বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০১৭

নির্বাচন প্রশ্নে শুভাকাঙ্খী দেশগুলোর আহ্বান

সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না এলেও এরই মধ্যে জাতীয় সংসদের পরবর্তী নির্বাচনকেন্দ্রিক জোর তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তো বটেই, এমনকি যে দলটিকে ঘিরে এখনো নানা সংশয় রয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান সেই দল বিএনপির নেতা-কর্মীরাও নির্বাচনী কর্মকান্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতাও লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। ক’দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিশেল বার্নিকাট প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন। বৈঠকে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই বৈঠক ও আহবান নিয়ে রাজনৈতিবক অঙ্গনে আলোচনা জমে ওঠার আগেই গত মঙ্গলবার (৬ জুন) সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করতে গিয়েছিলেন ব্রিটেনের হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক। তিনি একা যাননি, তার সঙ্গে ছিলেন আরো তিনজন উচ্চ পদস্থ কূটনীতিক। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনও সব দলের অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও তার সঙ্গে যাওয়া প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার সারাসরি জবাব না দিলেও বৈঠকে তাদের বক্তব্য সম্পর্কে জানা গেছে নির্বাচন কমিশন সচিবের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন, হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সিইসির প্রতি আহবান জানিয়েছেন। হাইকমিশনার বলেছেন, ব্রিটেন চায় আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক এবং দেশের সব রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক আরো বলেছেন, তারা বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সিইসির সঙ্গে বৈঠক করতে এবং যারা এ লক্ষ্যে কাজ করছেন তাদের প্রতি সমর্থন জানাতে এসেছিলেন। কমিশনের সঙ্গে আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। তিনি একই সঙ্গে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে অনুষ্ঠিত কর্মকান্ডের নেতিবাচক বিভিন্ন দিকেরও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ব্রিটেন আবারও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন দেখতে চায় না। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, বৈঠকের বিস্তারিত আলোচনা সম্পর্কে না জানালেও ব্রিটিশ হাইকমিশনার অল্প কথায় তার মূল কথাগুলো ঠিকই জানিয়ে গেছেন। এসবের প্রধান কথাটুকু হলো, দেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং সে নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে।  কথাটার অর্থ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত একদলীয় এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের উদাহরণ উল্লেখ করার মধ্য দিয়েও হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ব্রিটেন আর অমন নির্বাচন দেখতে চায় না। এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে একটি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। সে তথ্যটি হলো, ব্রিটেন এবারই প্রথম এমন মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালেও বিভিন্ন উপলক্ষে ব্রিটেন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের, বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থার মীমাংসা করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত হিসেবে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর একাধিকবার ঢাকা সফরকালেও ব্রিটেন মহাসচিবের উদ্যোগের প্রতি সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছিল। এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গেও ব্রিটেন তৎপরতা চালিয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা দরকার, জাতিসংঘ মহাসচিব তথা তার বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যাথেরিন অ্যাশটন যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, ব্রিটেন তার সঙ্গেও একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, জাতিসংঘ মহাসচিবের পাঠানো দূতের প্রচেষ্টাসহ নানাভাবে বহু উদ্যোগ নেয়ার পরও বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের মতো পরিবেশও তৈরি করতে পারেনি তারা। এসব কারণেই নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে ইইউ। 
বিবৃতিতে সহিংসতা বন্ধ করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল, যাতে ভোটাররা তাদের পছন্দ বেছে নিতে ও পছন্দের প্রার্থী ও দলকে ভোট দিতে পারে। উল্লেখ্য, এই বিবৃতিরও অনেক আগে থেকে ইইউ নির্বাচনের ব্যাপারে একই তাগিদ দিয়ে এসেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে, ২০১৩ সালের নভেম্বরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্রিটেন এবং ইইউ-এর অন্য প্রতিনিধিরা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন। তারা এ কথাও জানিয়েছিলেন, সব দল অংশ না নিলে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে পারে। শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তই নিয়েছিল ইইউ। এর সঙ্গেও একাত্মতা প্রকাশ করেছিল ব্রিটেন। উল্লেখ্য, ইইউ-এর বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ৫ জানুয়ারির সে নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। 
এভাবেই আন্তর্জাতিক সকল মহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা খুইয়েছিল। সেই থেকে প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার এখনো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেনি। এখনো বরং কথা উঠলেই ওই নির্বাচনের উদাহরণ টেনে আনা হয়। যেমনটি এনেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত। মাত্র সেদিনের এই অতি তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই আমরা মনে করি, বর্তমান পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি দরকার সব দলের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করা। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেই। আমরা আশা করতে চাই, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সরকার সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিকে নিশ্চিত করবে। এ উদ্দেশ্যে সরকারকে অবিলম্বে সকল প্রকার দমন-নির্যাতন এবং মামলা ও গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে দেশে যেমন গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, অন্যদিকে তেমনি ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর আহবান ও পরামর্শের প্রতিও যথাযথ সম্মান দেখানো যাবে। সরকারের উচিত, গণতন্ত্রসম্মত এ পথটিকেই অগ্রাধিকার দেয়া।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads