বুধবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৭

তিন বছরের হত্যাকাণ্ড

সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে প্রচারণা চালানো হলেও বাস্তবে ছিনতাই, ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো অপরাধ তো বটেই, গুম-খুনের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডও অকল্পনীয় হারে বেড়ে গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ভোটারবিহীন নির্বাচনের পথে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র তিন বছরে সারা দেশে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১২ হাজার ২৭৭টি। এসবের মধ্যে ইতালীর নাগরিক তাবেলা সিজার এবং জাপানের নাগরিক হোসি কুনিও ও হিরোয়ি মিয়াতাসহ কয়েকজন বিদেশী নাগরিক এবং  ক্ষমতাসীন দলের এমপিসহ বেশ কিছু হত্যাকাণ্ড দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। হিন্দু পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং খ্রিস্টান যাজক যেমন, মুসলিম ইমাম ও আলেমও তেমনি হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। ব্লগার, প্রকাশক, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীরাও রয়েছেন নিহতদের তালিকায়। গত বছরের জুন মাসে রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান হোটেলের রাতভর জিম্মি নাটক ও হত্যাকাণ্ড তো সারা বিশ্বেই আলোড়ন তুলেছিল।  
বস্তুত এমন কোনো শ্রেণী, পেশা ও বয়সের কথা বলা যাবে না, যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার না হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। তাদের অনেককে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে গেছে এবং পরে কথিত বন্দুক যুদ্ধের আড়ালে হত্যা করেছে। সব মিলিয়ে বিরোধী দলের এত বেশি নেতা-কর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন যে, তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আলোচ্য তিন বছরে ক্ষমতাসীন দলেরও ১৪৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে। তবে তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিহত হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, হয়েছে, এভাবে বিগত তিন বছরের প্রতিদিন গড়ে ১১ জনের বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। উদ্বেগের কারণ হলো, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের যখন জোর তৎপরতা চালানোর কথা তখনও হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি অন্য সব ধরনের অপরাধ পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। ঘটনাপ্রবাহে গুম এসেছে একটি প্রধান বিষয় হিসেবে। বাংলাদেশে তৎপর মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময়ে তাদের রিপোর্টে ও পর্যবেক্ষণে বলেছে, গুম আর খুনের ঘটনা বেড়ে চলেছে আসলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে যেখানে চার হাজার ৯৯ জন মানুষ খুনের শিকার হয়েছিল, ২০১৩ সালে সেখানে চার হাজার ৩৯৩ জন নিহত হয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে সারা দেশে খুন হয়েছে ২৫ হাজার ১৯৪ জন। ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে নিহত হয়েছে এক হাজার ৬৭২ জন। অর্থাৎ ৭৭ মাসে মোট খুন হয়েছে ২৬ হাজার ৮৬৬ জন। পরের বছর ২০১৬ সালে সে সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে। অর্থাৎ খুনের মতো ভয়ংকর অপরাধ দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে।
আমরা মনে করি এবং একথা অনেক উপলক্ষেই বলে এসেছি যে, হত্যাকাণ্ডসহ দ্রুত বেড়ে চলা অপরাধের বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, পরিস্থিতির শুধু ক্রমাগত অবনতিই ঘটে চলছে না, বিশেষ করে রাজনৈতিক দমন-নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো জনমনে প্রবল ভীতিরও সঞ্চার করেছে। দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে সংক্ষেপে উল্লেখিত ঘটনা ও সংখ্যার বাইরে এমন আরো অনেক তথ্যও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশিত হয় যেগুলো সরকারের দমনমূলক নীতি ও কর্মকা-কেই প্রাধান্যে আনে। অর্থাৎ সবকিছুর জন্য দায়ী আসলে সরকার। অথচ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকাশিত ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করাসহ অপরাধ কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিল। অন্যদিকে প্রথম থেকেই ঘটে চলেছে উল্টো রকম। সাধারণ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বেড়ে চলেছে গুমের ঘটনাও। কারা হেফাজতেও বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভীতিকর গুপ্তহত্যা। আপত্তির কারণ হলো, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বদৌলতে বাংলাদেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ‘ওপেন সিক্রেট’-এ পরিণত হয়েছে। এ সত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ২০১৪ সালে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আসলেও দেশে খুনখারাবির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। 
এ প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বলা দরকার, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ও ক্রসফায়ারের মতো কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না বলেই দেশে হত্যাকাণ্ডসহ সব ধরনের অপরাধ বেড়ে চলেছে। অনেক হত্যাকাণ্ডের পেছনে সরকারের ভূমিকাও গোপন থাকছে না। ভিন্নমতাবলম্বীদের ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। অথচ কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন অবস্থা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা আশা করতে চাই, সরকার বিশেষ করে হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও প্রতিহত করার লক্ষ্যে অবিলম্বে উদ্যোগী হবে। বলা দরকার, র‌্যাব ও পুলিশসহ আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর লোকজনকে যদি দলীয় কর্মী ও লাঠিয়ালের মতো ব্যবহার না করা হয় এবং তাদের যদি স্বাধীনভাবে নিজেদের কর্তব্য পালন করতে দেয়া হয় তাহলেই স্বল্প সময়ের মধ্যে সব ধরনের অপরাধ কমে আসতে পারে। সে লক্ষ্যে তৎপর হওয়াটাই সরকারের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads