছুই করতে পারছেন না। কিংবা তারা আদপেই কিছু জানেন না।
এতে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে, মুকুল রানা পুলিশের হেফাজতেই ছিলেন। ইচ্ছা করেই বা ভুল করে তাকে শরীফুল বলে আটক রেখেছিল পুলিশ। আর ‘মোটরসাইকেলে করে পালানোর সময়’ পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে যে তিনি মারা গেলেন, সেটাও শেষ পর্যন্ত কাউকে বিশ্বাস করাতে পারবে না পুলিশ। এভাবে তার ক’দিন আগে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে কলেজ ছাত্র দক্ষিণখানের ফাহিম। এটাও কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউই বিশ্বাসও করেননি।
তবে পুলিশের ভাষায়ও চমৎকার পরিবর্তন এসেছে। যেমন গতকাল পুলিশের এক কর্মকর্তা উপকমিশনার আবদুল বাতেন বলেছেন, জঙ্গিচক্র হাঁড়ি নয় যে ভেঙে ফেলা যাবে। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ঈদে বাড়িতে যেতে নিজ নিজ ঘর নিরাপদ রেখে যাবেন। পুলিশ ঘরে ঘরে নিরাপত্তা দিতে পারবে না।
খুলনার ডিআইজি মনির-উজ জামান বলেছেন, আমরা জানি কীভাবে দেশ শাসন করতে হয়। অর্থাৎ পুলিশ সেবকের নয়, একেবারে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গেছে। এটা কোনো অবস্থাতেই শুভ লক্ষণ নয়। এই পরিস্থিতি সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় নেবে বলে মনে হয় না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads