বুধবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৪

অ্যামনেস্টির পরামর্শ


বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে মৃত্যুদন্ড দেয়ার পদক্ষেপে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গত সোমবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রেখে রায় ঘোষণার পর নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি মৃত্যুদন্ডের বিধান বাতিল করার জন্যও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। অ্যামনেস্টি বলেছে, মৃত্যুদন্ড বাতিল করার লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে ফাঁসির হুকুমের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করতে হবে। একই সঙ্গে এমন ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে যাতে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের তথা রাজনৈতিক কোনো হস্তক্ষেপ না ঘটে। অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ গবেষক আব্বাস ফয়েজ বলেছেন, গত বছর সর্বশেষ মৃত্যুদন্ডাদেশ ঘোষণার পর নয় মাস বিরতি শেষে এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তিনটি ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ২৯ অক্টোবর জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে এবং ২ নবেম্বর মীর কাশেম আলীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। এর পর পর মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রেখে রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এতো বেশি মৃত্যুদন্ড নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশংকাজনক। তাছাড়া ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আইসিটি যে ১২টি রায় বা আদেশ দিয়েছে তার সবই দিয়েছে বিরোধী দলের, প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে। এ ১২টি রায়ের মধ্যে নয়টিই মৃত্যুদন্ডাদেশ। এভাবে ফাঁসি তথা মৃত্যুদ- স্বাধীনতাযুদ্ধের শিকার ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার বয়ে আনার পরিবর্তে কেবল সহিংসতার স্থায়ী চক্রই সৃষ্টি করবে।
বিবৃতিতে আইসিটির বিচার প্রক্রিয়ারও বিরোধিতা করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি বলেছে, সংবিধান এবং আইসিটির সংশোধিত আইন অনুযায়ী রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকলেও অ্যাটর্নি জেনারেল যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন, তার ফলে আসামীপক্ষের কোনো অধিকারই দৃশ্যত থাকছে না। সে কারণেও ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দ-িতজনেরা। প্রসঙ্গক্রমে অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১৪০টি দেশ আইনগতভাবে মৃত্যুদন্ড বাতিল করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ নয়টিমাত্র দেশ ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর মৃত্যুদন্ড তথা ফাঁসির আদেশ দিয়েছে এবং সেগুলো কার্যকর করেছে। নিজেদের মৃত্যুদন্ডের বিরোধী হিসেবে উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বলেছে, বাংলাদেশকে অবশ্যই অবিলম্বে মৃত্যুদন্ডের বিধান বাতিল করতে হবে এবং সে উদ্দেশ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এরই মধ্যে ঘোষিত সব ফাঁসির আদেশ স্থগিত করতে হবে।
আমরা মনে করি, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অ্যামনেস্টির দাবি মানতে বাধ্য না হলেও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উল্লেখিত বিবৃতিকে উপেক্ষা করা নানা কারণে উচিত হবে না। ‘আন্তর্জাতিক’ ও ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ ধরনের নানা শব্দের আড়াল নিলেও এই সত্য প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, নিজেদেরই গঠিত ট্রাইব্যুনালকে দিয়ে একের পর এক রায় ঘোষণা করিয়ে এবং সেগুলোর কোনো কোনোটি কার্যকর করার মধ্যদিয়ে সরকার প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য চরিতার্থে উঠেপড়ে লেগেছে। এ ক্ষেত্রে দেশের ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দল জামায়াতে ইসলামীই সরকারের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে দলটির সাবেক আমীর, বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক ও সংগ্রামী জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম বন্দী অবস্থায় হাসপাতালে ইন্তিকাল করেছেন। তাঁরও আগে ফাঁসিতে মৃত্যু ঘটানো হয়েছে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে। এরপর এসেছে আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসির মঞ্চে ওঠানোর আদেশ। জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির আয়োজন সম্পন্ন করা হচ্ছে। দলটির আরেক শীর্ষ নেতা মীর কাশেম আলীকেও ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আইসিটি। এসব নেতার পাশাপাশি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। জীবিত অবস্থায় তিনি আর কখনো জেলখানার বাইরে আসতে পারবেন না। অন্যদিকে জামায়াতকেও নিষিদ্ধ করার আয়োজন চলছে। সব মিলিয়ে মনে করা হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জামায়াতে ইসলামীকে নির্মূল করার ভয়ংকর কর্মকান্ড চালাচ্ছে সরকার।
এই লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকার যে সামান্য সাফল্যও অর্জন করতে পারেনি তার প্রমাণ হিসেবেই এসেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আলোচ্য বিবৃতি। বলা যায়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো ক্ষেত্রেই সরকার এ লক্ষ্য অর্জনে লাভবান হতে পারেনি, সেকথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বিচার প্রক্রিয়া শুধু বিশ্বব্যাপী নিন্দিত ও ধিকৃতই হচ্ছে না, বাংলাদেশকেও লজ্জার মুখে ঠেলে দিচ্ছে সরকারকে। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটের আলোকেই আমরা মনে করি, সরকারের উচিত কালবিলম্ব না করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের যৌক্তিক আহ্বান বিবেচনায় আনা উচিত।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads