সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৪

বাংলাদেশে জুলুম নির্যাতন ও স্বর্গপ্রাপ্তির যোগ্যতা


গত কয়েক মাস ধরে দেশব্যাপী খুন, রাহাজানি, যত্রতত্র বেওয়ারিশ লাশের মিছিল যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হয়। ক্ষমতাসীন সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই জীবন, সম্পদ ও ইজ্জতের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চলাফেরা করতে পারছেন না। প্রকাশ্য দিবালোকে এমন কি রাতের আঁধারেও চোর ডাকাত, খুনি সন্ত্রাসীরা পুলিশ ও ভালো মানুষদের ভয় করতো, দেখলে পালিয়ে যেতো। কিন্তু এখন জামানা পাল্টে গেছে বলে মনে হয়। চোর ডাকাতরাই এখন ভালো মানুষদের তাড়াচ্ছে। দাগী অপরাধীরা সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে সজ্জনদের মাথার উপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে এবং তাদের অত্যাচার নির্যাতন এবং গুমের শিকার বানাচ্ছে। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন হচ্ছে সরকারের কাজ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সরকারের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তারা এখন দুষ্টকে লালন এবং শিষ্টকে দমনের কাজে ব্যস্ত। তাদের এমনভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে যে, চুরি ডাকাতির মামলায় এজাহার নিতে গেলেও পুলিশকে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুমোদন নিতে হয়। আবার র‌্যাব এবং পুলিশ সদস্যরাও দলীয় নির্দেশে মানুষ খুন করে। খুনের জন্য ভাড়া খাটে। কিছু দিন হৈ চৈ হয় আবার পরিস্থিতি সাবেক অবস্থায় ফিরে যায়।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত পুলিশসহ র‌্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সম্পৃক্তি, কাস্টডিতেও ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অপরাধের স্বীকারোক্তির পরও বিচারে বিলম্ব এবং ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার সরকারি কৌশল জাতি হিসেবে সারা দুনিয়ার সামনে আমাদের ভাবমর্যাদাকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। গত সাত বছরে এ ধরনের শত শত ঘটনা ঘটেছে এবং অপরাধীরা বিনা শাস্তিতে পার পেয়ে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা জীবনের নিরাপত্তা। শত শত কোটি টাকা খরচ করে সরকার মন্ত্রীদের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নেই; না জীবনের, না সম্পত্তির, না ইজ্জতের। দেশব্যাপী লুটপাট চলছে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক, বীমা, শিল্পকারখানা এবং সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়া করে দেয়া হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে মন্ত্রী এমপিরা আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার সদস্যদের নিয়ে লুটপাট করার অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ দেশকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, রাহাজানি ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। দেশে সামরিক শাসন নেই। কিন্তু তবুও বিরোধী দলের জন্য মিটিং করা হারাম। সরকারি দল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মিটিংয়ের আয়োজন করে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, রাহাজানি, অস্ত্রবাজি ও নৈতিক স্খলনের প্রধান অনুঘটক যুবলীগকে সদম্ভে দেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারি হিসেবে আখ্যায়িত করছে। প্রহসন আর কাকে বলে। রাজনৈতিক নির্যাতন, খুন-খারাবি এবং হামলা মামলায় মানুষ এতই অতিষ্ঠ হয়ে গেছে যে, দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতের কথা তারা প্রায় ভুলেই গেছেন। চারদলীয় জোট ক্ষমতা ছাড়ার প্রাক্কালে যে চাল ১৬ টাকা ছিল তা এখন ৪৬ টাকা। ১২ টাকার লবণ ৩২ টাকা। ৫৮ টাকা লিটারের সয়াবিন ১৪০ টাকা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধপত্র, গণপরিবহনের ভাড়া, মাছ-গোশত এমন কোনো পণ্য নেই যার মূল্য ৪/৫ গুণ বৃদ্ধি পায়নি। সামষ্টিক অর্থনীতির দুরবস্থা ও বেকারত্ব পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। সরকারি চাকরি দলীয় লোক ছাড়া বাইরে যায়নি। যে দেশের অর্থমন্ত্রী ঘুষ-দুর্নীতিকে গ্রিজিং মানির নামে বৈধ বলে ঘোষণা দেন, সে দেশের নৈতিক মান কোথায় গিয়ে নামতে পারে সহজেই তা অনুমেয়।
সরকারের কোথাও চেইন অব কমান্ড নেই। পাগলা রাজার রাজত্বে সবাই রাজা। সরকার অনির্বাচিত হওয়ায় সবাই নিজেকে সরকার মনে করেন। সিভিল প্রশাসন দলীয়করণ করে জুনিয়রকে সিনিয়র, সিনিয়রকে জুনিয়র এবং অথর্ব ও দুর্নীতিপরায়ণ, অযোগ্য লোকদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষে বসিয়ে দেয়ার ফলে সচিবালয় এখন তামাসার পাত্রে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির সাথে শীর্ষ কর্মকর্তারা জড়িয়ে পড়েছেন। তারা শাস্তি পাননি। জুনিয়র বশংবদরা কতজন এর সাথে জড়িত আছেন তার হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। আর্মি অফিসারদের পুলিশের অধীনে কাজ করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে এবং অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের সিভিল প্রশাসনে রাখা হচ্ছে। এতে সৈনিক হিসেবে তাদের দক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে। গণতন্ত্র ধ্বংসের পাশাপাশি সিভিল সোসাইটিকেও ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখা হয়নি; দুভাগে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ। বেকার টেকনোক্যাটরা এখন সরকারের বুদ্ধিদাতা। অপকর্ম করতে করতে সরকার দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র ভাঙতে ভাঙতে তারা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছেন যে তারা মনে করছেন নির্বাচনের আর দরকার নেই।
এদেশের মানুষের চাহিদা খুব বেশি ছিল না। তারা পাকিস্তান ভেঙে এমন একটি শান্তির পরিবেশে বসবাস করতে চেয়েছিলেন, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ইনসাফ ও ভয়ভীতিশূন্য স্বাধীন পরিবেশ বজায় থাকবে। তারা তাদের আদর্শ, মূল্যবোধ, জীবন, সম্পত্তি ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিয়ে বসবাস করতে পারবেন। এখানে স্বৈরাচার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ছায়াও থাকবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগ তাদের সমস্ত স্বপ্নকে ভেঙে খান খান করে দিয়েছে। বিরোধী জোট বিশেষ করে এই জোটের বৃহত্তম শরিক দল বার বার আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের ঘোষণা দিয়েও তাদের অবস্থানকে দৃঢ় করতে পারছে না। তাদের আন্দোলনের হুমকি স্বৈরসরকারের জুলুম-নির্যাতনকে আরও বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করছে বলে মনে হয়। পথে-প্রান্তরে মানুষের এখন একটিই প্রশ্ন, বিরোধী জোটের নিষ্ফল অকার্যকর আন্দোলনের ঘোষণা আর কতদিন চলবে? জুলুম-নির্যাতন শেষ হবে কবে? এই পর্যায়ে একটি গল্প বলতে চাই। এক সময় অর্থনীতি দিয়ে আমি আমার সাংবাদিকতা পেশা শুরু করেছিলাম। অর্থনীতির তত্ত্ব এবং তার ফলপ্রসূতা নিয়ে বিতর্ক আমার বেশ ভালোই লাগতো। দার্শনিক আর অর্থনীতিবিদদের ঝগড়াও ছিল মজার। দার্শনিকরা প্রতিপাদনবাদের দুর্বলতাসমূহ স্বীকার করেন। কিন্তু অসারতা প্রতিপাদনবাদ পূর্ববর্তী দর্শনের চেয়ে উন্নত, এ বক্তব্য তারা মোটেও মানেন না। তাদের ধারণা তত্ত্ব প্রতিপাদনের জন্য যে আদর্শ অবস্থা অনুমান করা হয় সে অবস্থা বাস্তবে নাও থাকতে পারে। আবার উপাত্ত শূন্য থেকে আসে না, তা সংগ্রহ করার আগে একটি পূর্ব ধারণা বা Hypothesis দিয়ে শুরু করতে হয়। তদুপরি পূর্ব ধারণা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রচলিত তত্ত্ব দ্বারা। এ প্রেক্ষিতে বস্তু নিরপেক্ষ উপাত্ত বলতে কিছু নেই। এই অবস্থায় সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে মার্ক ব্লাগ (Mark Blaug) এর ধারণাই সঠিক। তিনি বলেছেন, সকল উপাত্তই হলো তত্ত্বভারাক্রান্ত, আবার সকল তত্ত্বই হলো মূল্যবোধে ভারাক্রান্ত। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল যথার্থই বলেছেন, ‘The most reckless and dangerous theorist is the man who claims to let the part speak for Themselves.’ অর্থাৎ সেই তত্ত্ববিদই হচ্ছেন সবচেয়ে বেপরোয়া ও বিপজ্জনক যিনি দাবি করেন যে, উপাত্ত নিজে নিজেই তার সত্যতা প্রমাণ করবে। বিষয়টি একটু জটিল। কাজেই আমি এখানে টমাস কুনের (Kuhn)-এর Paradigm Theory বা আদল তত্ত্ব এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপিত Predictive instrumentalism বা ভবিষ্যদ্বাণীমূলক নিমিত্তবাদ নিয়ে আলোচনা করবো না। তবে এ তত্ত্বের মূল প্রবক্তা মিল্টন ফ্রিডম্যানের লেখা এক পাদ্রীর গল্প পাঠকদের সাথে উপভোগ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তার গল্পের ‘পাদ্রী সারা জীবন সৎপথে থেকে ধর্ম সাধনা ও ধর্মপ্রচার করেছেন। মারা যাবার কিছুদিন আগে সেই পাদ্রী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একজন বেপরোয়া ট্যাক্সিচালকের শেষকৃত্য সম্পাদন করেন। এর দিন কয়েক পর পাদ্রী নিজেই মারা যান। স্বর্গে যাবার পর তিনি দেখতে পান যে, ট্যাক্সিচালকেরও স্বর্গে ঠাঁই হয়েছে এবং তার মর্যাদা পাদ্রী সাহেবের অনেক ঊর্ধ্বে। পাদ্রী মনক্ষুণ্ন হয়ে সেন্ট পিটারকে বললেন, ট্যাক্সিচালকটি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালাতো এবং নানা কুকর্মে লিপ্ত থাকতো। তিনি সারা জীবন ধর্ম-কর্ম করেছেন অথচ স্বর্গে তার স্থান ট্যাক্সিচালকের নীচে। স্বর্গে এ ধরনের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা ন্যায় বিচার নয়’ সেন্ট পিটার জবাবে বললেন, ‘দেখো, স্বর্গের শ্রেণী ও আসন বিন্যাস নির্ভর করে সাধনার কার্যকারিতার ওপর। তুমি অবশ্যই নিজে ধর্ম-কর্ম করেছো; কিন্তু বেশি লোককে দিয়ে প্রার্থনা করাতে পারনি। গীর্জায় তোমার বক্তৃতা ও প্রার্থনা সঙ্গীত শুনে বেশিরভাগ লোক ঘুমিয়ে পড়তো, কিন্তু বেপরোয়া ট্যাক্সিচালক যখনি গাড়ি চালাত আরোহীরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতো। ভগবানের কাছে তোমার চাইতে ট্যাক্সিচালক বেশি কার্যকর। স্বর্গে তাই তার স্থান উপরে।’
এখন পাঠকরাই বিবেচনা করে দেখুন, আন্দোলন আর জুলুমের কার্যকারিতার দিক থেকে কে বেশি যোগ্য, বিরোধী দল না স্বৈরাচারী জালেম সরকার? এদের মধ্যে স্বর্গ কার বেশি প্রাপ্য তার বিচারও আপনাদের হাতে ছেড়ে দিলাম।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads