বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪

ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের শেষ নেই


বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। সেখানে উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। তাদের লক্ষ্য থাকে, যথাসময়ে শিক্ষা সমাপন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করা। এটাই প্রত্যাশিত যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ থাকবে, কার্যকর নিরাপত্তা থাকবে, নির্বাধ পাঠদান ও পাঠাভ্যাসের সুযোগ থাকবে এবং নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত ও ফলাফল প্রকাশিত হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ অবস্থা বিরাজ করছে না। তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে একশ্রেণীর শিক্ষার্থী খুন, সন্ত্রাস, সহিংসতা, চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, টেন্ডারবাজি ও ভর্তি বাণিজ্যের মতো গুরুতর অপরাধ ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে বহুবারই বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক হত্যা, সন্ত্রাস, সহিংসতাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হয় না। ঘটনা ঘটার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে তদন্ত কমিটি গঠিত হয় বটে, তবে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন করা হয় না। পুলিশের তদন্তও সেভাবে এগোয় না। এক সময় সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে মামলা পরিত্যক্ত হয়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক খুন, সন্ত্রাস, সহিংসতা ইত্যাদি অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর সশস্ত্র কর্মীরা অবলীলায় খুনোখুনি, মারামারি ও গোলাগুলী করছে। তাদের রুখা যাচ্ছে না। যারা মারা যাচ্ছে কিংবা পঙ্গু হচ্ছে তাদের খোঁজ কেউ রাখছে না। অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পাকিস্তান আমলে ছাত্রলীগের জন্মলগ্ন থেকেই এই সংগঠনটির চেতনার মূল অংশ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র। তখন ছাত্রলীগ ছাড়া সাংগঠনিক অবকাঠামোয় অন্য কোনো সংগঠনের জন্ম হয়নি। ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে একত্রিত করার গৌরবদীপ্ত দায়িত্বটিও পালন করেছিল ছাত্রসমাজ। এর অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ছাত্রলীগ। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের নামে যে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনটি তৈরি হয়েছিল, সেটিতেও ছাত্রসমাজের কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়।
১৯৬৯ সালের অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানে ১১ দফার মধ্যে ৬ দফাকে সন্নিবেশিত করার গৌরবও ছাত্রলীগের।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। একের পর এক অস্ত্রবাজি আর অপকর্ম করেই যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাজারো সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অগণিত শিক্ষার্থী খুন হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েক হাজার। আহতদের মধ্যে অন্তত অর্ধশতাধিক পঙ্গু হয়ে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে। এসব হত্যাকা-ে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর কোনো রিপোর্ট বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তারা।
সারাদেশেই ছাত্রলীগ নামক দানব ক্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। বেপরোয়া ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরার প্রক্রিয়ায় প্রায় অর্ধশত নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তির সুপারিশসহ রিপোর্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জমা দেয়া হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন হয়নি।
ছাত্রলীগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ আওয়ামী লীগের তিন সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, বিএম মোজাম্মেল হক ও আহমেদ হোসেনকে বিশেষ দায়িত্ব দেন। তারপর থেকে ছাত্রলীগকে নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। তারা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল কমিটির নেতার সঙ্গেও বসেন কমিটির সদস্যরা। ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রাপ্ত তথ্যে সাধারণ ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন।
 ছাত্রলীগের দেখভাল ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্তরা আকার-ইঙ্গিতে ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরার বিষয়ে বক্তব্য পেশ করলেও অবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি। ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছেই। এ ছাড়াও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে শিবিরের অনুপ্রবেশের উৎস উল্লেখ করে তা ঠেকানোর পরিকল্পনার নামে বিভিন্ন হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ‘ছাত্রলীগে ছাত্রশিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে’ বক্তব্য দিয়েছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি) শহীদ বরকত হলের ৩০৩ নম্বার রুমের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র একেএম রেজাউল হক তুহিন ২০০২ সালের মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য ফরম পূরণ করেছিলেন। তার রোল নং-৯৯০৭৫৬। জালিয়াতির মাধ্যমে অসুস্থতা দেখিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নার্সদের ড্রেস বদলানোর রুমে তালাবদ্ধ করে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০২ তিনি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহকারী অধ্যাপক তার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। এ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়েল ব্লকের আবাসিক সার্জন ডা. মো. শফিকুর রহমান হাসপাতালের মেট্রোন ও সহকারী মেট্রোনদের নিয়ে কি কি ওষুধ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এগুলো সরেজমিনে পরিদর্শনে বের হলে হঠাৎ নার্সদের ড্রেস বদলানোর রুমে পাখা ঘুরছে অথচ বাইরে থেকে তালাবদ্ধ দেখে ডা. শফিক তালা খুলতে বলেন। তালা খোলার পর দেখেন তিনজন লোক ভেতরে বসে আছেন। ডা. শফিকের জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেন, তুহিন বিশ্ববিদ্যালয়েল ছাত্র। অন্য দু’জন হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাজ্জাদ আহসান ও আহমেদ সানি। তারা এই রুমে কিভাবে আসলেন এ প্রশ্নের জবাবে তুহিন বলেন, জরুরি বিভাগের সহকারী নার্স আলতাফ ফারুক ও কর্মচারী শাহজাহানের মাধ্যমে তিনি এখানে অসুস্থতা দেখিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন। পরে তাদের তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পুলিশ ফাঁড়িতে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ ফাঁড়িতে তুহিন বলেন, ‘সে আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে ৫ টাকা দিয়ে একটি টিকিট ক্রয় করেন। এই টিকিটটি নিয়ে (মেডিসিন আউটডোর) সাধারণ মেডিকেল অফিসারের কাছে যায়। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় আবাসিক সার্জন ডা. হায়দার আলীর কাছে। তিনি তার জন্ডিস রোগের কথা বললে, ডা. হায়দার তাকে দুই নাম্বার ওয়ার্ডে রেফার্ড করেন। তখন তিনি আবার সাড়ে পাঁচ টাকা দিয়ে ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য একটি ফাইল তৈরি করেন। কিন্তু সেই ফাইল হাসপাতালের ওয়ার্ডে জমা না করে তুহিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান, সে অসুস্থ। যে কোনো হাসপাতালে পরীক্ষা দিতে চান। এর সাথে তুহিন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে তুহিন জানান তার এখানে পরীক্ষা দিতে অসুস্থতার পাশাপাশি আরো সমস্যা রয়েছে। এখানে পরীক্ষা দিলে তার প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে। তুহিনের অভিযোগ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসার কাগজপত্র দেখে কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরীক্ষার অনুমতি দেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো চিঠিপত্র পাননি। এভাবেই পরিকল্পনা করে জরুরি বিভাগের আলতাফ ফারুক ও কর্মচারী শাহজাহানকে হাত করে উক্ত রুমে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে মোট ৩টি পরীক্ষাই তালাবদ্ধ অবস্থায় দিয়ে আসছিল।
২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের যুগ্ম-সম্পাদক রোকনুজ্জামান ইডেন কলেজের জনৈক ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেইলিং করে নীলছবি তৈরি করে বাজারে ছেড়েছিলেন ‘রোকন ডটকম।’ ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি শিলু পরকীয়ায় জড়িয়েছিল সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি এনামুল হক শামীমের। শিলুকে এনামুল বিয়ে করতে অস্বীকার করলে পরকীয়ার ভিডিও দৃশ্য সাংগঠনিকভাবে শেখ হাসিনার কাছে জমা দিয়েছিল শিলু।
ছাত্রলীগের নেতারা উন্মাদ তা আরেকবার প্রমাণ করে ২০০৫ সালে নীলক্ষেত ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার ও শামসুন্নাহার হলে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মমতাজকে নিয়ে। পরে মমতাজ দেলোয়ারকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ ছাড়া কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রলীগ নেত্রী শারমিন দৈনিক আজকের কাগজের বিজ্ঞাপন ম্যানেজারের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে প্রেম করেছিল। পরে টাকার পরিমাণ বেশি না হওয়াতে ম্যানেজারকে শ্রীঘরে যেতে হয়। ছাত্রলীগ সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন তার এলিফেন্ট রোডের বাসায় বহু মেয়েকে ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আবিষ্কার হয় হেমায়েত হিমু ও আফিফার রোমাঞ্চ প্রেমের কাহিনী। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ খোকন চারুকলা ইনস্টিটিউটে অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকা অবস্থায় ধরা পড়েছিল। ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক মইনুল মোস্তাক ও বৈশাখী টিভির পরিচালক এমএন এইচ বুলুর স্ত্রীর পরকীয়ার পর লিয়াকত শিকদার ছাত্রলীগের নারী কেলেঙ্কারির রাজনীতির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করল। 
জিবলু রহমান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads