বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৬

সর্বদলীয় জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন


দেশের অর্থনীতির প্রধান খাতগুলো এখন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের প্রধান যোগান প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কমতে শুরু করেছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমাদের প্রবাসীরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছে তা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৯ কোটি ডলার (প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা) কম। অপর এক প্রকাশিত খবরে জানা গেছে যে, মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ও কিশোরগঞ্জ জেলার শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশের পোশাক খাতের বিদেশী ক্রেতারা অনিরাপদ বোধ করায় তারা বাংলাদেশের বাইরে আমাদের পোশাক শিল্পের মালিকদের সাথে বৈঠকে প্রস্তাব দিয়েছে। আরো একটি প্রকাশিত খবরে জানা গেছে যে, এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচার এন্ড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের এক নেতা বলেছেন ঢাকায় বিদেশী ক্রেতাদের বেশ কয়েকটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেসব এখন বাতিল করছে। তারা এখন ভারত ও হংকংসহ অন্যান্য দেশে বসে বাংলাদেশের বৈঠকগুলো সেরে নিতে চাচ্ছে। তিনি আরো বলেছেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার ক্ষতি ও আতঙ্ক বিদেশীদের লক্ষ্য অন্য দেশে চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছে। আগামীতেও যে তারা যাবে না তার নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারবে? যে যাই বলুন না কেন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের অর্থনীতিতে। এদিকে দেশব্যাপী ধারাবাহিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে দেশী-বিদেশী সকলের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। উদ্বেগের প্রধান কারণ হলো বিনিয়োগ স্থবিরতা। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বলছেন, আস্থার সংকটে পর্যাপ্ত বিনিয়োগযোগ্য বিপুল অংকের অর্থ মজুদ থাকলেও বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না। সরকারের শতভাগ অর্থ খরচের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ এবারেও ব্যর্থ হয়েছে। ওদিকে কাজে সফলতা আসেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ তদারকিসহ বিশেষ নির্দেশনা, সচিবদের সাথে প্রকল্প পরিচালকদের সমন্বয়, তিন মাস পরপর অগ্রগতি প্রতিবেদন, পিডিদের কাজের মূল্যায়নে পদোন্নতি, পরিকল্পনা মন্ত্রীর গুচ্ছ পরিকল্পনা। সোজা কথায়, এক কঠিন গ্যাঁড়াকলে আটকে পড়েছে আওয়ামী সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন।
যে যত কথাই বলুন না কেন, অনেক দিন থেকেই জনগণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে রয়েছে। এর একমাত্র কারণ অগণতান্ত্রিক, ভোটারবিহীন স্বঘোষিত অটো সরকারের উপর আস্থার সংকট। এর সূত্র উৎস নিয়ে নতুন করে বিশদ আলোচনা না করলেও দেশের গণতন্ত্রপ্রেমিক সকল সচেতন মহল জাতীয় স্বার্থে নাজুক পরিস্থিতি উত্তরণের পক্ষে ঐকমত্য ঘোষণা করলেও কোন অদৃশ্য অপশক্তির গোপন স্বার্থ হাসিলে আওয়ামী সরকারের সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক একগুঁয়েমি এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী তোষামোদকারী চক্রের ভ-ামি এবং সরকারের কোন কোন মহলের নানা মতলবি ব্যাখ্যার কারণে পরিস্থিতিতে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন করা যায়নি। অর্থনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরলেই তারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিদিনই উন্নতি হচ্ছে। এ যে এক ধরনের মিথ্যাশ্রয়ী গোঁজামিলের মধ্যে সত্য প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা সে কথাটাই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা একাধিকবার বলে আসছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কার্যকর বাস্তবতায় নিয়ে যেতে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও বারবার বলা হয়েছে এবং এখনো বলা হচ্ছে। বাস্তব কথাটিই হচ্ছে সরকারের কোন কোন মহল এক ধরনের সাজানো গোছানো পরিসংখ্যান তুলে ধরে দেশের জনগণ এবং সচেতন মহলকে বোকা বানানোর যে অপচেষ্টা করে আসছে এবার সেই মুখোশই খুলে গেছে প্রবাসী আয়ের হিসেবে। এক বছরের ব্যবধানে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে ধাক্কা লেগেছে।
ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদেশে আমাদের জনশক্তি রফতানিতে ধস, বিশ্ববাজারে তেলের দরপতনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের দেশে ফেরত আসা ও ক্ষুদ্র অংকের প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের গতি প্রবাহ কমে গেছে। বিশ্লেষকরা আশংকা প্রকাশ করছেন যে, পরিস্থিতি যেদিকে এগুচ্ছে তাতে প্রবাসী আয়ে আরো ধস নামা অস্বাভাবিক নয়। ইতোমধ্যেই চলমান সন্ত্রাসী হামলাগুলোতে বাংলাদেশী ধনী ঘরের সন্তান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়াদের সম্পৃক্ততার কথা যেভাবে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
এদিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে গত সপ্তায় রাজধানীর একটি হোটেলে আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিনিয়োগ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। বৈঠকের সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে বিনিয়োগের জন্য তহবিল নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা না থাকলেও দুশ্চিন্তা রয়েছে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট নিয়ে। বলা হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতিমালা সহজ করলেও কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ সংশয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছে দেশের চলমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এতে আরো বলা হয়েছে, এমনিতেই বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাচ্ছেন না। তার উপর বিদেশীদের হত্যায় আরো সংশয় বেড়ে গেছে। আলোচনায় যথার্থই উঠে এসেছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কথা। গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেকায়দায় রয়েছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা-মালিকরা। গুলশানে বিদেশীদের হত্যায় অনেক বিদেশী ক্রেতাই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকেই অর্ডার বাতিল করেছেন। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রধান ক্রেতা দেশ হচ্ছে জাপান, ইতালি ও অস্ট্রেলিয়া। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলাগুলোতে এসব দেশের নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। গুলশান ঘটনার পরপরই বলা হয়েছে, বিদেশী ক্রেতারা তাদের অর্ডার নিয়ে পুনঃমূল্যায়ন করছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ছেড়ে পৃথিবীর অন্যান্য নিরাপদ দেশে বিনিয়োগ করার চিন্তাভাবনা করছেন। এ কথাই সমর্থন করে চরম নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ক্রেতাদের বাংলাদেশে বৈঠক বাতিল করা। যে কেউ স্বীকার করবেন, আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে প্রধানত প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স এবং তৈরি পোশাক খাতের বৈদেশিক আয়ের উপর। আমাদের পোশাক খাতের আয় কেবল বৈদেশিক মুদ্রার জন্যই নয়, দেশের লাখ লাখ কর্মবিনিয়োগেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সেদিক থেকে বলা যায়, এই খাতের ধস নামলে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কার্যত দেশ এখন আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে। সে বিবেচনায় যদি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাতে ব্যাপক ধস নামে তাহলে তা যে দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দেবে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা এখনই অনুধাবন করেছেন কী? রাষ্ট্র পরিচালকরা যত বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কথাই বলুন না কেন, আমাদের জাতীয় অর্থনীতি সক্ষমতা হারিয়ে ফেললে সবই যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যাবে, তাও কি বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি বেঁচে থাকার জন্য যে আস্থার প্রয়োজন তা কার্যত এখন শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি রাজনৈতিক আস্থার পরিবেশ না থাকাটাই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার মুখে যত চমকপ্রদ কথাই বলুন না কেন, দেশের পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সে কথা সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাবলী এবং পরবর্তী নানা পরিস্থিতির বিশ্লেষণে সচেতন নাগরিকদের মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

আস্থার সংকট কতোটা বেড়ে গেছে তা বুঝা যায় অন্য এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত মার্কিনীদের স্বেচ্ছায় ঢাকা ত্যাগ করার অনুমতি দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সাথে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের চলাচলের ক্ষেত্রে নিজ দেশের নাগরিকদের সাবধানের পরমার্শ দিয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে দু’টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে জানা গেছে, এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের পরিবর্তে এখন বৈঠকটি যুক্তরাষ্ট্রেই হবে। অপরদিকে এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টার আয়োজিত টেলিকমিউনিকেশন্স বিষয়ক সম্মেলনটির ভেন্যুও পরিবর্তিত হয়েছে। এখন ঢাকার পরিবর্তে শ্রীলংকা অথবা থাইল্যান্ডে হতে পারে। নিরাপত্তার অভিযোগ তুলে ইতোমধ্যেই পাশ্চাত্যের অনেক দেশ বাংলাদেশে তাদের কার্গোফ্লাইট বাতিল করেছে। সামগ্রিকভাবে এখন আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্রম উন্নতির ভাবনাকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়ার সময় এসে গেছে। শুধুমাত্র কারো প্রতি হুমকি-ধমকি নয়, ক্ষমতার দম্ভে অতি কথন বা কথার ফুলঝুরি কিংবা তোষামোদ নয়, এখনই এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে কেন এবং কোন কোন কারণে প্রকৃতই দেশের অর্থনীতি এমন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী আপনারা মুখে যাই বলুন না কেন, সন্ত্রাসী হামলাগুলোর ঘটনা যে আমাদের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এবং আগামীতেও যে ফেলবে না তার গ্যারান্টি কে দেবেন? সামগ্রিকভাবে আস্থার সংকট দূর করতে না পারলে মূল পরিস্থিতির উন্নয়নের আশা করাটা আদৌ সম্ভব হবে কি? রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বাস্তব সংকট নিরসনে সকল দল ও মত নির্বিশেষে সর্বদলীয় জাতির ঐক্য গড়ে তুলে সম্মিলিতভাবে কার্যকর  পদক্ষেপ নেবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads