শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৪

রাজনীতিতে ব্যঙ্গ-তামাশাই শেষ কথা নয়


এদেশে সাধারণত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীনরাই প্রাধান্যে থাকেন। এক সময় রাজা-বাদশাদের নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা হতো। এখন প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বক্তব্য ও কান্ড-কীর্তি নিয়ে আসর জমে ওঠে। বিএনপি-জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির মতো বড় দলগুলোর প্রধান নেতা-নেত্রীরাও আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে সত্য হলো, রাজনীতিকদের বাইরেও দেশে এমন অনেক বিশিষ্টজন রয়েছেন, সময়ে সময়ে যাদের বক্তব্য ও ভূমিকা গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তাদের অনেকে দৃশ্যপটেও এসে হাজির হন, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের আক্রমণের শিকার হলে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তেমন একজন। ১৯৬০-এর দশকে গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীন মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নির্যাতিত এবং দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড় ছেলে হিসেবে আগে থেকেই পরিচিতি ছিল তার। মানিক মিয়ার ঋণ পরিশোধ করার উদ্দেশ্য থেকেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তাকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলেন। তিনি সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু অন্য সবার মতো নেতার বশংবদ হননি ব্যারিস্টার মইনুল। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিব যখন চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সকল ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তখন প্রতিবাদে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি অবশ্য একা ছিলেন না। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীও সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যার প্রতিবাদে সংসদ এবং আওয়ামী লীগ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের পরিস্থিতি তখন শ্বাসরুদ্ধকর ছিল বলেই জেনারেল ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুলের পক্ষে প্রকাশ্যে বাকশাল বা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া সম্ভব ছিল না। তা সত্ত্বেও সংসদ থেকে পদত্যাগ করা এবং বাকশালে যোগ না দেয়াটাই ছিল অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত। কারণ, অমন সৎসাহস আর কেউই দেখাননি। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া নেতা শেখ মুজিবও অবশ্য যথেষ্টই দেখিয়েছিলেন। চারটি মাত্র দৈনিক ছাড়া সব পত্রিকাকে নিষিদ্ধ করার সময় মানিক মিয়ার ইত্তেফাককেও তিনি সরকারের মালিকানায় এনেছিলেন। ফলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং তার ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু হারিয়েছিলেন ইত্তেফাকের মালিকানা। অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর- সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর। ইত্তেফাকের মালিকানা ফিরে পেয়েছিলেন মানিক মিয়ার ছেলেরা।
ইত্তেফাক এবং দ্য নিউ নেশন পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক হিসেবে হোসেন ভ্রাতৃদ্বয় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছেন। ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জেনারেল এরশাদের এবং শেখ হাসিনার মন্ত্রী হয়েছেন। এই সময়েও তিনি বৈধতার সংকটে হাবুডুবু খাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিত্ব করছেন। ওদিকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দৃশ্যপটে এসেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম নিয়ে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারী উদ্দিন সাহেবদের উপেদেষ্টা হিসেবে। তার এই অবস্থান অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, বছর না ঘুরতেই উপেদেষ্টার পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল তাকে। এটা ২০০৮ সালের কথা। সেই থেকে নিজের এবং অন্য কয়েকটি পত্রিকায় কমেন্ট্রি বা মন্তব্য প্রতিবেদন এবং কলাম লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে চলেছেন ব্যারিস্টার মইনুল। জবাবও তাকে কষেই পেতে হচ্ছে- বিশেষ করে ‘মুজিব কাকুর’ মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। কোনো কোনো উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী তো রীতিমতো তুলোধুনোই করছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে। ব্যারিস্টার সাহেবও কম যাচ্ছেন না। সৌজন্যের সীমা অতিক্রম না করেও তিনি এ কথাটাকেই সত্য প্রমাণ করে চলেছেন যে, জ্ঞানী এবং মুর্খ বা স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে আসলেও বিরাট পার্থক্য রয়েছে। জবাব তিনি ঠিকই দিচ্ছেন কিন্তু কিছুটা এদিক-সেদিক করে। যেমন সর্বশেষ কয়েকটি কমেন্ট্রি ও টকশোতে ‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই’ ব্যারিস্টার মইনুল বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান দেয়ার মতো অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, ট্রেনিং কিছুই শেখ হাসিনার নেই। শেখ হাসিনার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়াকেও টেনে এনেছেন তিনি- দুই নেত্রীকে ‘দ্য টু লেডি লীডার্স’ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিক দুর্ঘটনার ফলে আমরা যে নেতৃত্ব পেয়েছি...’। অর্থাৎ শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার দলীয় নেতৃত্বে ও ক্ষমতায় আসাটা ব্যারিস্টার সাহেবের মতে দেশ ও জনগণের জন্য এক ‘ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা’! এ পর্যন্ত এসেও থেমে যাননি ব্যারিস্টার মইনুল। তার মতে প্রধানমন্ত্রীর দরকার ‘শিক্ষিত সচেতন’ ব্যক্তিদের পরামর্শ নেয়া। কিন্তু চাটুৃকার ও দুর্নীতিবাজরা তাকে ঘেরাও করে রেখেছে। এজন্যই ‘বঙ্গবন্ধুর’ কন্যা হিসেবে রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে বলা সম্ভব হয়েছে যে, ‘আমি এক ইঞ্চিও নড়বো না’ (বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি ‘এক চুল’ও নড়বেন না!)। ব্যারিস্টার মইনুলের মতে শেখ হাসিনা এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। কারণ, দেশ কারো নিজের বা পিতার সম্পত্তি নয়। দেশের স্বার্থে এক ইঞ্চি কেন, আরো বেশিও নড়তে হতে পারে!
ব্যারিস্টার মইনুল প্রসঙ্গক্রমে ‘দুর্ভাগ্যের’ কথা জানিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে যারা আছে তারাই সরকার চালাচ্ছে, কমিশন ভাগাভাগি করছে। কোনো এক সাবেক আমলার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, কারো কারো কথা শুনে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী আসলে কে- ওই আমলা, না শেখ হাসিনা? তারাই ‘সব ঠিক আছে’ বলছেন, ঘোষণা দিচ্ছেন ‘কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’। ব্যারিস্টার মইনুল জানতে চেয়েছেন, কার বিরুদ্ধে কঠোর হবেন- এটা কি পাকিস্তান? ‘ওনারা বলেন, দেশ পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে’- টিভিতে সঞ্চালকের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, লড়াইটা সেখানেই। বাংলাদেশ কখনো পাকিস্তান যেমন হবে না তেমনি ভারতের কোনো রাজ্যও হবে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের একটা চেতনা নিয়ে এসেছে। তৈরি করেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধ তো আমরা সবাই মিলে করেছি। যারা ভারতে (কোলকাতায়) গেছে তারাই শুধু মুক্তিযুদ্ধ করেছিল? মারা গেলাম আমরা আর এখন তারা হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! ব্যারিস্টার মইনুলের অভিমত, এটা আসলে সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর একটা ফন্দি। তিনি প্রশ্ন করেছেন, তারা (মুক্তিযুদ্ধের চেতনাওয়ালারা) দেশকে রক্ষা করতে পারবে নাকি? দেশকে তো রক্ষা করবে জনগণ। ‘জয় বাংলা’ স্লোাগান প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছেন, এই স্লোাগানটা তিনি বোঝেন না। তার জিজ্ঞাসা, এটা কোন দেশের স্লোগান? কারণ, আমার দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বলতে চাইলে আপনি ‘জয় বাংলাদেশ’ বলুন। ‘জয় বাংলা’ স্লোাগানটা আমরা বলেছি পাকিস্তানের বিরোধী অবস্থান থেকে। এখন তো বাংলাদেশ হয়ে গেছে। এভাবে আসলে চালাকি করা হচ্ছে। ব্যারিস্টার মইনুল বলিষ্ঠতার সঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র। মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, কিছুদিন আগে ভারতের কংগ্রেস সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিলেন, ‘এটা (বাংলাদেশ) আমাদের অঞ্চল, এ অঞ্চলের ভালোমন্দ আমরাই ভালো বুিঝ’ তখন কোথায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? আজ কথায় কথায় পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে দেশকে আসলে সিভিল ওয়ারের দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন তারা।
রাজনৈতিক সংকট প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মইনুল বলেছেন, নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে সংকট হওয়া উচিত ছিল না। সকলের কাছে গ্রহণীয় নির্বাচনকালীন সরকারের নাম কি হবে- তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তীকালীন- সেটা নিয়ে তো যুদ্ধ করার কিছু নেই। এজন্য যে দেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, ব্যবসায়ীরা হাহাকার করছেন- এসবই অত্যন্ত দুঃখজনক। সুচিন্তিতভাবে সৃষ্ট সংকটের সুযোগ নিয়ে ৫ জানুয়ারি যে ন্যক্কারজনকভাবে একতরফা নির্বাচন করা এবং তার মাধ্যমে ক্ষমতার দখল নেয়া হয়েছে তারও কঠোর সমালোচনা করেছেন ব্যারিস্টার মইনুল। তিনি মনেই করেন না যে, বর্তমান সংসদ এবং সরকারের বৈধতা রয়েছে। তার মতে জনগণ যাতে স্বাধীনভাবে, ভয়ভীতিমুক্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। তারও আগে অবৈধ সরকারকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে। সংসদকে তো ভেঙে দিতেই হবে। কথাগুলোর মধ্য দিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল আসলে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠারই তাগিদ দিয়েছেন। তাই বলে জাতীয় পার্টির মতো ‘গৃহপালিত’ কোনো দলের সঙ্গে নয়। বিরোধী দল বলতে তিনি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোকেই বুঝিয়েছেন। রাজনীতিবিদদের ‘ট্রেনিং’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন না বলে পারেননি যে, আমরা যে নেতৃত্ব পেয়েছি সেটা পেয়েছি ‘ঐতিহাসিক দুর্ঘটনার ফলে’। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান দেয়ার মতো অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, ট্রেনিং কিছুই দুই নেত্রীর নেই। উল্লেখ্য, মূল কথায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য চর্চা ও সহনশীলতার কথা বলেছেন। এই বলে আশাও প্রকাশ করেছেন যে, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে দেশে এখনো শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়।
ঠিক বর্তমান সময়ে এসেই ব্যারিস্টার মইনুল কেন কথাগুলো বলেছেন তার কারণ জানার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষও জানে, প্রধানমন্ত্রী কোনো বিষয় নিয়ে একবার বলা শুরু করলে সহজে থামার নাম করেন না। ১/১১ ধরনের ক্ষমতা দখলের কল্পিত ষড়যন্ত্রও তেমন একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে প্রায় সব বক্তৃতায় তিনি তার কল্পিত ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য রেখে চলেছেন। বলে বেড়াছেন, ১/১১-এর ‘কুশীলবরা’ নাকি আবারও তৎপর হয়ে উঠেছেন। সরকারকে উৎখাতের জন্য তারা শুধু ষড়যন্ত্রই করছেন না, অনেক কলাকৌশলও খাটাচ্ছেন। বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী ‘উদ্দিন সাহেবদের’ আমলের কিছু তথ্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কারা ‘কিংস পার্টি’, ‘কুইনস পার্টি’ প্রভৃতি গঠন করে ১/১১ ঘটিয়েছিলেন, কারা ওই সরকারের উপদেষ্টা হয়ে ক্ষমতায় ভাগ বসিয়েছিলেন এবং কাদের কারণে ‘গণতন্ত্রের এত বড় একজন নেত্রী’ হয়েও শেখ হাসিনাকে কারাগারে যেতে হয়েছিল- ইশারা-ইঙ্গিতে তাদের নাম-পরিচিতি জানাতে গিয়ে যথেষ্ট ব্যঙ্গাত্মকভাবেই প্রধানমন্ত্রী বলে বেড়াচ্ছেন, তারা নিজেদের ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ বলে দাবি করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফর্মুলা দেন। গণতন্ত্র থাকলে তাদের ‘এক কানাকড়িরও’ মূল্য থাকে না এবং অসাংবিধানিক কিছু ঘটলে তাদের মূল্য বেড়ে যায় বলেই আবারও তারা তৎপর হয়ে উঠেছেন। এ ধরনের ‘বিশিষ্ট নাগরিক’দের সমন্বয়ে গঠিত কোনো অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়। গণতন্ত্রকেও তারা নির্বাসনে পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর মতে সেজন্যই সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে ঘোষণা করে বেড়াচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। অন্য একটি গুরুতর অভিযোগও হাজির করেছেন শেখ হাসিনা। বলেছেন, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরও নাকি একই ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়েছে! তাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বানচাল করা!
ক্ষমতায় আছেন এবং বিরোধী দল বর্জন করায় একেবারে ‘ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে গিয়েছিলেন বলে মুখে যা আসছে তাই বলতে পারলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু সত্যের ধারেকাছেও যাননি। সহজবোধ্য কারণে তেমন ইচ্ছাও তার থাকার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘বিশিষ্টজন’ এবং ১/১১-এর ‘কুশীলব’দের কথাই ধরা যাক। তিনি ঠিক কোন ‘বিশিষ্টজনদের’ দিকে আঙুল তুলেছেন সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বলার দরকার পড়ে না। এখানে বরং একটি বিশেষ কারণের কথা বলা যাক। ব্যারিস্টার মইনুলসহ প্রধানমন্ত্রী যাদের তুলোধুনো করেছেন তাদের কেউই কিন্তু অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ওকালতি করেননি। তারা বরং সংবিধানের আলোকেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করে এবং ২৪ জানুয়ারির পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে দশম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াতসহ প্রধান দলগুলো অংশ না নিলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশ-বিদেশের কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না, সরকার এবং সংসদকেও বৈধতার সংকটে পড়তে হবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক সংকটই কেবল মারাত্মক হয়ে উঠবে না, একই সঙ্গে নতুন নির্বাচনের দাবিও উঠতে থাকবে। পরিস্থিতি এমন হবে যখন স্বল্প সময়ের মধ্যে সরকারকেও নতুন নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে হবে। এর ফলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা যেমন বাধাগ্রস্ত হবে তেমনি রাষ্ট্রের বিপুল অর্থেরও অপচয় ঘটবে। মূলত এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যারিস্টার মইনুলসহ প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘বিশিষ্টজনেরা’ নির্বাচন স্থগিত করার এবং বিএনপি ও জামায়াতসহ প্রধান দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে নতুন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেড়-দু’মাসের জন্য ছুটিতে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে বিরোধী দল নির্বাচনে না আসার কোনো অজুহাত দেখাতে না পারে। এসব পরামর্শের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। এ টুকুই শুধু নয়, ব্যঙ্গ-তামাশার মধ্য দিয়ে বিশিষ্টজনদের ১/১১-এর ‘কুশীলবও’ বানিয়ে ছেড়েছেন!
এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর কথার পিঠে কথাও উঠেছে সঙ্গত কিছু কারণে।  প্রধানমন্ত্রী যাই বোঝাতে চান না কেন, এই সত্য কিন্তু প্রাথমিক দিনগুলোতেই প্রমাণিত হয়েছিল যে, তিনি যাদের ‘কুশীলব’ বলে ব্যঙ্গ করছেন এবং যাদের ওপর ১/১১ ঘটানোসহ অসাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানোর দায় চাপাতে চাচ্ছেন, তাদের কারণেই তিনি ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। ১/১১-এর মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারীদের ঠিক কোন নেতা-নেত্রীরা গর্বের সঙ্গে নিজেদের ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন সে কথাও তো প্রধানমন্ত্রীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়! এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার পরিবর্তে একটি তথ্যের উল্লেখই যথেষ্ট হওয়া উচিত। সে তথ্যটি হলো, যাদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নানা কথা বলছেন সেই ১/১১-এর কোনো একজন নায়ক বা কুশীলবের বিরুদ্ধেই কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নায়ক ও কুশীলবদের সবাই শুধু আরাম-আয়েশে জীবনই যাপন করছেন না, কয়েকজন এখনো দেশে-বিদেশে সরকারি চাকরিতেও বহাল রয়েছেন। সময়ে সময়ে তাদের পদোন্নতিও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং এমন বোঝাতে চাওয়াটা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যে, প্রধানমন্ত্রী আসলেও ১/১১-এর কথিত নায়ক ও কুশীলবদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য দিওয়ানা হয়ে উঠেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পূর্ব বিভিন্ন জরিপ ও জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে বরং এ অনুমানই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বিশেষ করে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিত এবং জামায়াতে ইসলামীকে যদি নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা না করা হতো তাহলে নৌকার তথা আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঠেকানো অসম্ভব হয়ে উঠতো। প্রধানমন্ত্রী আসলে নিশ্চিত সে ভরাডুবি ঠেকানোর এবং আবারও ক্ষমতায় আসার কৌশল হিসেবেই বিএনপি এবং জামায়াতের মতো বড় দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনও আপিলের সুযোগ না দিয়েই জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। এটাই সঠিক বিশ্লেষণ, তথ্যনিষ্ঠ ব্যাখ্যাও। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর উচিত সত্য স্বীকার করে নেয়া এবং মিথ্যাচার বন্ধ করা। বিএনপি ও জামায়াতসহ দেশের বিশিষ্টজনদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার সময়ও তার উচিত জিহ্বা সামাল দেয়া। শেখ হাসিনা সম্পর্কে যারা জানেন তারা অবশ্য কথাটা শুনে মোটেও আশান্বিত হবেন না। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, তিনি কোনো বিষয় নিয়ে একবার বলা শুরু করলে সহজে থামার নাম করেন না। একেবারে ‘ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে যাওয়ায় এবং র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবিকে দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতকে ‘ঠান্ডা’ করতে পারায় তার গলার স্বর তো বরং আরো চড়ছেই শুধু। তা সত্ত্বেও বলা দরকার, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই কিন্তু সবাইকে একইভাবে ‘ঠান্ডা’ করতে পারবেন না- যেমনটি পারেননি তিনি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ‘ঠান্ডা’ করতে। কথার পিঠে কথা বরং বাড়তেই থাকবে। একযোগে প্রকাশিত হতে থাকবে এমন অনেক তথ্যও- যেগুলো এক সময় শেখ হাসিনার নিজের এবং তার দল ও পরিবার সদস্যদের জন্য অপ্রীতিকর, এমনকি লজ্জাকর ও বিপদজনকও হয়ে উঠতে পারে। প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চয়ই ‘ভাবিয়া করিও কাজ...’-যুক্ত প্রবাদ বাক্যটি স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না! 
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads