শনিবার, ৪ জুন, ২০১৬

বেপরোয়া সন্ত্রাস


বিশ্বের স্বৈরতান্ত্রিক ও সন্ত্রাসকবলিত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মতোই গত আট-দশ বছরে আমাদের রাজধানী ঢাকা মহানগরসহ দেশের প্রায় সব শহর-বন্দর, অলি-গলি, গ্রাম-গঞ্জ, হাট-বাজার এমনকি পাড়া-মহল্লায় পর্যন্ত কিশোর-তরুণ উঠতি সন্ত্রাসীদের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। বলতে গেলে, দেশব্যাপী এই সন্ত্রাসীদের দাপট ও আধিপত্য ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। এই সন্ত্রাসীদের গড় বয়স ১৬ থেকে ১৮-১৯ বছরের মধ্যে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ, নারী ধর্ষণ ও সর্বনাশা মাদক ব্যবসার মতো ভয়ংকর অপরাধে তারা জড়িয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। তাদের গডফাদার-মাফিয়া ডনরা হয়ে আছে নেপথ্যে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী, দাগী অপরাধী ও সমাজের একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মহল। এই সন্ত্রাসী-লুটেরা চক্রই এ তরুণদের বিপথগামী করে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলছে এবং এদের দিয়েই এলাকার আধিপত্য বিস্তারসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। উঠতি বয়সী এসব সন্ত্রাসী যে কোন অপরাধমূলক কাজ করতে কিছুতেই ভয় করে না। বিগত বছরগুলোতে দৈনিক সংগ্রামসহ সবগুলো জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য প্রতিবেদনে এমন উঠতি সন্ত্রাসীদের ভয়ংকর সন্ত্রাসী ঘটনার খবর উঠে এসেছে। দেশব্যাপী এই উঠতি সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কাছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সারা দেশে প্রভাবশালী সন্ত্রাসীরা নতুন নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে তোলায় এবং তালিকাভুক্ত না হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও তাদের সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য নেই। এর ফলে দেশের যে কোন থানা এলাকায় যে কোন সন্ত্রাসী ঘটনা কিংবা যে কোন অপরাধমূলক ঘটনা সংঘটিত হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে পুলিশ কার্যকরভাবে কোন ব্যবস্থাই নিতে পরছে না। তাদের পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের তালিকায় খুঁজতে হয়। মাঝে মাঝে এসব উঠতি সন্ত্রাসী পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বের হয়ে আসে তাদের সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে পড়ার নানা কাহিনী। কেউ বস্তির, কেউ টোকাই থেকে পেটের ক্ষুধা নিবারণে, কেউ পাড়া-মহল্লার বখাটেদের পাল্লায় পড়ে, কেউ কেউ চোর-ডাকাত, ছিনাতাইবাজ, চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী কথিত বড় ভাইদের খপ্পরে পড়ে, আবার কেউ কেউ নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে পড়েছে এবং এখনো পড়ছে।
এ দেশের কোন বিবেকবান নাগরিকই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, গত আট-দশ বছর ধরে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যেমন অগণতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক সন্ত্রাসী লুটেরা কার্যক্রমের অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে, ঠিক তেমনি সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং দারিদ্র্য ও বেকারত্বের হতাশাও লাখ লাখ তরুণকে বিপথগামী করে তুলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এমনকি জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ তরুণদের এ অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ব্যবহার করছে। এ কথাটাও কেউ অস্বীকার করেন না যে কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের পেছনে প্রভাবশালী কোন না কোন মহলের যোগসূত্র থাকে। নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও সেই সাথে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও টেন্ডারবাজি, কমিশনবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় এবং অবৈধ মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক ঘৃণ্য কর্মকা- নির্বিঘেœ পরিচালনা করতে তারা নানা ধরনের সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে। কক্সবাজার, ফেনী ও ময়মনসিংহের জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলার খবরও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সবাই জেনে গেছে। আবার এ অভিযোগও চলে আসছে, কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর বিশেষ দলবাজ অসৎ সদস্য এসব সন্ত্রাসী বাহিনীকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। সমাজের এক বিশেষ শ্রেণীর প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দলবাজ অতি উৎসাহী সদস্যদের মদদ ছাড়া দাগি হোক আর উঠতিই হোক কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ বা বাহিনী গড়ে ওঠা আদৌ সম্ভব নয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে উঠতি সন্ত্রাসীদের নানা বাহিনী গড়ে ওঠার পেছনে এটিই প্রধান কারণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা বিশাল তরুণ সমাজের একটি অংশকে সন্ত্রাসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই ভারসাম্যহীনতা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, একটি বিশেষ ক্ষমতাশালী দুর্নীতিবাজ লুটেরা শ্রেণী অগাধ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে গেছে, অপরদিকে দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী সর্বহারা শ্রেণীতে পৌঁছে গেছে। দেখা গেছে, দারিদ্র্য, লাঞ্ছিত এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কিশোর-তরুণরাই সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের সীমাহীন দারিদ্র্য, অভাব-অনটন ও বেকারত্ব এবং তারুণ্যের নানা কৌশলে কাজে লাগাচ্ছে, দেশ্রপ্রমিক নামধারী শীর্ষ সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালী লুটেরা চক্র। দেশে যদি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা কায়েম থাকে, যদি সুষমভাবে অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য বজায় থাকে, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, রাজনীতির নামে অপরাজনীতি, দলবাজি, দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ হয়, তাহলে যেসব তরুণকে সন্ত্রাসীরা এতোদিন তাদের দলে ভেড়াচ্ছিল, তরুণরাই তাদের ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করতো। এখন যেসব তরুণ সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, দেখা যাবে, এক সময় এরাই শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত হচ্ছে। সচেতন মহল এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেখেছেন, গ্রামে কুঁড়েঘর বা শহরের বস্তির ঘরে জন্ম নেয়া টোকাই, হোটেল বয়, বাসা-বাড়ির চাকর ও কুলি থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ের উঠতি বা দাগি চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পেছনের শক্তির কথা যদি বিবেচনা করা হয়, তবে শাসক দলের সাথে সম্পৃক্ত কোনো না কোনো প্রভাবশালী নেতার এবং নেতা নামধারী সন্ত্রাসীদের মদদের বিষয়টি উঠে আসা অস্বাভাবিক নয়। নিজ নিজ এলাকার চুরি-ডাকাতি, লুটপাট, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জালিয়াতি, প্রতারণা, দখলবাজি, কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ আধিপত্য বিস্তারে উঠতি সন্ত্রাসীদের তারা ব্যবহার করে। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে এই সন্ত্রাসীরাই হয়তো নতুন শাসক দলের কর্মী-ক্যাডারদের হয়ে কাজ করবে। সন্ত্রাসীদের ধর্মই এমন, তাদের নির্দিষ্ট কোনো দল নেই। তারা সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিত হয়।
সারা দেশে উঠতি সন্ত্রাসীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে কেন বেড়ে চলেছে, এ বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা বড় বেশি প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
এ ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেই আইনানুগ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাস দমনের নামে যাকে তাকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে গ্রেফতার বাণিজ্য করা উচিত হবে না। শুধু সন্ত্রাসীকে ধরলে হবে না, তাদের কথিত বড় ভাই নামের প্রকৃত সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদেরও ধরতে হবে, তারা যাতে ছাড়া না পায় এবং শাস্তির মুখোমুখি হয়, এমন ব্যবস্থাই করতে হবে। দেশের তরুণ শ্রেণী কেন এবং কারা কারা সন্ত্রাসের সাথে জড়াচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এর মূলে যেতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের কল্যাণে সচেতনমূলক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পুুলিশের খাতায় নাম নেই বলে উঠতি সন্ত্রাসীসহ শাসক দলের কথিত নেতা-কর্মী-ক্যাডার নামধারী সন্ত্রাসীদের দমনে হিমশিম খেতে হচ্ছে, খোদ পুলিশের এমন কথা আদৌ গ্রহণযোগ্য হয় কি? পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে তরুণ শ্রেণীর ধরন ও বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করে সে অনুযায়ী শৃঙ্খলাবৃত্ত গড়ে তুলতে হবে। শুধু শাসক দলের এক শ্রেণীর তথাকথিত নেতা-কর্মী-ক্যাডার নামধারী  চোর-ডাকাত, ছিনতাইবাজ, চাঁদাবাজ, জালিয়াত, দখলবাজ, কমিশনবাজ, প্রতারক, মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের সাথে যোগাযোগ করে এলাকার খবর নেয়া উচিত হবে না, সমাজের সাধারণ মানুষের সাথে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলাই হবে উত্তম কাজ। এলাকায় কারা প্রভাবশালী, জালিয়াত, দখলবাজ, ছিনতাইবাজ, চাঁদাবাজ, মাদক চোরাকারবারি ও সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসের গডফাদার, এ বিষয়গুলো সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একান্ত কর্তব্য কাজ বলেই আমরা মনে করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads