শুক্রবার, ৩ জুন, ২০১৬

‘হাইব্রিড’ বাজেটে ‘হাওয়াই চপ্পল’ সমাচার


রাজস্ব আদায়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য মাত্রা নিয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি। মূলত ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত এ বাজেটের প্রায় ২৯ শতাংশই ঘাটতি বা ঋণনির্ভর। বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী ২ মে জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এ প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন। একই সঙ্গে চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ও অর্থবিল ২০১৬ সংসদে উপস্থাপন করেন তিনি।
প্রস্তাবিত এ বাজেটকে শুভঙ্করের ফাঁকি বলেই মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। নতুন বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর বাজেট পর্যালোচনায় পরস্পর বিরোধী মন্তব্য করতে শোনা যায়। সরকার পক্ষ তো ঘোষিত বাজেটকে জনবান্ধব হিসাবে আখ্যা দিতেই পুলকবোধ করেন। বিরোধীদের পক্ষে বলা হয় গণবিরোধী বাজেট। আর এবারও তার কোন অন্যথা হয়নি। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছে গতানুগতিক পন্থায়। কিন্তু ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকার এই ঘাটতির বাজেটে কিভাবে ঘাটতি পূরণ করা হবে তার কোন যুৎসই ও গ্রহণযোগ্য দিক নির্দেশনা নেই। সার্বিক দিক বিবেচনায় ঘোষিত বাজেটকে গণমুখী বলার তো সুযোগ নেই-ই বরং অর্থমন্ত্রীর কথামালার মারপ্যাচে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থই উপেক্ষিত হয়েছে। সংরক্ষিত হয়েছে শ্রেণি স্বার্থ। ঘোষিত বাজেটে দেশের নেতিবাচক রাজনীতির কুপ্রভাব মুক্ত রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রস্তাবিত বাজেট তো গণমুখী হয়নি বরং নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য অনেকটা দুঃস্বপ্ন হিসেবেই আবির্ভূত হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে দেশীয় তৈরি বিস্কুট, কেক, বিভিন্ন ধরনের পেপার, পেপার প্রোডাক্ট, জিপি শিট, সিআই শিট, রঙিন শিটসহ বিভিন্ন ধরনের এমএস প্রোডাক্টের নির্ধারিত ট্যারিফ মূল্য ২০ শতাংশ আছে। নতুন বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। বর্ধিত হার কার্যকর হলে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে অনেকটাই। সবচেয়ে বেশি ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে সিগারেট, জর্দা ও গুলে। একই সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে বিড়ির। এতে করে ওই সব পণ্য আগের চেয়ে আরও বেশি দামে কিনতে হবে। গরিবের ব্যবহৃত হাওয়াই চপ্পলের ভ্যাট সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। তাই অনেকেই ঘোষিত বাজেটকে ‘হাওয়াই চপ্পল সমাচার’এর বাজেট হিসাবেই আখ্যা দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হার্ডবোর্ড, বৈদ্যুতিক জেনারেটর, সাধারণ জনগণের খাবার পাউরুটি, বনরুটি ইত্যাদি পণ্যের জন্য ভ্যাটে যে বিশেষ ছাড় আছে তা তুলে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। এ প্রস্তাব কার্যকর হলে গরিবের ব্যবহৃত ওই সব পণ্যের দাম বাড়বে। ফলে প্রস্তাবিত নতুন বাজেট বাস্তবায়িত হলে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লেও মূল্যস্ফীর্তি ঘটবে ব্যাপকভাবে। যা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অসহনীয় হয়ে উঠবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে কয়েকটি পণ্যের স্থানীয় পর্যায়ে ও আমদানিতে শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও রেগুলেটরি ডিউটি কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে শুল্ক-কর কমানোর প্রেক্ষিতে কিছু পণ্যের দাম কমবে।এর মধ্যে হাইপ্রিড গাড়ি, মোটরসাইকেল, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র অন্যতম। এছাড়াও প্রস্তাবিত বাজেটে দাম কমবে সিমেন্ট, পাথর, ওয়াইফাই, পেট্রোলিয়াম জেলি ও কয়লার। এসবের সাথে সাধারণ মানুষের তেমন কোন সম্পর্ক নেই।ফলে ঘোষিত বাজেটে শ্রেণি বিশেষের স্বার্থই সংরক্ষিত হয়েছে। তাই অনেকেই ঘোষিত বাজেটকে ‘হাইব্রিড বাজেট’ হিসেবেই আখ্যা দিচ্ছেন।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় তা বাস্তবায়নে সংশয় প্রকাশ করেছেন অভিজ্ঞমহল। আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে যে কৌশল ধরা হয়েছে তা সংশয়পূর্ণ বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। গত ২ জুন রাজধানীতে সিপিডির পক্ষে সংস্থাটির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এমন হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, দুই শতাংশ বাড়তি আয় ও বাড়তি ব্যয় কোথায় হবে তা স্পষ্ট নয়।
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘যে কৌশলে এটি বাস্তবায়িত হবে এবং সেই কৌশলকে কার্যকর করার জন্য, দক্ষতার সাথে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার দরকার পড়ে, সেগুলোর ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর চিন্তা-ভাবনার যেটুকু দরকার সেখানে আমরা সংশয় প্রকাশ করছি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে যে দুরবস্থা চলছে, যারা টাকা নিয়ে আমাদের টাকা শোধ দিল না তাদের সেই লাভের টাকা পূরণ করার জন্য এখন ট্যাক্সের টাকা লোকসানে যেতে হবে এবং তারপর আমাকে বলা হচ্ছে আরো ট্যাক্স দেয়ার জন্য। আমরা কেন সেই ট্যাক্স দেব? যারা টাকা দেয়া হয়েছে এবং টাকা ফেরত দিল না ব্যাংকের। তার টাকা পূরণ করার জন্য কেন আমরা বাড়তি ট্যাক্স দেব? এটাতেই কিন্তু সমস্যা হচ্ছে।’ এদিকে, অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জামান বলেছেন, বাস্তবতার ভিত্তিতে বড় বাজেট সমর্থনযোগ্য। কিন্তু বাস্তবায়ন করাটাই হবে বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাজেটে টেকসই উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা, মধ্য আয়ের দেশে চূড়ান্ত পদার্পণের লক্ষ্যে সরকারের সাফল্য ও ব্যাপক কর্মযজ্ঞের কথা বলা হলেও চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। প্রস্তাবিত বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে অসহনীয়ভাবে। ফলে জনদুর্ভোগ বাড়বে ব্যাপক হারে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের প্রতি বিশেষ নমনীয়তা দেখানো হয়েছে বাজেটে। মূলত ঘোষিত বাজেটকে ব্যবসা বান্ধব বললেও অত্যুক্তি হবার কথা নয়।
বাজেটে অভ্যন্তরীণ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭১ শতাংশেরও বেশি আসবে ভ্যাট ও আয়কর খাত থেকে। রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রস্তাবিত বাজেটে কর ও ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে। আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানোয় জনগণের ওপর করের বোঝা ও সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য বাড়বে। যা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
সার্বিকভাবে বাজেট বাস্তবায়ন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় ও কাক্সিক্ষত বৈদেশিক সহায়তা অর্জন বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রস্তাবিত বাজেটের মোট আকার বা ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এটা জিডিপির ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। এবারের প্রস্তাবিত বাজেট বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৪৫ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৭৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে আগামী অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে এটা ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এটা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৩৪ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৬৫ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের বাইরে প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। এটা জিডিপির ৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে পরবর্তীতে ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি ৫০৮ কোটি টাকা বেড়েছে।
বাজেট ঘাটতি মূলত পূরণ করা হবে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ বাবদ ৩৮ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরে এ খাতে ছিল ৩২ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা), বৈদেশিক অনুদান বাবদ ৫ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরে এ খাতে ছিল ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা), ব্যাংকিং খাত থেকে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরে এ খাতে ছিল ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা) ও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ২২ হাজার ৬১০ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরে এ খাতে ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা) নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
ব্যাংকবহির্ভূত খাতের মধ্যে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরে এ খাতে ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা) ও অন্যান্য খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরে এ খাতে ছিল ৩ হাজার কোটি টাকা) নেয়া হবে। সংশোধিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা অধিক ঋণ নেয়া হয়েছে। আর খুচরা ও পাইকারি দোকানদারদের করহার বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার কর প্রদানে আগ্রহী নন, তাদের জন্য এলাকাভিত্তিক করহার ধার্য করার প্রস্তাব করছি। বর্তমানে যে হারে কর দেন সেটা বৃদ্ধি করে এলাকাভিত্তিক যথাক্রমে সাত হাজার টাকা, ১৪ হাজার টাকা, ২০ হাজার টাকা ও ২৮ হাজার টাকার ভ্যাট কার্যকর করার প্রস্তাব করছি।’
এ ছাড়া পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার অন্যান্য সব পর্যায়ে ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়ের বিদ্যমান ব্যবস্থা বহাল থাকবে। তবে, যেসব ব্যবসায়ী প্রকৃত মূল্য সংযোজনের ভিত্তিতে কর দিতে আগ্রহী হবেন তাঁদের জন্য উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণের সুযোগসহ প্রমিত হারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য হবে।
ঘোষিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় এক লাখ ১৭ হাজার ২৭ কোটি টাকা এবং অনুন্নয়ন ব্যয় এক লাখ ৮৮ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। নতুন অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অধিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে এবারের বাজেটে ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি ও হার অনেক বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। মোবাইল ফোন সেবার ওপর করহার বাড়ানো হয়েছে। প্যাকেজ ভ্যাট বহাল রাখা হলেও পরিমাণ বিদ্যমানের চেয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে কর আরোপ করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য কেক, বিস্কুট, সিআর কয়েলসহ বিভিন্ন পণ্যের নির্ধারিত ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ‘বাড়তি’ কর আরোপ প্রস্তাব কার্যকর হলে পণ্য ও সেবার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ভোক্তাকে তখন বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে, সেবা পেতে হবে। এতে করে তাদের ওপর ব্যাপক চাপ আসবে।
বর্তমানে ২২টি খাত সংকুচিত মূল্যভিত্তিতে বিশেষভাবে ভ্যাটে ছাড়ের সুবিধা পাচ্ছে। এর মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেটে আটটি খাতের বিশেষ কর সুবিধা উঠিয়ে বিদ্যমানের চেয়ে বর্ধিত হারে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী মোটরগাড়ির গ্যারেজের ভ্যাটহার সাড়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। বর্ধিত হার কার্যকর হলে গাড়ির মালিককে মেরামতের পেছনে আরও বেশি বিল দিতে হবে। জাহাজ নির্মাণে ডকইয়ার্ডে ভ্যাটহার সাড়ে ৭ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
এতে করে জাহাজ নির্মাণের ব্যয় আরও বাড়বে। কনস্ট্রাকশন ফার্মের ভ্যাটহার সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। বর্ধিত ভ্যাটহার কার্যকর হলে নির্মাণ খাতের ব্যয় বাড়বে। বর্তমানে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য পরিবহনে আড়াই শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ আছে। নতুন বাজেটে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। এতে করে পেট্রোলিয়াম পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়বে। ইমিগ্রেশন উপদেষ্টা সেবার ওপর বর্তমানে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে। এই হার দ্বিগুণ করা হয়েছে। ফলে ইমিগ্রেশনের সেবার জন্য ভোক্তাকে বেশি টাকা খরচ করতে হবে। কোনো অনুষ্ঠানে সম্পরশিপ সেবার জন্য এখন সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হয়। এ সেবার ওপর ভ্যাট দ্বিগুণ করায় স্পনরশিপ সেবার খরচ আরও বাড়বে।
সারাদেশের ছোট ব্যবসায়ীরা বর্তমানে বছরে নির্ধারিত পরিমাণ ভ্যাট পরিশোধ করেন। নতুন বাজেটে এটি শতভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্যাকেজ ভ্যাটের আওতায় বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ছোট ব্যবসায়ীরা বছরে ১৪ হাজার টাকা এককালীন ভ্যাট দেন। নতুন বাজেটে এটি বাড়িয়ে ২৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকার ছোট ব্যবসায়ীরা বর্তমানে বছরে ১০ হাজার টাকা ভ্যাট দেন। তাদের দিতে হবে ২০ হাজার টাকা। জেলা শহরের জন্য এখন আছে ৭ হাজার ২০০ টাকা। তাদের দিতে হবে ১৪ হাজার টাকা। তৃণমূল পর্যায়ে দেশের অন্যান্য এলাকায় ভ্যাট আছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। তাদের দিতে হবে ৭ হাজার টাকা।
মূলত ঘোষিত নতুন অর্থবছরের বাজেটকে অতি উচ্চাভিলাষী বাজেট বলতে কেউই কসুর করছেন না। অর্থমন্ত্রী বাজেট বাস্তবায়নের কর্মকৌশল সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন তা মোটেই বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না বরং দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা এসবকে সংশয়পূর্ণ বলেই মনে করছেন। আর বাজেট বাস্তবায়নে যেসব কর্মকৌশলের কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতারও অভাব রয়েছে। আসলে প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ অনেকাংশেই উপেক্ষিত হয়েছে। বাজেটে কর ও মূসকের আওতা বাড়ানো হয়েছে। যার সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নি¤œবিত্তের ও মধ্যবিত্তের মানুষের উপর। যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে সেসবের অধিকাংশের ভোক্তা হচ্ছেন দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী।
পক্ষান্তরে যেসব পণ্যের দাম কমানো হয়েছে সেসবের দ্বারা উপকৃত হবেন দেশের বিশেষ শ্রেণির মানুষ। তাই প্রস্তাবিত বাজেট গণমুখী হওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। আর সরকারের উচিত বাজেট নিয়ে সংশয় ও প্রশ্নের যৌক্তিক নিরসন করা।
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads