বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০১৭

সংবাদ মাধ্যমের কালোদিবস

আজ ঐতিহাসিক ১৬ জুন। বাংলাদেশে দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে সংবাদপত্রের তথা গণমাধ্যমের কালোদিবস হিসেবে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় দেশের চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়েছিল। ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস- এই চারটি দৈনিককে টিকিয়ে রেখেছিল সরকার। কিন্তু সরকারের মালিকানায় নেয়ার ফলে এসব দৈনিকে ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির গুণকীর্তন ছাড়া অন্য কোনো খবর পাওয়া যেতো না। সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার এই পদক্ষেপের ফলে বেকার হয়ে পড়েছিলেন শত শত সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবী। জাতি বঞ্চিত হয়েছিল সঠিক সংবাদ জানার মৌলিক অধিকার থেকে। 
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার শুরু থেকেই সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে সহিংস পন্থায় দমনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক ও স্বৈরশাসকদের কায়দায় স্বাধীন বাংলাদেশেও সরকারের বিরোধিতাকে রাষ্ট্র ও স্বাধীনতার বিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে একদিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা দমন-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, অন্যদিকে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশও। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় রক্ষীবাহিনীসহ নানা নামের বাহিনীকে বিরোধী দলকে দমনের জন্য লেলিয়ে দিয়েছিল সরকার। পল্টন ময়দানের জনসভায় বিরোধী দলের ওপর ‘লাল ঘোড়া দাবড়ায়া’ দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। দলের কর্মীদের ‘সুন্দরী কাঠের লাঠি’ হাতে নেয়ার নির্দেশ এসেছিল সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা গেছে, প্রথম আওয়ামী লীগ এবং বাকশাল সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরে বিরোধী দলের ৩৭ হাজার নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন। 
রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সংবাদপত্রের ওপরও সরকার প্রচ- দমনের অভিযান চালিয়েছিল। জেনারেল আইয়ুব খান প্রবর্তিত ১৯৬০ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স নামের কালাকানুনটিকেই ১৯৭৩ সালে সে ‘মুদ্রণযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স’ নামে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই অধ্যাদেশের আড়াল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা একদিকে সরকার বিরোধী সংবাদ প্রকাশনার ওপর কঠিন নিয়ন্ত্রণ চাপিয়েছেন, অন্যদিকে নিষিদ্ধ করেছেন একের পর এক সংবাদপত্রের প্রকাশনা। ১৯৭২ সালেই নিষিদ্ধ হয়েছিল মওলানা ভাসানীর ‘হক-কথা’, সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি’, ‘লাল পতাকা’, ‘নয়াযুগ’, মুখপত্র’ ও ‘স্পোকসম্যান’ এবং চট্টগ্রামের দৈনিক ‘দেশবাংলা’। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুদের মূল দল জাসদের মুখপত্র দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। ‘হক-কথা’ সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারী এবং ‘গণকণ্ঠ’ সম্পাদক কবি আল মাহমুদসহ কয়েকজন সম্পাদককেও গ্রেফতার করেছিল সরকার। এ পর্যন্ত এসেও যথেষ্ট মনে করেননি ক্ষমতাসীনরা, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সব সংবাদপত্রকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন তারা। 
সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে নেয়া এই পদক্ষেপ ছিল প্রথম সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী সামগ্রিক নীতি ও কর্মকাণ্ডের অনিবার্য অংশ। সীমাহীন লুণ্ঠন, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, আওয়ামীকরণ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার পরিণতিতে দেশ ততদিনে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। ১৯৭৪ সালের সে দুর্ভিক্ষে কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। অমন এক পরিস্থিতিতে দরকার যখন ছিল সব দলকে সঙ্গে নিয়ে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা ও উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালানো তখন ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ আড়ালে প্রধান নেতার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সরকার বিরোধিতাকে সমূলে উৎখাত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদকে দিয়ে প্রথমে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়, সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় দেশের একমাত্র দল বাকশাল। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে চেয়ারম্যান করে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। এরই ধারাবাহিকতায় চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয় ১৬ জুন। 
বলা হচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও প্রথম সরকারের পথেই এগিয়ে চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমও। দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, এখনো দৈনিকটিকে প্রকাশ করতে দেয়া হচ্ছে না। আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কয়েকবার শুধু গ্রেফতার করা হয়নি, রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনও চালানো হয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের দু’বার নির্বাচিত সভাপতি শওকত মাহমুদসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিকেও নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নানা কৌশলের আড়ালে চাপানো হচ্ছে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। তথ্য-প্রযুক্তি আইনের আড়াল নিয়ে অনলাইন পত্রিকাগুলোর ওপরও খবরদারি চালানো হচ্ছে।
অর্থাৎ বর্তমান সরকারও বাকশাল সরকারের মতোই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একই কারণে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও বাকশালের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads