শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৬

আওয়ামী নেতৃত্বের পরিবর্তন ও সম্ভাবনার প্রশ্ন


আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত হওয়ার পর সেতু ও সড়ক যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন পর্যায়ে আলোচনা যথেষ্টই হয়েছে।  দলের সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘কদমবুছি’ করার ছবি দেখেও মুগ্ধজনেরা তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কাউন্সিলকেন্দ্রিক দিনগুলোতে সাধারণ সম্পাদক কে হতে পারেন- এ বিষয়টি নিয়ে যখন জোর জল্পনা-কল্পনা চলছিল তখন ওবায়দুল কাদের বলে রেখেছিলেন, ‘আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখতে পাবে’। সেই ‘চাঁদ’ হিসেবে তিনি নিজেই এসেছেন দৃশ্যপটে। শুধু আসেননি বরং দল থেকে ‘আবর্জনা’ দূর করার মতো কিছু অঙ্গীকার ঘোষণার কারণে এখনো আলোচিত হয়ে চলেছেন। বলা হচ্ছে, প্রকারান্তরে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে আসলেও এমন অনেকে রয়েছে- ‘শুদ্ধ’ মানব ওবায়দুল কাদের যাদের ‘আবর্জনা’ মনে করেন। বলা দরকার, সেতু ও সড়ক যোগাযোগমন্ত্রী হওয়ায় ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে আলোচনা চলছে বহুদিন ধরে। এই আলোচনা বেশি জমে ওঠে বিশেষ করে ঈদের মতো উপলক্ষগুলোতে, লাখ লাখ মানুষকে যখন খানাখন্দকে ভরা সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে যাতায়াত করতে হয়। যখন প্রাণও হারাতে হয় অনেককে। ওবায়দুল কাদের তখনও চমৎকার ভাষায় কথা বলে থাকেন। আশ্বাস তো শোনানই। কাজের কাজ অবশ্য কমই হতে দেখা যায়। কারণ, মন্ত্রী ব্যস্ত থাকেন তাদের উড়াল সেতু আর চার-ছয়-আট লেনের কিছু মহাসড়ক নিয়ে। পদ্মা সেতু নিয়েও ওবায়দুল কাদেরই এ পর্যন্ত বেশি বলেছেন। এখনো বলা শেষ হয়েছে বলে মনে হয় না।
আজকের নিবন্ধ অবশ্য কেবলই ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে পরিকল্পিত হয়নি। তিনি এসেছেন উপলক্ষ হিসেবে। শুনে অতি কৌতূহলী পাঠকদের কারো কারো মুখে বাঁকা হাসি দেখা দিতে পারে, কিন্তু সত্য হলো, জনাব ওবায়দুল কাদেরের নাম শোনা মাত্রই আমার মনে ‘পাঠশালা’ শব্দটি এসে যায়। শুধু পাঠশালা নয়, ‘কারাগারের পাঠশালা’ও! কথাটা তথাকথিত ১/১১-এর অন্যতম ভিক্টিম ওবায়দুল কাদেরই বলেছিলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি আসলে কি ঘটানো হয়েছিল, সে সম্পর্কে এতদিনে অনেক কথা ও কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রধান কর্তব্যকে পাশ কাটিয়ে জেনারেল মইন উ আহমেদের নেতৃত্বাধীন ‘উদ্দিন সাহেবরা’ কতোটা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে রাজনীতি ও রাজনীতিক বিরোধী অভিযান চালিয়েছিলেন, সে সম্পর্কেও বিস্তারিতভাবেই জানা গেছে। এখনো অনেক কাহিনী বেরিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদে বলেছেন, অভিযোগ তুলেছেন। সব মিলিয়েই তত্ত্বাবধায়ক নামের ওই সরকারকে বৈধতা দেয়া-না দেয়ার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু সেটা ওঠেনি। আসলে উঠতে দেয়া হয়নি। রাজনীতিকদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টিকে তো ধামাচাপাই দেয়া হয়েছে। তাই বলে ধামা একেবারে চাপা দেয়া যায়নি। বিশেষ করে রাজনীতিকদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিষয়টি। উদাহরণ দেয়ার জন্য দু’চারজন রাজনৈতিক নেতার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হলে পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্রথমে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের কথা, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পর ওবায়দুল কাদের যার উত্তরসূরী হিসেবে নির্বাচিত বা নিযুক্ত হয়েছেন। ‘উদ্দিন সাহেবরা’ বিদায় নেয়ার এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর নিজের অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনাতে গিয়ে ঝড় বা আলোড়ন শুধু নয়, তুফানও তুলেছিলেন নওগাঁর আবদুল জলিল। মাঠে-ময়দানে বা বঙ্গভবনের সামনের চত্বরে নয়, এই তুফান তুলেছিলেন জাতীয় সংসদে। ওই ভাষণে অবশ্য নতুন কোনো গৃহযুদ্ধের হুমকি দেননি আবদুল জলিল। তেমন হুমকি দেয়ার মতো আবস্থাই তার ছিল না। না থাকার কারণ, তিনিও উদ্দিন সাহেবদের রাজনীতিক বিরোধী অভিযানের অসহায় শিকার হয়েছিলেন। আবদুল জলিল জানিয়েছিলেন, কিভাবে চোখ বেঁধে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। উচ্চারণের অযোগ্য অশালীন শব্দযোগে তাকে গালাগাল করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন সম্পর্কে তিনি সম্ভবত লজ্জায় সব কিছু জানাননি। তবু এটুকু অন্তত না জানিয়ে পারেননি যে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলানোর জন্য তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। বাজারে সে সময় যে সিডির ছড়াছড়ি ঘটেছিল, তার ছবিতে আবদুল জলিলকে চোখ খোলা অবস্থায় শেখ হাসিনা সম্পর্কে ‘যা-তা’ বলতে দেখা গেছে। কিন্তু সংসদের ভাষণে আবদুল জলিল জানিয়েছিলেন, কথা বলার সময় তার চোখ বাঁধা অবস্থাতেই ছিল। পরে ক্যামেরার কারুকাজে ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে, যেন তিনি চোখ খোলা থাকা অবস্থায় কথাগুলো বলেছিলেন!
আবদুল জলিল দাবি করেছিলেন বলে ধরে নেয়া যায়, কথাগুলো তাকে দিয়ে বলানো হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যও স্মরণ করা দরকার। বাজারে যখন আবদুল জলিলের সেই সিডির ছড়াছড়ি এবং সিডির কথাগুলো নিয়ে যখন মানুষের মধ্যে আলোচনা জমে উঠেছিল, তেমন এক সময়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রাণ বাঁচানোর জন্য যার যা খুশি বলতে থাকুক। তাকে (শেখ হাসিনাকে) বাঁচানোর জন্য যেন কাউকে মরতে না হয়। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে উদ্দিন সাহেবদের নিষ্ঠুরতা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, শেখ হাসিনার মতো নেত্রীকেও তখন ‘হাল’ ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সে অবস্থার অন্য ব্যাখ্যা থাকলেও এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, আবদুল জলিলের ওপর এমন কঠোর নিষ্ঠুরতাই চালানো হয়েছিল যে, এত বড় একজন নেতা হয়েও তিনি উদ্দিন সাহেবদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ এই আবদুল জলিলই ১/১১-পূর্ব এবং লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস পরবর্তী ভীতিকর দিনগুলোতে প্রতিদিন কয়েকবার করে প্রেসিডেন্টকে গৃহযুদ্ধের ভয় দেখিয়েছিলেন। সে কারণে ধরে নেয়া যায়, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে কাহিল থাকা আবদুল জলিল যদি জানতেন, তাকে ছেলের বয়সীদের ‘স্যার’ ডাকতে হবে এবং মান-সম্মান খোয়ানোর পর আবেদন-নিবেদন করে চিকিৎসার নামে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে নিজেকে বাঁচাতে হবে, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ওই দিনগুলোতে কথার তুবড়ি ছুটাতেন না। কথায় কথায় গৃহযুদ্ধের ভয় তো দেখাতেনই না। শুধু আবদুল জলিলের কথাই বা বলা কেন? লগি-বৈঠার তাণ্ডব থেকে সংবিধান নির্দেশিত সংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল করে দেয়ার কর্মকাণ্ড চালানো পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে আরো অনেক নেতাই সে সময় উস্কানিমূলক ভূমিকা পালন করেছিলেন। কেউ এমনকি বঙ্গভবনের ‘অক্সিজেন’ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়ার এবং প্রকারান্তরে দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন।
আবদুল জলিলের মতো আরো অনেক রাজনীতিককেই উদ্দিন সাহেবদের দু’বছরে নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছিল। তারাই পরবর্তীকালে একের পর এক মুখ খুলেছেন। ওবায়দুল কাদের অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত জানানোর পরিবর্তে সূচনা বক্তব্য হিসেবে তিনি শুধু এটুকু জানিয়েছিলেন যে, ‘কারাগারের পাঠশালায়’ তাকে ‘বহুকিছু’ শিখতে হয়েছে! আওয়ামী লীগেরই এক প্রবীণ নেতা মহিউদ্দিন খান আলমগীরসহ আরো কয়েকজন কিন্তু মুখ খুলেছিলেন। তারা তাদের ওপর চালানো নির্যাতন সম্পর্কে জানিয়েছেন। বলেছেন, কতটা অন্যায় ও আইন বহির্ভূতভাবে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের পর্যন্ত নাজেহাল করা হয়েছিল। একই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ আরো অনেকেই। তাকে ভয় দেখানোর জন্য পাশের কক্ষে নির্যাতিত অন্য একজনের ‘মাগো-মাগো’ ধরনের আর্তনাদও শোনানো হয়েছিল। এসবই উদ্দিন সাহেবরা করিয়েছিলেন জুনিয়র অফিসারদের দিয়ে- যারা কথায় কথায় রাজনীতিকদের ‘চোদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার’ করেছেন এবং বলেছেন, রাজনীতিকরা জনগণের ‘সবচেয়ে বড় শত্রু’। রাজনীতিকরা দেশের জন্য ‘কিছুই করেননি’! ব্যারিস্টার মওদুদ জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনার একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিসহ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেই বুট দিয়ে বুকের ওপর লাথি মেরেছেন ওই জুনিয়র অফিসাররা।
এভাবে উদাহরণের সংখ্যা বাড়ানো বর্তমান নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য আসলে ‘কারাগারের পাঠশালায়’ বহুকিছু শিখে আসা নেতা ওবায়দুল কাদের এবং উদ্দিন সাহেবদের দু’বছরের বাংলাদেশ সম্পর্কে সংক্ষেপে জানানো। প্রধান দুই উদ্দিন জেনারেল মইন উ এবং ড, ফখরুদ্দিন আহমদের খোঁজ-খবর নেয়ার উদ্দেশ্যও রয়েছে। পাঠকরা তাই বলে বেশি আশা করবেন না। কারণ, প্রধান দুই উদ্দিনেরই আসলে খবর নেই বহুদিন ধরে। বছরখানেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে পাওয়া এবং ঢাকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, দীর্ঘদিন পর জনসমক্ষে এসে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতা দখলকারী গোষ্ঠীর প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমদ। খবরে ভদ্রতা করে বিব্রতকর পরিস্থিতির কথা বলা হলেও বাস্তবে বাংলাদেশীদের ধাওয়ার মুখে পড়েছিলেন তিনি। ঘটনাস্থল ছিল জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার মসজিদ। সেখানে জুমার নামাযের পর এক বাংলাদেশী বন্ধুর জানাযায় অংশ নিতে গেলে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশী মুসল্লীরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় শখ মিটে গিয়েছিল ফখরুদ্দিন আহমদের। বক্তব্য রাখার সুযোগ পাওয়া দূরের কথা, তিনি এমনকি মসজিদের ভেতরেও থাকতে পারেননি। মসজিদ কমিটি কোনোভাবে বাইরে অপেক্ষমান একটি গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিল তাকে। তখনও প্রতিবাদী স্লোগান এবং তুমুল বিক্ষোভ চলছিল। বিক্ষোভকারীরা চিৎকার করে বলছিলেন, এই লোকটি দেশে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন এবং বাংলাদেশকে ১০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে এসেছেন। দেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার দায়েও অভিযুক্ত করেছিলেন অনেকে।
জেনারেল মইন উ সম্পর্কে অবশ্য তেমন কিছু জানা যায় না। মাঝখানে সমাজ সেবা ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার এবং অতি সঙ্গোপনে দেশে যাতায়াত করার কথা শোনা গেলেও বলা হচ্ছে, তিনি আসলে ‘আন্ডার গ্রাউন্ডে’ রয়েছেন! স্মরণ করা দরকার, ২০১০ সালে একবার দেশে এসে মইন উ বলেছিলেন, তিনি নাকি ‘জেনে বুঝে’ কোনো ভুল করেননি! তিনি আরো বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘ভালো কাজ করেছে’ বলেই তিনি জানেন। ওই সরকারের মূল্যায়ন এখনই করা উচিত নয়। এজন্য নাকি ৫০ বছর লাগবে! অন্যদিকে সত্য হলো, সবকিছু এত নগ্নভাবেই তারা করেছিলেন যে, এসবের কোনো একটি বিষয় নিয়েই গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। ৫০ বছর লাগার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কারণ, ‘নাটের গুরু’ ও প্রধান ‘উদ্দিন’ জেনারেল মইন উ আহমেদ যে অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রপতিকে বাধ্য করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন, সে কথা জানতে জাতির কয়েকদিনও সময় লাগেনি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার সময় লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে উঠিয়ে আনাসহ মিষ্টি-মধুর অনেক কথাই শুনিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে মইন উ ও তার সহচররা দেশে ব্ল্যাকমেইলিং-এর রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। ক্ষুদে ব্যবসায়ী থেকে বড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত কাউকেই রেহাই দেননি তারা। সমৃদ্ধি অর্জনের ধারে-কাছে যাওয়ার পরিবর্তে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা সৃষ্টির ব্যাপারেই তাদের বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। দুর্নীতি দমনের নামে ওই সরকার এমন সব শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেই ঢালাও ব্যবস্থা নিয়েছিল- বছরের পর বছর ধরে যারা দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ করেছেন, শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, লাখ লাখ মানুষকে চাকরি দিয়েছেন এবং দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছেন। এসব শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রেফতার হওয়ায় এবং অনেকে ভয়ে পালিয়ে থাকায় তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছিল, অর্থনীতির সকল সূচক হয়েছিল নিম্নমুখী।
রাজনীতির ক্ষেত্রে মইন উ’রা রীতিমতো ‘মহাবিপ্লব’ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ প্রধান নেতা-নেত্রীদের অনেককেই ‘জেলের ভাত’ খাইয়েছিলেন তারা। মামলার পর মামলা চাপিয়ে নেতা-নেত্রীদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সংস্কারের আদেশ চাপিয়েছিলেন। কথায় কথায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ করেছেন মইন উ। কিন্তু বছর না ঘুরতেই তার নিজের বিরুদ্ধেই নানা ধরনের নোংরা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। অর্ধ ডজন আপন ভাই এবং ঘনিষ্ঠ সহচরদের জন্যও ‘ফুলে-ফেঁপে’ ওঠার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ভারতের স্বার্থে সীমান্ত খোলা রেখে বিডিআরকে দিয়ে ‘দোকানদারি’ করিয়েছেন মইন উ। তার হুকুমে হকার উচ্ছেদের নামে লাখ লাখ গরীব মানুষের পেটে লাথি মারা হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন তিনি সেনাবাহিনীর। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় সেনাবাহিনীর পেশাগত দক্ষতা কমে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে চাকরির নামে  সৈনিকদের মধ্যে তিনি অর্থ-বিত্তের লোভ ঢুকিয়েছেন, ব্ল্যাকমেইলিং-এর কাজে নিয়োজিত রেখে সেনাবাহিনীতে দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন। সব মিলিয়েই দেশ ও জাতিকে মইন উ পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে গেছেন। ক্ষমতায় সত্যিকার কোনো গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে অনেক আগেই মইন উ’কে কারাগারে ঢুকতে এবং বিচারের সম্মুখীন হতে হতো। অন্যদিকে মইন উ’র ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রথম থেকেই ‘অন্য রকম’ মনে হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কেও জেনে গেছে সাধারণ মানুষ। সবকিছুর পেছনে রয়েছে একই ‘রোডম্যাপ’। এই ‘রোডম্যাপের’ ভিত্তিতেই লগি-বৈঠার তাণ্ডব এবং ১/১১ ঘটানো হয়েছিল। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তীকালে করা যাবে। বর্তমান নিবন্ধের সমাপ্তি টানার আগে শুধু এটুকুই বলে রাখা দরকার যে, জেনারেল মইন উ’র আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া এবং ফখরুদ্দিন আহমদের ধাওয়া খাওয়ার ‘মধুর’ অভিজ্ঞতার মধ্যে শিক্ষণীয় রয়েছে। দেখা যাক, কারাগারের পাঠশালায় ‘বহুকিছু’ শিখে আসা এই নেতা কিভাবে কোন পথে হেঁটে বেড়ান এবং আওয়ামী লীগকে সত্যিই আবর্জনামুক্ত করতে পারেন কি না। আমাদের বেশি আগ্রহ অবশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে। এসব বিষয়ে ওবায়দুল কাদের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন কি না, নাকি তিনিও কেবলই নেত্রীর নির্দেশ অনুসারে চলবেন এবং তার ইচ্ছা পূরণে ব্যস্ত থাকবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। অভিজ্ঞতা কিন্তু আদৌ আশাবাদী করে না আমাদের।
আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads