শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

বেগম জিয়ার পর এবার স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ


গত রবিবার এই কলামে রাষ্ট্রদ্রোহ সম্পর্কে লিখেছি। পরের সপ্তাহেও অর্থাৎ আজকেও যে একই বিষয়ে লিখতে হবে সেটা আমার কল্পনাতেও আসেনি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে এমন সব ঘটনা ঘটে যায় যে বাস্তব কল্পনাকেও হার মানায়। গত সপ্তাহে আমরা দেখেছি যে, ২০ দলীয় জোট নেত্রী বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একজন আওয়ামী আইনজীবী রাষ্ট্রদ্রোহ তথা দেশদ্রোহের মামলা করেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা যেহেতু সরকারের অনুমোদন ছাড়া করা যায় না এবং সরকারের অনুমোদন না থাকলে যেহেতু আদালত সেই মামলা আমলে নেয় না তাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা রজু করার অনুমোদন দিয়েছে। মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এই মামলার ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। বিএনপি দেশের দুইটি বৃহত্তম দলের অন্যতম। সুতরাং বোধগম্য কারণেই এই মামলার বিরুদ্ধে সারা দেশে বিরোধী দলের তরফ থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।
সেই ঝড়ের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার পুনরায় দেশের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করার হুমকি এসেছে। এবার হুমকি দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ছেলে এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছেন তিনি হলেন ‘ডেইলি স্টারের’ অন্যতম মালিক ও সম্পাদক মাহফুজ আনাম। মাহফুজ আনামের আরেকটি পরিচয় রয়েছে। তার পিতা মরহুম আবুল মনসুর আহমদ। আবুল মনসুর আহমদ মরহুম হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক অনুসারী ছিলেন এবং অবিভক্ত পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। জনাব সোহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন সেই মন্ত্রিসভায় আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন শিল্প মন্ত্রী। গতকাল শনিবার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগের খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি নিম্নরূপ:
সামরিক অভ্যুত্থানে উস্কানি দিতে সাজানো ও মিথ্যা প্রচারণা চালানোর জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের গ্রেফতার ও বিচার চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। এটিএন নিউজের এক অনুষ্ঠানে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের সময় ডেইলি স্টারে ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা খবর ছাপার কথা স্বীকার করার পর বৃহস্পতিবার রাত ২টা ১৯ মিনিটে নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে মাহফুজ আনামের গ্রেফতারের দাবি জানান জয়।
জয় লিখেছেন, ‘মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক, স্বীকার করেছেন যে তিনি আমার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অপবাদ আরোপ করতেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নীতির গল্প ছাপিয়েছিলেন। তিনি সামরিক স্বৈরশাসনের সমর্থনে আমার মাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে এই কাজ করেছিলেন।’
‘একটি প্রধান সংবাদপত্রের সম্পাদক সামরিক বিদ্রোহে উস্কানি দিতে যে মিথ্যা সাজানো প্রচারণা চালায় তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা।’
ইংরেজি দৈনিকটির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বুধবার রাতে এটিএন নিউজে এক অনুষ্ঠানে প্রশ্নের মুখে সম্পাদক মাহফুজ আনাম স্বীকার করেন যে, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর’ যাচাই ছাড়া প্রকাশ করে সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তিনি করেছেন।
ডেইলি স্টারের সম্পাদক বলেন, ‘এটা আমার সাংবাদিকতার জীবনে, সম্পাদক হিসেবে ভুল, এটা একটা বিরাট ভুল। সেটা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি।’
অনুষ্ঠানে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ডেইলি স্টারের বিতর্কিত ভূমিকার প্রসঙ্গ শুরুতেই সঞ্চালক তুললে তা অস্বীকার করেন মাহফুজ আনাম।
পরে আরেক আলোচক গাজী নাসিরউদ্দিন আহমেদ উদাহরণ তুলে ধরলে মাহফুজ আনাম ভুল স্বীকার করেন।
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মত, তার মিথ্যা গল্পের উস্কানি আমার মাকে গ্রেফতার করিয়েছে এবং তিনি ১১ মাস জেলে কাটিয়েছেন। আমি বিচার চাই। আমি চাই মাহফুজ আনাম আটক হোক এবং তার রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার হোক।’
সম্পাদক ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে মাহফুজ আনামের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শেখ হাসিনার তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
‘তিনি (মাহফুজ আনাম) অব্যাহতভাবে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে তাদের অনৈতিকতা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হবার কথা লেখেন। তার নিজের স্বীকারোক্তি মতে তিনি নিজেই পুরোপুরি অনৈতিক এবং একজন মিথ্যাবাদী।’
‘তার অবশ্যই একজন সাংবাদিক হিসেবে থাকার কোনো অধিকার নাই, সম্পাদক তো অনেক দূরের বিষয়। তার কার্যক্রম দুর্নীতিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে, যা দেশপ্রেমহীন এবং বাংলাদেশ বিরোধী।’
২০০৭ সালে সাবেক সেনাপ্রধান মঈন উদ্দিন আহমেদের হস্তক্ষেপে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রিত ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে, যাকে অনেকে ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিন সরকার বলে থাকেন, ডেইলি স্টার এবং একই মালিকানায় প্রকাশিত প্রথম আলোর ‘সমর্থন’ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।
পরোক্ষ সেনাশাসন জারির আগে সিপিডির উদ্যোগে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সহযোগিতায় দেশজুড়ে নাগরিক সংলাপে ‘বিরাজনীতিকরণের’ প্রচার চালিয়ে অসাংবিধানিক সরকারের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল বলে সমালোচকরা বলে থাকেন।
দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করতে ওই সময় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তাদের চরিত্র হননের চেষ্টা চালানো হয়েছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।
তবে সে সময় আওয়ামী লীগ প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে তেমন সরব না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি দৈনিকের সাথে বর্তমান সরকারের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন।
॥ দুই ॥
মাহফুজ আনাম তথা দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ সজীব ওয়াজেদ জয় এবারই প্রথম করলেন না। এর প্রায় দুই বছর আগে ২০১৪ সালের ২৬ মে সজীব ওয়াজেদ জয় দেশের ৩ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মতন গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেন। এরা হলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদ, বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান রচয়িতা এবং দেশের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ডাকসুর দুই মেয়াদে ভিপি নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড সৃষ্টিকারী ছাত্র নেতা, তোফায়েল আহমেদের পর যিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র নেতা, আওয়ামী লীগের সেই সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং ডেইলি স্টারের অন্যতম মালিক ও সম্পাদক মাহফুজ আনাম। সেদিনও নিজস্ব ফেসবুক স্ট্যাটাসে সজীব ওয়াজেদ জয় এই ৩ বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাদেরকে গ্রেফতারের দাবি করেছিলেন। মি. জয় এই অভিযোগটি উত্থাপন করেন ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তার ৩ দিন আগেই ২৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩ টায় মাহমুদুর রহমান মান্নাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
তারপর ১ বছর হয়ে গেছে। ড. কামাল হোসেন ও মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ১ বছর পর গত শুক্রবার ৫ ফেব্রুয়ারি মি. জয় মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে পুনরায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনলেন এবং গ্রেফতারের দাবি জানালেন। ঐ দিকে জনাব মান্নার কারাবাসের প্রায় ১ বছর পার হতে চলল। এই ১ বছরেও তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের তো দূরের কথা, সরকার তার বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো অভিযোগও উত্থাপন করতে পারেনি।
॥ তিন ॥
এবার স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে মি.জয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার যে অভিযোগ এনেছেন তার ভিত্তি হলো মাহফুজ আনামের একটি সহজ সরল স্বীকারোক্তি। গত ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা বিডি নিউজ ২৪.কম একটি সংবাদ পরিবেশন করে। আগের রাত অর্থাৎ ৩ ফেব্রুয়ারি বুধবার এটিএন নিউজের এক টকশোতে স্টার এডিটর একটি স্বীকারোক্তি দেন। বিডি নিউজের রিপোর্ট মোতাবেক স্টার সম্পাদক বলেন যে, ২০০৭/২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সংবলিত সংবাদটি প্রকাশ করা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। তিনি বলেন যে, ঐ সংবাদটি পরিবেশন করেছিল সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডি জি এফ আই। তিনি বলেন, ডি জি এফ আই পরিবেশিত সংবাদটি যাচাই বাছাই না করে ছাপানোটা আমার সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আমি এই ভুল স্বীকার করছি।
॥ চার ॥
এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অনুরূপ সংবাদ ঐ সময় ডেইলি স্টার বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কেও ছাপিয়েছিল এবং সেই সংবাদও পরিবেশন করেছিল ডি জি এফ আই। কিন্তু বিডি নিউজ ২৪.কম শুধুমাত্র শেখ হাসিনার কথা টকশোতে উল্লেখ করে। বার্তা সংস্থাটি সাংবাদিকতার নীতিমালার বড়াই করে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্পর্কে মাহফুজ আনামকে প্রশ্ন করে। কিন্তু খালেদা জিয়া সম্পর্কে নীরব থাকে। এটিই বা কোন ধরনের বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা সেটি বিডি নিউজই বলতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ মে ফেসবুকে আরেকটি স্ট্যাটাসে সজীব ওয়াজেদ জয় প্রথম আলোকে বর্জনের ডাক দেন।
ডেইলি স্টার অথবা প্রথম আলোর সাথে নীতির প্রশ্নে আমাদের অনেক মত ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ডেইলি স্টার বা প্রথম আলোসহ সমস্ত গণমাধ্যমের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি। জনাব মাহফুজ আনাম ভুল স্বীকার করে একটি বিরল ও মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তার এই কাজ আমাদের সকলের প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। অথচ প্রশংসা না পেয়ে তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এবং সেই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করারও দাবি জানিয়েছেন সজীব ওয়াজেদ। কথায় কথায় যদি দেশদ্রোহিতার অভিযোগ করা হয় এবং সেই সব অভিযোগের সপক্ষে যদি কোনো প্রমাণ বা গ্রহণযোগ্য যুক্তি তর্ক না থাকে তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহের মত একটি গুরুতর অভিযোগও শিক্ষিত সচেতন মানুষের কাছে হালকা হয়ে যায়।
সজীব ওয়াজেদ জয়সহ আওয়ামী নেতারা যদি এই সহজ সরল সত্যটুকু বুঝে থাকেন তাহলে সেটি দেশের জন্য মঙ্গল এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্যও মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads