মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

আমার দেখা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’

আগামীকাল ২৯ ডিসেম্বর। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। এই দিন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী তৎকালীন ১৮ দলীয় ঐক্যজোট বর্তমান ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে জোট নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একতরফা প্রহসনের নির্বাচনকে ‘না’ ও গণতন্ত্রকে ‘হ্যাঁ’ বলতে জাতীয় পতাকা হাতে সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষকে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মিলিত হওয়ার আহ্বান জানান। ঢাকা অভিমুখে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ঠেকাতে নজিরবিহীনভাবে গোটা দেশকে অবরুদ্ধ করে রাখে সরকার। যানবাহন, রেল ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে সরকার যেমন রাজধানী থেকে গোটা দেশকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল তেমনি রাজধানী ছিল যান শূন্য। রাজধানীর প্রত্যেকটি প্রবেশ পথেই ব্যারিকেড বসিয়ে তল্লাশির নামে হয়রানি, যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া, সরকারি দলের মারমুখী লাঠি মিছিল রাজধানী জুড়ে সৃষ্টি করে চরম আতংকজনক পরিস্থিতি। নজিরবিহীনভাবে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশী পাহারায় আ’লীগ লাঠিয়ালরা হামলা চালায়। কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বের হওয়ার চেষ্টা করলেও আইনশৃংখলা বাহিনী বালির ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেট সৃষ্টি করে তাঁকে বের হতে দেয়নি। একদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শান্তি ও গণতন্ত্রপ্রিয় নিরস্ত্র জনতার উপর হামলা চালানোর সরকারি বেপরোয়া নির্দেশ অন্যদিকে ভাড়াটিয়া সশস্ত্র সন্ত্রাসী সহ আওয়ামী লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা ঢাকার ওলি-গলিতে হিংস্র ও মারমুখী অবস্থান গ্রহণ করে। যার ফলে ঢাকা হয়ে ওঠে যেন এক অসম রণাঙ্গন। যার একদিকে রয়েছে জনগণের টেক্সের পয়সায় পরিচালিত আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যারা মূলত নিরীহ শান্তিপ্রিয় দেশপ্রেমিক জনতার বিরুদ্ধে কার্যত অবস্থান নিয়ে আওয়ামী সরকারকে স্থায়িত্ব দেয়ার জন্য অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যদিও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই একপেশে ও বেপরোয়া আচরণ শাসকগোষ্ঠীর জন্য একদিন এরাই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের ভূমিকায় আবির্ভূত হবে। অন্যদিকে দেশপ্রেমিক জনতা ভোট ও বাক স্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৮ দলীয় জোটের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজারো প্রতিকূলতা মাড়িয়ে সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সারাদেশ থেকে ঢাকায় আসলেও মিছিল করার জন্য কোন এক জায়গায় সমবেত হওয়া তো দূরের কথা কার্যত জনতা যে যেখানে ছিল সেখানেই অবরুদ্ধ হয়ে যায়। কার এতো সাধ্য! নিরীহ জনতাকে টার্গেট করে রাখা বন্দুকের নল উপেক্ষা করে, সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হিং¯্র থাবার মুখে জীবন বাজি রেখে সামনে এগুবে? নিঃসন্দেহে ঐ কঠিন সময়ে দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম সফল করতে ফ্যাসিবাদী সরকারেরর হিমালয়সম প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে রাজপথে হাজির হয়ে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেয়া ছিল সময়ের দাবি। ইতিহাস সাক্ষী যুগে-যুগে যারাই সত্য-ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা ছিলেন সেই সময়ের তরুণ ও যুবসমাজের অগ্রসেনানী। আর এই দুঃসাহসী তরুণদের আত্মত্যাগের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ আলোকিত সমাজ আর মূলোৎপাটিত হয়েছে সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, জুলুম ও নির্যাতন। মানুষ ফিরে পেয়েছে তাদের হারানো অধিকার। আর এভাবেই সূচিত হয়েছে নতুন সভ্যতার। নিকট অতীতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ ৯০’এর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা যুগ-যুগ ধরে তরুণ ও যুব সমাজকে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
কিন্তু বর্তমান তরুণ সমাজের কি এমন হয়েছে যে, তারা আজ সমাজ জীবনে ঘটে যাওয়া অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, খুন, গুম, শোষণ-বঞ্চনা, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, দুর্নীতি, অপশাসন, বাক-স্বাধীনতা হরণ ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন সহ প্রকাশ্যে দিবালোকে অসংখ্য ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পরও তরুণ ও যুব সমাজ আজ নির্বাক, নিশ্চুপ। মনে হয় তরুণ সমাজ আজ এতটাই নির্জীব হয়ে পড়েছে যে, তাদের চোখের সামনে সংগঠিত হওয়া এসব লৌমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখেও না দেখার এবং শুনেও না শুনার ভান করছে। অসংখ্য মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ, সন্তান হারা পিতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, ভাই হারা বোনের ক্রন্দন, স্বামী হারা স্ত্রীর অসহায় আহাজারিতে বাংলার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠলেও এসব অমানবিক ঘটনা ভোগবাদী সমাজের তরুণ সমাজের হৃদয়কে একটুখানিও নাড়া দিতে পারছে না। তাহলে কি গোটা তরুণ সমাজই আজ ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধটুকু হারিয়ে ফেলেছে? 
না, তেমনটি হওয়ার কথা নয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে সমাজে এর ব্যতিক্রম চিত্রও রয়েছে। যা সত্যিই আমাদেরকে আশায় বুক বাঁধতে অনুপ্রেরণা যোগায়। তরুণ সমাজের মধ্য থেকে একটি বড় শক্তির উত্থান হয়েছে যারা সত্য ও সুন্দরকে বুকে ধারণ করে সম্মুখ পানে ছুটে চলেছে অবিরাম। তাদের আদর্শ হচ্ছে মহান আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ দ্বীন আল-ইসলাম। তাদের নেতা হচ্ছেন বিশ্বনবী ও বিশ্বনেতা মুহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ (সা.)। তাদের মঞ্জিলে মাকসুদ হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করে জান্নাত লাভ করা। তাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়-‘তোমার সৃষ্টি মানবকল্যাণের নিমিত্তে। তোমার কাজ হলো সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করা এবং মিথ্যা ও অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তোমার চরিত্র হবে নিষ্কলুষ পবিত্র। তুমি নিজে সেবা গ্রহণ করে নয়, অন্যকে সেবা করে আনন্দ পাবে। নিজের প্রাপ্য অধিকারের চাইতে কমের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে অন্যকে তার প্রাপ্যের চাইতে বেশি দিতে প্রস্তুত থাকবে। তোমার শত্রুরাও তোমার ওপর এই আস্থা রাখবে যে, কোন অবস্থায়ই তুমি ভদ্রতা ও ন্যায়-নীতি বিরোধী প্রতিশোধ পরায়ণ কোন আচরণ করবে না। তাই তো দেখা যায় এই আদর্শকে ধারণ করে ও উল্লেখিত চরিত্রের আলোকে এই ব্যতিক্রমী আদর্শবাদী ছাত্র ও যুব কাফেলার কর্মীরা তাদের প্রিয় ও নিরপরাধ দায়িত্বশীলদের সাথে ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক সম্পূর্ণ অন্যায়, অবিচার ও বাড়াবাড়িমূলক আচরণের পরও তারা আইনকে হাতে তুলে নেয়নি। এমনকি এরকম নিরপরাধ, নির্দোষ, জননন্দিত নেতৃবৃন্দকে ষড়যন্ত্রমূলক হত্যার পরও তারা উত্তেজিত হয়ে প্রতিপক্ষ দলের কোন নেতা-কর্মী এমনকি কোন সমর্থকের গায়েও সামান্যতম আঁচড় লাগায়নি। এটাই এই আদর্শবাদী দলের ছাত্র যুব কাফেলার এক ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। যার ফলে অসংখ্য অপপ্রচার, মিথ্যাচার, কুৎসা রটনা ও জুলুম-নির্যাতনের পরও আজ এই কাফেলা বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোটি-কোটি অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের হৃদয়ে আশার আলো জাগাতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে এদেশের লক্ষ লক্ষ মেধাবী তরুণরা দলে দলে এই কাফেলার পতাকাতলে সমবেত হচ্ছে। তাই তো সমাজের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী সহ সমাজের প্রত্যেক শ্রেণী ও পেশার অভিজ্ঞ ও বিদগ্ধজন এই তরুণ কাফেলাকে তাদের হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসা পোষণ করেন এবং বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়ে সমৃদ্ধ ও আলোকিত করে চলেছেন। ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় যে ধরনের মেধাবী ও আদর্শবাদী নেতৃত, ত্যাগী এবং যোগ্য কর্মী বাহিনী প্রয়োজন এই তরুণ কাফেলা ইতোমধ্যেই সে ধরনের নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী গঠনে অনেক দূর পথ অগ্রসর হয়েছে একথা সত্যি কিন্তু তাদেরকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে, একথা সত্য, ঘুণে ধরা এ সমাজের পরিবর্তন করে, সকল প্রকার জালিম-জুলুম ও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের জন্য প্রয়োজন আরো মজবুত ঈমান, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, মজবুত ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যক্তিগত আবেগ উচ্ছাস ও স্বার্থের নিঃশর্ত কুরবানী। এ কাজের জন্যে এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন, যারা সত্য ও ন্যায়ের প্রতি ঈমান এনে তার উপর পাহাড়ের মতো অটল হয়ে থাকবে। অন্য কোনো দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না। পৃথিবীতে যাই ঘটুক না কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবে না। পার্থিব জীবনে নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতির সকল সম্ভাবনাকে অকাতরে কুরবানী করে দেবে। স্বীয় সন্তান সন্ততি, পিতা মাতা ও আপনজনের স্বপ্ন সাধ বিচূর্ণ করতে কুণ্ঠাবোধ করবেনা। আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবদের বিচ্ছেদ বিরাগে চিন্তিত হবেনা। সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, জাতি, স্বদেশ, যা কিছুই তাদের উদ্দেশ্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে, তারই বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ও নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। অতীতেও এ ধরনের লোকেরাই সমাজ পরিবর্তন ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রকৃত ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছে। আজও কেবল এ ধরনের বৈশিষ্ট্যম-িত লোকেরাই মানুষের মৌলিক অধিকার তথা ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। 
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য ও আদর্শকে বুকে ধারণ করে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সবুজ ভূখ-ে যাত্রা শুরু করে যে সংগঠনটি সেটিই হচ্ছে হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাওয়া গণতন্ত্রপ্রিয় অসংখ্য মানুষের আশা-ভরসার স্থল, কোটি ছাত্রের হৃদয়ের স্পন্দন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের মানুষের অতিপরিচিত, মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ছাত্রসমাজের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে বরাবরই দায়িত্বশীল ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এ তরুণ কাফেলা। তারই ধারাবাহিকতায় বিগত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত ২০ দলীয় জোটের বিগত আন্দোলনে এক ঐতিহাসিক ও দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। এরই অংশ হিসেবে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ১৮ দলীয় বর্তমান ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে একতরফা প্রহসনের নির্বাচনকে ‘না’ ও গণতন্ত্রকে ‘হ্যাঁ’ বলতে জাতীয় পতাকা হাতে সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষকে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মিলিত হওয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই তরুণ কাফেলার শহীদ মনসুর আহমদ শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ও ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে জীবনের সকল পিছুটানকে পিছনে ফেলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে মিছিলে অংশ নিয়ে রাজধানীর ঢাকার মালিবাগে পুলিশের গুলীতে নিহত হন। সেদিন সরকার ও তার বাহিনী মনে করে থাকতে পারে এই হত্যাকা-ের মাধ্যমে তারা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’-কে ব্যর্থ করে দিতে পেরেছে। না, আসলে তা নয়। বরঞ্চ সেদিনের একমাত্র শহীদ নির্ভিক সেনানী মনসুরের শাহাদাত, সরকারের আন্দোলন বানচালের অপচেষ্টাকেই প্রকৃত অর্থে ব্যর্থ করে দিয়েছে এবং ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসির’ সফলতার ভিতকে মজবুত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই সেদিনের এই আত্মত্যাগের মাধ্যমে শহীদ মনসুর ‘ধ্রুব তারার’ মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। যুগ-যুগ ধরে গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সংগ্রামী মানুষের জন্য প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন। একই সাথে তার এ বীরত্ব গাঁথা অবদান গণতন্ত্রকামী মানুষকে উজ্জীবিত করার পাশাপাশি ভোটাধিকার হরণকারী, স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনে মাইলফলকের ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্র কার্যত অনুপস্থিত। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেকোন সময় গণতন্ত্রের জানাযা শেষে দাফন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। গণতন্ত্রের নামে আজ বাংলাদেশে যার চর্চা হচ্ছে তাকে গণতন্ত্র বলে না- একথা যখন কোন দলের এক্টিভিস্টের মুখে নয়, উচ্চারিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত সম্মানিত উচ্চস্তরের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মুখে তখন বুঝা যায়, কি ধরনের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যে আমাদের বসবাস করতে হচ্ছে, বিবিসি বাংলা সার্ভিসের সাথে কথা বলার সময় তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করেন, যা সম্প্রতি প্রচারিত হয়। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর মানুষ আশা করেছিল যে, কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়াই প্রত্যেক ব্যক্তির নাগরিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারসহ সকল প্রকার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। সব ধরনের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে ব্যক্তি স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, ধর্ম পালন ও বক্তব্য প্রদানের স্বাধীনতার অধিকারের চর্চা করবে স্বত:স্ফূর্তভাবে। একটি নবীন স্বাধীন দেশের নব অভিযাত্রা দেশকে নতুন যুগে নিয়ে যাবে। কিন্তু ৪৪ বছরেও সে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। স্বাধীনতা অব্যবহিত পর যারা ক্ষমতা লাভ করেছিলেন তারা নতুন দিক নির্দেশনা তৈরি করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়া তো দূরে থাক বরঞ্চ তাদের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের ফলে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত নবীন এ রাষ্ট্রটি তলাবিহীন ঝুড়ির অভিধায়ে অভিহিত হয়। ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে না দিয়ে ’৭৫সালে বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের পতন, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে পরপর তিনটি অভূতপূর্ব নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শিশু গণতন্ত্র যখন হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে কৈশর পেরিয়ে যৌবনের পানে অগ্রসর হচ্ছিল ঠিক তখনই গণতন্ত্র বিরোধী বাকশালী চক্র তাদের দেশি-বিদেশি দোসরদের সাথে নিয়ে গণতন্ত্র ও দেশ বিরোধী চক্রান্তের নতুন জাল বুনতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত ৪ দলীয় জোট সরকারকে অন্যায় ও অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা থেকে হটাতে একের পর এক দেশ বিরোধী ও নাশকতামূলক কর্মসূচি পালন করতে থাকে। এতে ব্যর্থ হয়ে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ৪ দলীয় জোট সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার দিন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে সারা দেশ থেকে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী সংগ্রহ করে লগি-বৈঠাধারী দলীয় ক্যাডার সমেত একযোগে নিরীহ ছাত্র জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বায়তুল মোকারম উত্তর গেটে পূর্ব ঘোষিত জামায়াতের জনসভার প্রস্তুতি চলাকালে লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা পল্টন মোড়ে নিরীহ ও নিরস্ত্র জামায়াত-শিবির কর্মী ও সাধারণ জনগণের ওপর হামলে পড়ে। প্রকাশ্য দিবালোকে সাপ পিটিয়ে মারার মতো উপর্যুপরি আক্রমণের মাধ্যমে ঘটনাস্থলেই অনেককে হত্যা করাসহ অসংখ্য বনী আদমকে আহত করে। যা মিডিয়ার মাধ্যমে সমস্ত বিশ্ববাসী অবহিত। এসব প্রকাশ্য অপকর্মের পরও বাকশালীচক্র যখন মহান মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রখ্যাত আলেম-ওলামাদেরকে হত্যায় মেতে ওঠে তখন লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। তারা মানবতাবাদী হতেন কিংবা ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধ যদি তাদের মধ্যে থাকতো, তাহলে তাদের উচিত হতো ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে পল্টনে তাদের দ্বারা সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ যার লাইভ সাক্ষী দেশ-বিদেশের অসংখ্য মিডিয়াসহ কোটি বনী আদম। এই ঘটনার বিচার না করে ৪৪ বছর পূর্বে সংঘটিত ঘটনাকে সামনে এনে মিথ্যা অভিযোগ ও প্রহসনের মাধ্যমে জাতীয় ও ইসলামী নেতৃবৃন্দকে হত্যার মাধ্যমে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছে। এরাই ধারাবাহিকতায় ২০০১-২০০৬ সালের জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক জোট সরকারকে সন্ত্রাসী আন্দোলনের মাধ্যমে উৎখাত করতে ব্যর্থ হয়ে বাঁকা পথে ক্ষমতায় আসার ফন্দি আঁটে। তারই অংশ হিসেবে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনে নমিনেশন দাখিল করার পরও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে তাদেরই ষড়যন্ত্র ও যোগসাজশে ১/১১ সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং এই সরকারকে তাদেরই আন্দোলনের ফসল বলে নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়। তারপর তাদেরই আন্দোলনের ফসল অবৈধ ১/১১ সরকারের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি আঁতাতের মাধ্যমে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ করে বাকশাল ও ইতিহাসের সকল স্বৈরশাসনকে হার মানিয়ে কঠিন একদলীয় ও একব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন কমিটিতে নিজ দলের অধিকাংশ নেতার বিরোধিতা সত্ত্বেও কেয়ারটেকার সরকারের জনপ্রিয় ব্যবস্থাকে বাতিল করে দেয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ১৫৩টি আসনে কোন প্রকার নির্বাচন ছাড়াই ও বাকী আসনগুলোতে প্রহসনের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেও জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে গায়েব জোরে আবারো সরকার গঠন করে। তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে ধরে রাখতে প্রহসনের মাধ্যমে বহু জাতীয় নেতাকে হত্যা এবং আরো নেতাদেরকে হত্যার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করেও সুবিধা করতে না পেরে আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন পাওয়ার মানসে পরিকল্পিত জঙ্গি কার্ড ব্যবহার করতে গিয়ে দেশকে আজ এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেছে যা অকল্পনীয়। 
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার উন্নয়নে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়ার্টকিন্স “আমাদের স্বাধীনতা আমাদের অধিকার চিরন্তন” নামে একটি বিশেষ নিবন্ধ লিখেন- যা ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়। তার নিবন্ধে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বক্তব্য রয়েছে যার অংশবিশেষ নিচে উল্লেখ করা হলো-
“বাংলাদেশ স্বত:স্ফূর্তভাবে আটটি আন্তর্জাতিক মানবধিকার চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং এর ফলে দেশটি কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়াই প্রত্যেক ব্যক্তির নাগরিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অথবা রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু মানবাধিকার বলতে শুধু অর্থনৈতিক ও সামাজিক আচরণকে বুঝায় না, যদি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার না থাকে, তাহলে মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপন করা যায় না। ভয় থেকে মুক্তি ঠিক এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা দারিদ্র্য থেকে মুক্তি। বাংলাদেশ একটি নবীন রাষ্ট্র, যেটি এখনো তার অতীতের সঙ্গে সংগ্রাম করছে, যার দেশটির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সামগ্রিক পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলো ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, গ্রেফতার ও নিরাপত্তা হেফাজত থেকে সুরক্ষা, বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, চলাফেরার স্বাধীনতা, একত্র হওয়া, দল বা ও ধর্ম পালন এবং বিবেক-বুদ্ধি ও বক্তব্য প্রদানের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ আছে। এ বিষয়গুলো যেমন সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য, তেমনি আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ ও অসামঞ্জস্য রয়ে গেছে এবং কিছু বিষয়, যেমন-গ্রেফতার করার সময় অথবা আটকাবস্থায় মৃত্যু, তদন্তকালীন এবং আইনি প্রক্রিয়া চলার সময় হস্তক্ষেপ, গুম ও নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, সাংবাদিক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সুশীল সমাজের মানুষের বিধিবহির্ভূত গ্রেফতার ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং নারী ও কিশোরীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, উত্ত্যক্তকরণ ইত্যাদি এখনো রয়ে গেছে। স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য সংস্থার দ্বারা এ অভিযোগগুলোর তদন্ত হওয়া এবং দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কার্যকর জাতীয় নিরাপত্তা পদ্ধতির অংশ বিশেষ এবং উন্নয়রে প্রক্রিয়া চলমান রাখার জন্য অনস্বীকার্য।” 
আজ প্রয়োজন দেশের তরুণ ছাত্র-যুবকদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত আত্মপ্রত্যয়ী যুবক শহীদ মনসুরের ন্যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠা। শাসক শ্রেণীর সকল অন্যায়ে ও জুলুমের বিরুদ্ধে ১৬ কোটি মানুষের ইস্পাত প্রাচীর ঐক্য সৃষ্টি ও রুখে দাঁড়াবার সাহস প্রদর্শন করতে পারলেই কাক্সিক্ষত মুক্তির সম্ভাবনা সুনিশ্চিত।





মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads