মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬

চতুর্দিকে বিপন্ন মানুষের আর্তধ্বনি


গা শিউরে ওঠার মতো আদিম অন্ধকারের দিকে আমাদের সমাজকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অনির্বাচিত সরকার। কান পাতলেই চতুর্দিক থেকে ভেসে আসছে বিপন্ন মানুষের আর্তধ্বনি। কান্নার ধ্বনি শোনা যায় শিশুর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, মা-বাবার-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার কান্নার আওয়াজ। এ আর্তনাদের কারণ একটি নয়, বিবিধ। কেউ কাঁদে স্বজন হারিয়ে, কেউ কাঁদে নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে। কেউ দুর্বৃত্তের চাপাতির কোপে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আর্তনাদ করছে। কেউ বা এসিড-দগ্ধ। কারও কোনো স্বজনের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে সরকার দলের লোকদের গুলীতে কিংবা কারও স্বজনের প্রাণ গেছে ক্রসফায়ার নামক এক অবিশ্বাস্য কিচ্ছায়। কোথায়ও ধর্ষিতা হচ্ছে শিশু, কোথায় কোনো দুর্বৃত্ত তুলে নিয়ে গেছে কোনো যুবতী বা গৃহবধূকে। রাজনৈতিক মতবিশ্বাস ভিন্ন বলে বহু মানুষকে অকাতরে প্রাণ দিতে হচ্ছে। পুত্রহারা পিতার কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে আশপাশের বাতাস। সান্ত¡না দেবার কোনো ভাষা কারও জানা নেই। আর সব চাইতে বিপদের দিক হলো এর প্রতিকার চাওয়ার কোনো জায়গা নেই। 
একটা সময় ছিল, যখন মানুষ এসব অন্যায় অত্যাচারের প্রতিকার চাইতে পুলিশের কাছে হাজির হতো, কিন্তু পুলিশের কাছে মানুষের জানমাল থেকে শুরু করে নারীর সম্ভ্রম কোনো কিছুই এখন আর নিরাপদ নয়। প্রতিকার চাইতে গিয়ে বহু নারী-তরুণী-কিশোরী যুবতী হারিয়েছে সম্ভ্রম। প্রতিকার চাইতে গিয়ে আটক হয়েছেন অনেকেই। শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন কিংবা বিনা কারণেই পুলিশ ডজন ডজন লোককে আটক করে থানায় পুরেছে। ভোর না হতেই থানা ছাপ। রাতভর দেনদরবার করে মুক্তিপণের মাধ্যমে ফিরে গেছে, এ যেন উপনিবেশ আমলের এক বাহিনী। তারা কোনো কিছুরই পরোয়ানা করছেন না, আইন-কানুন-বিচার বিভাগ সব কিছুই তাদের কাছে উপেক্ষিত। এমনি বাহিনী এখন র‌্যাব, তারাও একইভাবে ভয় পাইয়ে দেয়। এখন র‌্যাব-পুলিশ দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। 
পুলিশের ধারণা, তারাই সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে, হয়তো এই ধারণাই সত্য। বাংলাদেশ এখন পুলিশ রাষ্ট্র বই আর কিছুই না। ফলে পুলিশ অত্যন্ত বেপরোয়া। কোথায়ও কোনো ঘটনা ঘটলেই পুলিশ অভিনব কায়দায় মামলা দায়ের করে। সে মামলায় আসামী করা হয়, কয়েকজনের নাম লিখে হাজার হাজার লোককে। তারপর যাকে খুশি তাকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে। এ অভিযোগ অসংখ্য, এ অভিযোগ যেমন সাধারণ মানুষের তেমনি ব্যবসায়ীদেরও। ব্যবসায়ীদের পরিবারও মাঝেমধ্যে প্রেস কনফারেন্স করে জানান দেন, মুক্তিপণের দাবিতে তাদের পরিবারের ব্যবসায়ী সদস্যকে পুলিশ অপহরণ করেছে। আর এই যে অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে মামলা সে এক মহাফাঁদ। এই ফাঁদে সাধারণ মানুষকে আটকানোর জন্য আকস্মিকভাবে তারা মধ্যরাতে হামলা চালায় কোনো গ্রামে, জনপদে। মানুষ ধরে আনে দাস ব্যবসার কায়দায়। ফলে গ্রামকে গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে যায়। পুরুষ শূন্য হয়ে গেছে। নারীরাও এখন আর নিরাপদ নন পুলিশের হাত থেকে। তারা ছাত্রী মেসে হানা দেন। ছাত্রীদের ধরে এনে জানান দেন, এরা জঙ্গি। ব্যস, হয়ে গেল। একবার জঙ্গির তকমা এঁকে দিতে পারলেই, এই যে নারীদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে, সেটি হালাল হয়ে যায়। তারপর পত্রিকায় ফলাও করে ছবি ছাপা হয়। বিনা কারণে কেবল পর্দা-পুষিদার জন্য ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলিম নারীরা এখন নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। 
এছাড়া প্রতিনিয়তই সমাজের একই ধরনের অপরাধমূলক ও নির্যাতনমূলক ঘটনা ঘটছে। তার জন্য দায়ী প্রধানত শাসক দলের লোকেরাই। আর এই দলের প্রধান পান্ডা ছাত্রলীগ নামক এক ভয়ঙ্কর বাহিনী। এরা করছে না সমাজের মধ্যে এমন কোনো অপকর্ম নেই। চাঁদাবজি, টেন্ডারবাজি, মুক্তিপণ আদায়, মাদক বা অস্ত্রের ব্যবসা- এসব কিছুতে যেমন ছাত্রলীগ আছে, তেমনি আছে নারী নিগ্রহের সঙ্গেও। কিছু দিন আগে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ পা-া বদরুল প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রকাশ্যে খাদিজা নামের এক ছাত্রীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ফেলে দিয়েছিল। খাদিজা এখনও চিকিৎসাধীন, ভয়ে-আতঙ্কে তার স্মৃতি বিভ্রম ঘটেছে। সে কখনো তার বাবাকে ‘আঙ্কেল’ ডাকছে, কখনো কখনো মাকে ডাকছে ‘আন্টি’। কিন্তু বদরুলের বিরুদ্ধে তেমন কেনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এই বদরুল অচেনা কেউ নয়, একটি হাস্যকর খবর বেরিয়েছে- বদরুলকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এমন হাস্যকর খবর পুলিশ নিয়েও প্রকাশিত হয়। পুলিশ যখন কোনো অপরাধ করে, তখন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে বলা হয়- এদের ‘ক্লোজড’ করা হয়েছে। কিংবা বলা হয়, বদলি করা হয়েছে। অর্থাৎ কিছুদিন তারা পুলিশ সদর দফতরে বসে থাকেন, তারপর যথারীতি তাদের পোস্টিং হয়ে যায়। আর বদলি কোনো শাস্তি নয়। শুধু পুলিশ কেন, সকল সরকারি চাকরিই বদলিযোগ্য। ফলে চাকরির ক্ষেত্রে এটা তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ছাত্রলীগ প্রসঙ্গেও একই কথা বলা যায়। যখন ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগের কোনো সদস্য বড় ধরনের অপরাধ করে, তখন ছাত্রলীগের তরফ থেকে বলা হয়, তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পুলিশও ছাত্রলীগের অপরাধীদের দেখেও দেখে না। ঐ ছাত্রলীগাররা কিছুদিন হয়তো চুপ করে থাকে। তারপর আবার মিছিল-টিছিলে সামনে এগিয়ে আসে। আবার নানা ধরনের অপকর্মে জড়াতে থাকে। অস্ত্রবাজি, টেন্ডারজিতে মেতে ওঠে, কেউ কিছুই করে না। এদের গ্রেফতারের ঘটনা অপরাধের তুলনায় অতি নগণ্য। গ্রেফতারের পর কারো শাস্তি হয়েছে এমন শোনা যায় না।
সম্প্রতি রাজধানীর গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদের সময় অবৈধ অস্ত্র হাতে মহড়া দেন ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ সারির নেতা। তাদের একজন ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন, অপর জন ওয়ারি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান। তাদের সম্পর্কে জানা যায়, এই পদে আসার আগে তাদের কেউ চিনতোই না। আর পদ পাওয়া মাত্রই এরা এলাকায় দোকান দখল করে অফিস বানিয়েছে। সেই অফিস ঘিরেই তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ করে তুলেছে এলাকার ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষদের। এরা অচেনা কেউ নয়। এদের স্পষ্ট ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। যথারীতি ছাত্রলীগ বলেছে যে, ঐ দুজন অস্ত্রবাজকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সর্বশেষ খবরে বলা হয়েছে, ৬ দিন পর পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। অস্ত্রবাজদের এমনই বান্ধব এই সরকার। 
কিন্তু বিপরীতভাবে দেখা যায়, যদি ছাত্রদল বা শিবিরকর্মীর হাতে এরকম অস্ত্র দেখা যেত, তাহলে হয়তো ইতিমধ্যে তারা পুলিশের ক্রসফায়ারে প্রাণ হারাতো অথবা পুলিশ তাদের হান্ডকাপ পরিয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করতো। বলতো, এদের কাছ থেকে আরও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র পাওয়া গেছে। আর মামলার তো অভাব নেই। যে লাখ লাখ অজ্ঞাত লোকের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে, তার কোনো একটিতে তাদের নিশ্চিতভাবে ফাঁসিয়ে দেয়া হতো। সেটা বলা মোটেও অসঙ্গত হবে না। এছাড়া খুন-ধর্ষণও ছাত্রলীগের অঙ্গের ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের ভেতরে কোনো প্রতিকার প্রতিরোধ চোখে পড়ছে না। 
একটা সময় ছিল, যখন তারুণ্যের প্রতীক ছাত্রসমাজ সমাজের মধ্যে এসব অত্যাচার, অনাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো। তারুণ্য তো রুখে দাঁড়ায়। প্রতিবাদ করে। প্রতিরোধ গড়ে তুলে। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এখন সমাজের ভিতরে তার চিহ্নও নেই। দাঁড়ায় বা দাঁড়াতে পারে না তারুণ্যনির্ভর অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন। দাঁড়ালে ছাত্রলীগ তো আছেই। তারা যেমন অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ করে খুন-জখমে পিছপা হয় না, তেমনি তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয় পুলিশ বাহিনী। 
এই অবস্থা দেশের ভেতরে যে চরম ও করুণ পরিণতি ডেকে আনছে সেটি শাসক দলের গায়ে আঁচড়ও কাটছে বলে মনে হয় না। আর হৃদয় ও বিবেক এদের ভেতরে নেই। সে কারণেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে যে দাঁড়াতে চায়, তাকে নির্মূল করার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। সমাজে যারা বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত তারাও হয় সরকারের তাঁবেদার হিসেবে নিশ্চুপ কিংবা সরকারের রুদ্র-রোষের ভয়ে, অথবা হালুয়া রুটির লোভে। কিন্তু এক দশক আগেও পরিস্থিতি এ রকম ছিল না। মইন-ফকরের সামরিক শাসনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের উপর হামলা হয়েছিল, তাতে ছাত্রসমাজ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে পরিস্থিতি প্রায় সংঘাতে রূপ নিয়েছিল। প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই নয়, কলেজ-স্কুলগুলাতেও উঠেছিল প্রতিবাদ আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত সেই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে ছাত্র সামজের জয় হয়েছিল। অনেক শিক্ষক-অভিভাবক লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। কারাভোগ করেছিলেন। কিন্তু সে আন্দোলন বৃথা যায়নি। তারুণ্য জয়ী হয়েছিল।
আমাদের প্রত্যাশা তো তরুণ সমাজের কাছেই। তারা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়াবেন, এটাই তো কাক্সিক্ষত। কিন্তু ক্রমইে নীতি ও আদর্শের অভাবে সেই কাক্সিক্ষত আশ্রয়ের অভাবে সমাজের ভিতর ধস নামতে শুরু করেছে। এ এক বিপজ্জনক অবস্থা। বিপজ্জনক শুধু বর্তমান সময়ের জন্য নয়। ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্যও আমরা এক নিকষ কালো অন্ধকার যেন রেখে যাচ্ছি। কারণ যে তারুণ্য নির্জীব ও নিস্তেজ, সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত, ন্যায়ের আন্দোলনে নিশ্চুপ, তারাই এক সময় এ দেশের কর্ণধার হবেন। যে এখন বেড়ে উঠছে অসত্য অত্যাচার ও নিপীড়নের ভেতরে, সে কেমন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাবে? সুতরাং আমরা যে যেখানে আছি, আসুন, আলোর শিখা যতোই টিমটিমেই হোক, তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল পরিবেশ গড়ে তুলি।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads