মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০১৬

কামদা প্রসাদের তেলেসমাতি


কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও ভিক্টোরিয়া কলেজের নিহত ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত টীমের প্রধান কামদা প্রসাদ সাহা দ্বিতীয়বার আর একটা ভেলকিবাজি দেখিয়ে দিলেন। তনু খুন হয়েছে গত ২০ মার্চ কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের সুরক্ষিত এলাকার ভেতরে। রাত সাড়ে দশটায় তনুর বাবা তাদের সেনানিবাসস্থ বাসার কাছে একটা ঝোপের মধ্যে দেখতে পান মেয়ের লাশ। মাথার পেছন দিকটা থেতলানো। নাকে-কানে আঘাত ও রক্তের দাগ। সালোয়ার-কামিজ ছেঁড়া। সারা শরীরে আঁচড়ের চিহ্ন। তার লম্বা চুলের গোছা ছিল কাটা। লাশ পড়ে ছিল রক্তাক্ত অবস্থায়। প্রথমে তনুকে নেওয়া হয় সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। তারপর রাত আড়াইটার দিকে তাকে নেওয়া হয় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে, ময়না তদন্তের জন্য।
কামদার অচিকিৎসকসুলভ তৎপরতা শুরু হয় তখন থেকেই। তনুর প্রথম দফা ময়না তদন্ত হয়েছিল গত ২১ মার্চ। সে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য এই কামদা দায়িত্ব দিয়েছিলেন কলেজের অনভিজ্ঞ তরুণ লেকচারার ডা. শারমিন সুলতানাকে। কিন্তু রিপোর্ট দাখিল করতে তিনি দীর্ঘসূত্রিতার আশ্রয় নেন। এবং দু’ সপ্তাহ পরে ৪ এপিল তিনি একটি দায়সারা রিপোর্ট দেন। তাতে এই তনু হত্যাকাণ্ডের কোনো কারণ নির্ণয় করতে পারেননি শারমিন। তিনি হত্যাকাণ্ড না বলে মৃত্যু বলেছেন।  একেবারে পরিষ্কার রিপোর্ট। তার ‘মৃত্যু’র কারণ নির্ণয় করা যায়নি। তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্নও পাননি শারমিন। যেটুকু পাওয়া গিয়েছিল, তা নাকি মৃত্যু ঘটার জন্য যথেষ্ট নয়। তনু মত্যুর আগে ধর্ষিত হয়েছিল-এমন কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি। তাছাড়া শরীরে কোনো বিষক্রিয়ারও সন্ধান পাননি শারমিন সুলতানা। এ ধরনের একটি দায়সারা রিপোর্ট লেখার জন্য ডাক্তারের প্রয়োজন ছিল না। সে রিপোর্ট দেখে মনে হবে, কোনো চিকিৎসক নয়, ময়না তদন্ত রিপোর্টটি যেন লিখেছে ঘাতক নিজেই।
এ বিষয়ে কামদা সাহাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন। কামদা বলেছিলেন, শারমিন সুলতানার ‘অনভিজ্ঞতা’র কারণে এটা ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয় যে, কামদা প্রসাদ কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন। সেনানিবাসের ভেতরে একজন অনার্স পড়ুয়া তরুণী খুন হলো, তার তদন্তভার কামদা দিলেন এক অনভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। কেন? আবার এই রিপোর্ট জমা দিতেইবা শারমিন বা কামদা কেন দু’সপ্তাহ লাগালেন। অর্থাৎ প্রথম থেকেই কামদা বিষয়টি নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ডা.(?) শারমিনের রিপোর্ট মানলে এই দাঁড়ায় যে, তনুকে কোনো মানুষ বা ভূতে মারেনি। তনু এমনি এমনি খারাপ ‘বাতাস লেগে’ মরে গেছে। অথচ ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকের দায়িত্বই হলো হত্যাকাণ্ডের কারণ উদ্ঘাটন করা।
এভাবেই দায় সেরে পার পেয়ে যেতে চেয়েছিলেন কামদা প্রসাদ সাহা। কিন্তু আদালত তনুর লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়না তদন্তের নির্দেশ দেন। কামদার কেরামতিতে তখনও তনুর প্রথম ময়না তদন্ত রিপোর্টই প্রকাশিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত ৩০ মার্চ আবারও ময়না তদন্তের জন্য তনুর লাশ কবর থেকে তোলা হয়। আর আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, এবারও ময়না তদন্তের দায়িত্ব গিয়ে পড়ল ঐ কামদা প্রসাদ সাহার ওপরই। কর্তৃপক্ষ কোন্্ বিবেচনায় ধরে নিলেন, যে কামদার তত্ত্বাবধানে কোনো আলামত পাওয়া গেল না বলে শারমিন রিপোর্ট দিলেন আর কামদা তা অনুমোদন করলেন, তাদের দিয়ে তদন্ত করালে নতুন বা বিপরীত কিছু বেরিয়ে আসবে বা আলামত পাওয়া যাবে? প্রশ্ন তখনই উঠেছিল। সংশয় ছিল, এই কামদা গং-এর কাছ থেকে কোনো সঠিক রিপোর্ট পাওয়া যাবে না।
সংবাদপত্রে লেখালেখি হয়েছিল যে, তনুর দ্বিতীয় ময়না তদন্ত করা উচিত অধিকতর দক্ষ চিকিৎসক ও সাজসরঞ্জামসম্পন্ন কোনো হাসপাতালে। আর তার জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এই ঢাকা মেডিক্যালে প্রায় তিন মাস পর লাশ তুলেও মৃত্যুর সঠিক কারণ ও ধর্ষণের আলামত নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় তনুর দ্বিতীয় ময়না তদন্ত রিপোর্ট তৈরির দায়িত্বও দেওয়া হলো ঐ কামদা প্রসাদের হাতেই। এবার ময়না তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করার কমিটিতে থাকলেন কামদা প্রসাদ সাহা, গাইনি বিভাগের প্রধান করুণা রানী কর্মকার ও ফরেনসিক মেডিসিনের প্রভাষক মোহাম্মদ ওমর ফারুক।
আর এর প্রথম দিন থেকেই কামদা নানা নাটক শুরু করলেন। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, কামদা আর দ্বিতীয় ময়না তদন্তের রিপোর্টটি জমা দেন না। কী পাওয়া গেল তাতে, তা নিয়ে নানা বাহানা ও ভড়ং তৈরি করতে থাকেন। এর মধ্যে তনুর পরনের কাপড় ও দাঁত-নখের ডিএনএ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায় হত্যার আগে অন্তত তিন ব্যক্তি তনুকে ধর্ষণ করেছে। এবার কামদা প্রসাদ বলতে শুরু করেন যে, ডিএনএ রিপোর্ট তার কাছে জমা না দিলে তিনিও ময়না তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবেন না। অথচ ডিএনএ রিপোর্টের সঙ্গে ময়না তদন্ত রিপোর্টের বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই। তদন্তকারীরা নিয়মানুযায়ী ডিএনএ রিপোর্ট আদালতে জমা দেন। তদন্তকারীরা বললেন, আদালত চাইলে তনুর ডিএনএ রিপোর্ট কামদা প্রসাদকে দেয়া যেতে পারে। পরে আদালত ডিএনএ রিপোর্ট কামদাকে দিতে তদন্তকারীদের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী কামদা বেশ সময় নিয়ে দ্বিতীয় ময়না তদন্ত রিপোর্টটি প্রকাশ করেন।
এর জন্য কামদা প্রসাদ সাহা সময় নেন প্রায় আড়াই মাস। এটি গাফিলতি ও দায়িত্বে চরম অবহেলা। এবারও মেডিক্যাল বোর্ড তনুর মৃত্যুর কোনো কারণ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ যে হবেই, তা যেদিন এই লোকগুলোকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।  গত ১২ জুন কামদা সিআইডির কাছে রিপোর্ট জমা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ১০ দিন পর কবর থেকে তোলা লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় মত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি। পারিপার্শ্বিক নানা অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে পুলিশকে আরও অধিক তদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। এর আগে ডিএনএ পরীক্ষার বরাত দিয়ে সিআইডি বলেছিল, তনুকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু কামদার জমা-দেওয়া ময়না তদন্ত রিপোর্টে ধর্ষণের উল্লেখ নেই। এতে বলা হয়েছে মত্যুর আগে তনুর সঙ্গে যৌন সংসর্গ হয়েছিল। এ নিয়ে এক ধরনের মশকরা করেন কামদা প্রসাদ ও ওমর ফারুক। যৌন সংসর্গটা ধর্ষণ কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে রহস্যজনক জবাব দেন কামদা। বলেন, ‘সেটা আপনারা বুঝে নেন।’ এখানে ওমর ফারুক আবার ব্যাখ্যা করে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, ‘ইন্টারকোর্স আর রেপ এক জিনিস নয়। স্যার ইন্টারকোর্স বলেছেন। ব্যাস।’
তারপরও সাংবাদিকরা জানতে চান, তনুর সম্মতিতেই যদি সংসর্গ হয়ে থাকে, তবে তাকে খুন করা হলো কেন। কামদা গং এ প্রশ্ন এড়িয়ে যান। একইভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, যৌন সংসর্গের আলামত পাওয়া গেল দ্বিতীয় ময়না তদন্ত রিপোর্টে, তাহলে মৃত্যুর কারণ পাওয়া গেল না কেন? এরও কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি কামদা সাহা। তিনি বলেন, ডিএনএ রিপোর্ট দেখে তিনি এটা নিশ্চিত হয়েছেন। এখানে আরও একবার চিকিৎসক হিসেবে তার অযোগ্যতাই প্রমাণিত হয়। তিনি নিজের অযোগ্যতা ঢাকা দিতে অপরের মুখে ঝাল খাওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি আরও বলেন, ‘মেডিক্যাল টার্মে ধর্ষণ বলে কিছু নেই। ডাক্তারেরা ধর্ষণ বলে না। ডাক্তারেররা বলে ইন্টারকোর্স। আমরা কখনও ধর্ষণ বলি না।’ এ সম্পর্কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সাবেক প্রধান হাবিবুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ধর্ষণের ঘটনা হলে ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ‘জোরপূর্বক যৌন সংসর্গ’ লেখা হয়ে থাকে। এখানেও মিথ্যার আশ্রয় নিলেন কামদা।
কামদার এই রিপোর্টের পর জনমনের ক্ষোভ প্রশমিত হবে না। দেশের অভিজ্ঞ চিকিৎসকরাও এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক পরামর্শক ও বর্তমানে ভারত, নেপাল ও সুদানের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন অব ল মেডিসিন অ্যান্ড সায়েন্সের ভাইস-প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডাক্তার মোজাহেরুল হক বলেছেন, যদি শরীরের কোনো অংশে বিশেষ করে হাড়ে কোনো ইনজুরি থাকে, তা হলে তৃতীয় দফা ময়না তদন্ত করে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। তবে অন্য কোনো ইনজুরির ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।
এই রিপোর্ট প্রকাশের পর তনুর মা আনোয়ারা বেগম ময়না তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন ‘ডাক্তাররা মিথ্যা কথা বলেছে। তনুর পিঠে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথার পেছন দিক ও নাক থেতলানো ছিল। কবর থেকে যখন ওর লাশ তোলা হয়, তখন সেটি ফোলা ছিল। তেমন কোনো বিকৃতি হয়নি।’ আনোয়ারা বেগমের প্রশ্ন, ‘সুস্থ সুন্দর মেয়েটি কি কোনো কারণ ছাড়াই মারা গেল? ওরে কি জিনে মেরেছে?’ এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘দীর্ঘসূত্রিতা ও কালক্ষেপণ করে ন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। তনু হত্যা ও প্রথম ময়না তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ ছিল। দ্বিতীয় ময়না তদন্ত রিপোর্টেও সেই সন্দেহ দূর হয়নি। মনে হচ্ছে স্বেচ্ছায় হোক কিংবা হুমকি বা চাপের মুখে আমরা সত্য প্রকাশে কুিণ্ঠত হচ্ছি। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।’ এ প্রসঙ্গে নাট্যজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্তে এই অস্পষ্টতা খুবই হতাশাজনক। এতে চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘যৌন সংসর্গ আর ধর্ষণ বা বলাৎকার সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধর্ষণ অপরাধ। ডাক্তারি ভাষা আর আইনি ভাষার বিতর্কে আমরা যেতে চাই না। আমরা চাই সত্য উদ্ঘাটন ও ন্যায়বিচার। ডাক্তারদের প্রতি অনুরোধ নিজ পেশার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সত্য উদ্ঘাটন করুন।’
কামদা প্রসাদ সাহার দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের আগেই সিআইডি অবশ্য বলেছিল যে, তারা অপরাধীদের চিহ্নিত করে ফেলেছে। এখন ওপরের মহলের সহযোগিতা পেলেই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। সেই সহযোগিতা কি কোনো দিন পাওয়া যাবে?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads