বুধবার, ১৮ মে, ২০১৬

আয়নায় দেখতে চাইলেন রাজনীতির চেহারা


বহুদিন পর আত্মসমালোচনার ভাষায় কথা বললেন তিনি। প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেছেন, রাজনীতি একটি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকতা যত প্রাধান্য পাবে, রাজনীতি তত বেশি জনগণের নাগালের বাইরে চলে যাবে। গত ১৪ মে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে মুদ্রিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, এখনকার রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই। তাই রাজনীতিকদের মানুষ ভালোভাবে নেয় না। আগে রাজনীতি ছিল একটি ত্যাগের নাম। এখন হয়েছে ব্যবসা। আমি রাজনীতিবিদদের বলি, আমরা তো পারলাম না, এবার তরুণদের হাতে রাজনীতি ছেড়ে দাও। তাহলেই রাজনীতি পরিশুদ্ধ হবে। প্রসঙ্গত তিনি আরো বলেন, আমাদের দায়িত্ব মানুষের চলার মসৃণ পথ তৈরি করা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সঙ্গে নেতা নির্বাচন করা, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। মনে রাখতে হবে- এদেশের পোড় খাওয়া মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে না। মুখরোচক স্লোগান নয়, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। বক্তৃতা কমাতে হবে। এত মেঘ কাটিয়ে সূর্য ওঠা অসম্ভব মনে হতে পারে, কিন্তু তা যে হতেই হবে।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সাক্ষাৎকারে তার উপলব্ধির কথা সোজা-সাপটাভাবে প্রকাশ করেছেন। যে কোনো দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষের কাছে তার বক্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হতে পারে। একজন প্রবীণ ও সচেতন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যেন আয়নায় রাজনীতিবিদদের চেহারা দেখতে চেয়েছেন। এবং তার এই দেখা দল কিংবা গোষ্ঠীপূজার নয়, বরং আত্মসমালোচনামূলক। তাই তিনি বলতে পেরেছেন, বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই। আগে রাজনীতি ছিল ত্যাগের বিষয়, আর এখন তা হয়েছে ব্যবসা। এমন বিশ্লেষণের পর তিনি স্পষ্ট করেই রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেছেন, আমরা তো পারলাম না, এবার তরুণদের হাতে রাজনীতি ছেড়ে দিন। তাহলেই রাজনীতি পরিশুদ্ধ হবে।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ পরিশুদ্ধ রাজনীতির কথা বললেন- এমন আকাক্সক্ষা জনগণের আকাক্সক্ষার সাথে মিলে যায়। আর তিনি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সাধারণভাবে যে বিশ্লেষণ করেছেন, তার সাথে দ্বিমত পোষণ না করেও বলা যায়- এখনও দেশে এমন কিছু রাজনীতিবিদ আছেন, যারা শুদ্ধ রাজনীতির প্রতিষ্ঠাই চান। তবে এক্ষেত্রে জরুরি বিষয় হলো- দেশে এমন উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা; যাতে শুদ্ধ রাজনীতির পক্ষের সব মানুষ এই ইস্যুতে এক সাথে কাজ করতে পারেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এখনও তেমন বাতাবরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এর অর্থ আবার এই নয় যে, সবাইকে এক নেতার অধীনে একদলের ব্যানারে কাজ করতে হবে। বৈচিত্র্যের ঐক্য বলেও একটা কথা আছে। রাজনীতিবিদরা যদি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, তাহলে মত ও পথের ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য নিয়েও শুদ্ধ রাজনীতির লক্ষ্যে ঐকচেতনায় কাজ করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রয়োজন হবে- আর তা হলো, নৈতিক মেরুদণ্ড। নৈতিক মেরুদণ্ড বলিষ্ঠ থাকলে লিবারেল-ডেমোক্রেট, সোস্যালিস্ট ও ইসলামিস্টরা দেশ ও জনগণের স্বার্থে পরিশুদ্ধ রাজনীতির বাতাবরণ সৃষ্টিতে সময়ের দাবি পূরণ করতে পারেন। এখন দেখার বিষয় হলো, শুদ্ধ রাজনীতির সমর্থকরা বিবেকের তাড়নায় সময়ের দাবি পূরণে কতটা এগিয়ে আসতে পারেন। জনগণ কিন্তু শুদ্ধ রাজনীতির অপেক্ষায় আছে। অন্ধরাজনীতি ও অন্ধদলবাজির দুর্ভোগে এখন তারা অতিষ্ঠ। এমন রাজনীতি জাহেল যুগের রাজনীতি। তারা এখন স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করতে পারছেন যে, তাত্ত্বিক বিতর্কের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সততা ও জবাবদিহিতার চেতনা। নিজ দলের অসৎ ও অযোগ্য নেতারা বিজয়ী হলেও দল, দেশ ও মানুষের কোনো কল্যাণ হয় না। মুখে সুশাসন ও ন্যায়ের কথা বললেও তারা চলেন উল্টো পথে। ফলে দেশে আতঙ্কের পরিবেশে বসবাস করতে হয় মানুষকে।
রাজধানীর মতিঝিলের ঘরোয়া রেস্টুরেন্টের কর্মচারী রিয়াদ হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে প্রায় ৭ মাস আগে। তবে অভিযুক্ত হোটেল মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেল এখনও গ্রেফতার হয়নি। উদ্ধার হয়নি হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তল ও গাড়ি। এ ব্যাপারে গত ১৪ মে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত সোহেলকে গ্রেফতারের ব্যাপারে পুলিশের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রিয়াদের স্বজনরা। তারা বলছেন, পুলিশকে ম্যানেজ করে সোহেল ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। তবে পুলিশ বলছে, সোহেলকে ধরতে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ৩২ বোরের পিস্তল দিয়ে রিয়াদকে গুলি করা হয়। ওই অস্ত্রের লাইসেন্স সোহেলের ছিল না। হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তল ও পাজেরো গাড়িটি জব্দ করা যায়নি। তবে এজাহারভুক্ত আসামি জসিম ও খবির গ্রেফতার হয়েছে। মূল আসামি সোহেলকে ধরতে অভিযান চলছে। এদিকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি জসিম ও খবির বলেন, মালিক সোহেলের নির্দেশে তারা রিয়াদকে খুঁটির সাথে বেঁধে মারধর করে। একপর্যায়ে সোহেল নিজেও বেধড়ক পেটায়। কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করে সোহেল গুলি চালায় রিয়াদের ওপর। এতে ঘটনাস্থলেই রিয়াদের মৃত্যু ঘটে।
নিজের কর্মচারীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করতে একটুও কাঁপলো না ঘরোয়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের মালিক সোহেলের। এমন নৃশংসভাবে যারা মানুষ হত্যা করে তাদের সমাজে বসবাসের অধিকার থাকতে পারে না। অথচ ৭ মাসেও সোহেল গ্রেফতার হলো না, বিচারেরও সম্মুখীন হলো না। নিহতের স্বজনরা বলছেন, সোহেল টাকার বিনিময়ে মামলা হতে অব্যাহতি পেতে চেষ্টা করছেন, বিভিন্ন জায়গায় ধর্না দিচ্ছেন। গ্রেফতার এড়াতে সংশ্লিষ্টদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে চলেছেন। এমনকি তাকে গ্রেফতার করতে না পারার অজুহাতে মামলার চার্জশিট আটকে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা। এদিকে পুলিশ বলছে, সোহেল গ্রেফতার হলেই এ মামলার চার্জশিট দেয়া হবে। নিহত রিয়াদের স্বজনরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় সোহেলের সম্পৃক্ততা ছিল। তার হোটেলেই হাত বদল হতো অস্ত্র ও মাদকের। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে সোহেলের ভাল যোগাযোগ ছিল। তাই মতিঝিলের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দিনের পর দিন অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যেতে তাকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সোহেলের এখনও যোগাযোগ রয়েছে। এ কারণেই তাকে ধরা হচ্ছে না। তবে ওয়ারী থানার ওসি জেহাদ হোসেন বলেন, সোহেলের অপরাধের সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। প্রভাবশালীদের ম্যানেজের চেষ্টা করলেও সে সফল হবে না। সুষ্ঠুভাবেই মামলার তদন্তের কাজ এগিয়ে চলছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই ভাল ফল আসবে। এদিকে নিহত রিয়াদের ভাই রিপন হোসেন বলেন, সোহেলকে বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। লোকজন তাকে ঠিকই দেখে কিন্তু পুলিশ তাকে খুঁজে পায় না। উল্লেখ্য যে, হত্যাকা-ের ঘটনায় ঘরোয়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট সিলগালা করে দিয়েছে পুলিশ।
আমরা জানি, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনই পুলিশের কর্তব্য। এমন কর্তব্য পালিত হলে তথা আইনের শাসন সমুন্নত থাকলে দুষ্টজনরা সমাজে তাদের দৌরাত্ম্য চালিয়ে যেতে পারে না। বরং আইনের শাসনকে সমীহ করে সমাজে সুনাগরিক হিসেবে তাদের বসবাস করার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে সুশাসন তথা আইনের শাসনের ক্রমাবনতির কারণে দুষ্টজনদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। এ দুর্বৃত্তদের সাহস বাড়ানোর ক্ষেত্রে কখনো অবদান রাখেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কখনো বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন। এর এক উদাহরণ ঘরোয়া রেস্টুরেন্টের মালিক সোহেল। প্রশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তার সাহস এতটাই বেড়ে গেছে যে, সে কোমরে গুঁজে রাখে লাইসেন্সবিহীন পিস্তল এবং সেই পিস্তলের গুলিতে নির্দ্বিধায় হত্যা করে নিজের কর্মচারীকে। এদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশ সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এই ক্ষেত্রে শুদ্ধ রাজনীতির বিষয়টা আরও গুরুত্বপূর্ণ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads