সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও কতিপয় প্রশ্ন


প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও সম্পাদক জনাব মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার সুপারিশ করে সামাজিক মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস প্রকাশ করেন। এই স্ট্যাটাসটি ব্যাপক প্রচারণা পায় এবং তারই তিন দিন পর বর্তমান সংসদের নবম অধিবেশনে গত রোববার অনুষ্ঠিত এক অনির্ধারিত আলোচনায় সরকারদলীয় সদস্য ফজলে নূর তাপসসহ সংসদ সদস্যরা দৈনিক ডেইলি স্টার বন্ধ ও তার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে তার শাস্তি দাবি করেন। এটা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে। মত প্রকাশ ও লিখনীর স্বাধীনতাকে জনাব মাহফুজ আনাম অবাধে ভোগ করেছেন এবং এটা করতে গিয়ে মানুষের অধিকার ও মূল্যবোধে আঘাত দিতেও কার্পণ্য করেননি। মুক্তচিন্তা বিকাশে তার এই অবারিত প্রবণতায় মাঝে মধ্যে আহত হলেও আমি তার সাহসী কলমের নিয়মিত পাঠক এবং এই পাঠক হিসেবে তার পত্রিকা বন্ধ করা ও তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলার যে দাবি তোলা হচ্ছে তার ঘোর বিরোধী।
ওয়ান ইলেভেন কারা এনেছেন, কীভাবে এনেছেন এবং ঐ সরকারকে কারা নিজেদের সরকার বলে দাবি করেছেন এবং তাদের প্রতিটি কাজকে বৈধতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- এটা সকলেরই জানা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে ঐ সরকারেরই অধীনের একজন কর্মকর্তা ডিজি ডিএফআই-এর নির্দেশ মত ডেইলি স্টার যদি কোনও খবর ছাপিয়ে থাকে তা হলে সেই সরকারের ধারাবাহিকতায় গঠিত আরেকটি সরকারের কোপানলে তিনি পড়বেন কেন? ঐ সরকার কি শুধু তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করেছিলেন, আর কাউকে গ্রেফতার করেননি? আর কারুর বিরুদ্ধে মামলা করেননি? শেখ হাসিনা, তার দল আওয়ামী লীগ ও ঐ দলের অংগ সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীসহ মহাজোটের নেতাকর্মীদের মামলা তো সব তারা ক্ষমতায় এসে তুলেই নিলেন এবং অন্য দলের মামলা, শাস্তি বহাল রাখলেন। এই অবস্থায় ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে একটি পত্রিকা বন্ধ করা হলে ও তার সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হলে কি সমস্যার সমাধান হবে? তাতে কি ইনসাফের নীতিমালা লংঘন হবে না?
ওয়ান ইলেভেন সরকারের নির্যাতন ও বিরাজনীতিকরণ প্রচেষ্টা এবং গণবিরোধী কর্মকা- নিয়ে সংসদে এর আগেও আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও সাবেক মন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর ও শেখ ফজলুল করিম তাদের উপর নির্যাতনের ধরন প্রকৃতি এবং মাত্রার একটি করুণ চিত্রও সেখানে তুলে ধরে ওয়ান ইলেভেন সরকারের হোতাদের বিচারের দাবি তুলেছিলেন। সংসদে তাদের দাবির অনুকূলে একটি প্রস্তাবও পাস হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। কেন হয়নি পাঠকরা আন্দাজ করতে পারেন। এখন তাদের বিচার না করে পত্রিকা ও তার সম্পাদকের বিচার করবেন কোন নীতিতে তা উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় অনুকূল ঠাকুর পাবনায় তার মানসিক আশ্রমটি স্থাপন করে ভুল করেছিলেন। এর উপযুক্ত স্থান ছিল রাজধানী ঢাকার আশপাশ অথবা রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদের কারুর কারুর বড় বড় ভবন অথবা আইন প্রণেতাদের পরামর্শ সভার কেন্দ্র বলে পরিচিত কোন কোন ভবন। কারণ এসব জায়গায় সহজে মানসিক রোগী পাওয়া যায়, পাবনায় তা নয়, সেখানে ধরে আনতে হয়।
দেশে এখন অনেক কিছু ঘটছে যা ঘটারা কথা নয়; এমন কিছু দেখতে হচ্ছে যা দেখার কথা নয়।
বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলেরও সাড়ে তিন দশকে যেসব আন্দোলন হয়েছে তার কথা স্মরণ করুন। এই আন্দোলনগুলোর মূল মন্ত্র ছিল গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, ইনসাফ, শোষণের অবসান, বাক ও মতামতের স্বাধীনতার পরিস্ফুরণ এবং স্বাধিকার ও মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের নিরাপত্তা। এর কোনটি এখন আছে? অনেকগুলো প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে জট বেঁধে আছে। আমি ভাবি আসলে এমন কোনও দেশ কি দুনিয়াতে আছে, যা আমাদের দেশে হচ্ছে তা সেখানে হয়?
একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, যার শাখা প্রশাখা বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের প্রত্যেকটি পাড়া মহল্লায় বিস্তৃত, সরকার কোনও রকম ঘোষণা ছাড়াই তার অফিস পাঁচ বছর ধরে বন্ধ করে রেখেছেন। পুলিশ প্রহরা বসিয়েছেন যাতে এই অফিসে কেউ ঢুকতে না পারে, কাজ করতে না পারে। দলটির নেতাকর্মীদের সবাই এদেশের নাগরিক, নিয়মিত খাজনা, ট্যাক্স পরিশোধ করেন। সংবিধান প্রদত্ত রাজনৈতিক অধিকার থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। তারা সভা সমাবেশ করতে পারেন না। দুই চারজন ঘরোয়া সমাবেশে একত্রিত হলেও তাদের গ্রেফতার করে নাশকতার মামলায় জড়ানো হয়। ৫ বছরে দলটি ও তার ছাত্র সংগঠনের ৩৭৫ জন নেতা কর্মীকে পুলিশ মিছিলে গুলী করে হত্যা করেছে। তিনজন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। প্রায় ১,৫০,০০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং প্রায় ৬ লক্ষ লোকের বিরুদ্ধে ২,০১,০০০ মামলা রুজু করে ৯৫,০০০ নেতাকর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে চরমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। পঙ্গু ও আহত করা হয়েছে ৭৫,০০০ লোককে। আজকে যারা একজনের গ্রেফতারের জন্য পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করার দাবি তুলছেন, সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে যারা অত্যাচার করছেন তাদের সম্পর্কে তারা কী বলবেন?
দেশের দু’টি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল দিগন্ত টিভি ও ইসলামী টিভি তিন বছর ধরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হয়নি, সংশ্লিষ্ট মালিক পক্ষ বার বার আবেদন করা সত্ত্বেও চ্যানেল দু’টি খুলে দেয়া হয়নি। কিন্তু কেন? সরকার এর জবাব দিচ্ছেন না। তা হলে জবাব দেবে কে?
দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় দৈনিক ‘আমার দেশ’ তিন বছর ধরে বন্ধ। তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোনও অভিযোগ নেই। দৈনিকটির প্রেস বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছিল তারা যেকোন প্রেস থেকে পত্রিকা বের করতে পারেন। তারা উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ এই উদ্যোগকে ভণ্ডুল করে দেয়। পত্রিকাটির সম্পাদককে ঠুনকো কারণে তিন বছর ধরে জেলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তার অপরাধ কী? তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের স্কাইপি কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। এর দায় স্বীকার করে চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছেন। তা হলে তিনি তো মিথ্যা রিপোর্ট ছাপাননি বরং সত্য রিপোর্ট ছাপিয়ে সরকারের ষড়যন্ত্র জাতিকে অবহিত করে নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন। আজ একজনের বিরুদ্ধে যাচাই বাছাই করে রিপোর্ট না ছাপানোর জন্য পত্রিকা বন্ধ ও সম্পাদকের শাস্তি চাওয়া হচ্ছে। যিনি যাচাই বাছাই করে সত্য রিপোর্ট ছাপলেন তার উপর এই জুলুম কেন? কেন তিনি জেল খাটছেন, রিমান্ডে নির্যাতন ভোগ করেছেন এবং তার পত্রিকা বন্ধ করে রাখা হয়েছে? সরকারের পক্ষ থেকে এর জবাব কী?
দুনিয়ায় এমন দেশ কি আছে যেখানে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মামলা দিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো সভা সমাবেশ, জনমত গঠন ও জনগণের দাবি দাওয়া পূরণের লক্ষ্যে মিটিং মিছিল করতে পারেন না? ঘরোয়া মিটিং এ বসলেও নাশকতার অভিযোগ আনা হয়? আবার তাদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা চলে? গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় কি এমন দেশ আছে যেখানে সংবিধান লংঘন করে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে? সরকার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads