রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

বাংলাদেশ কোনওভাবেই সাম্প্রদায়িক নয়


এক শ্রেণীর মিডিয়া, ভাষ্যকার, কলামিস্ট এবং পলিটিশিয়ানের লেখা এবং বক্তব্য পড়লে এবং শুনলে মনে হবে যে, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গিবাদ ছাড়া আর যেন কোনো সমস্যা নাই। জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীর শরীর এবং চোখই শুধু হলুদ হয় না, কথায় আছে যে (সত্য হোক আর নাই হোক) জন্ডিসে আক্রান্ত ব্যক্তি নাকি সবকিছুই হলুদ দেখে। আমাদের এসব মিডিয়া এবং পলিটিশিয়ানেরও যেন জন্ডিস হয়েছে। তবে এই জন্ডিসের নাম জঙ্গিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা। ওরা আল্লাহর জমিনে যতকিছু আছে সবগুলির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পায়। একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের শিল্প ও সাহিত্য পৃষ্ঠায় সেদিন বাউল গায়ক শাহ্ আব্দুল করিমের জীবনী পড়ছিলাম। সেখানে দেখলাম, সেই সাম্প্রদায়িকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার কচকচানি। যখন লালন গীতি শুনি তখন সেখানেও উপস্থাপক সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে লেকচার মারেন। শুধু এরা কেন, আজকাল দেখছি, জাতীয় কবি নজরুলের গান উপস্থাপন করতে গেলেও দেখা যায় একই চেহারা। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন এটা বোঝাতে যে, নজরুল আপাদ মস্তক ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। যেসব কথা ওরা বলেন, আর নজরুলের যেসব গান ওরা পরিবেশন করেন সেসব শুনলে মনে হবে যে, নজরুল সাহিত্যে এই অসাম্প্রদায়িকতা ছাড়া আর কোনো বিষয় নাই। নজরুলের কতগুলো অমর গান আছে। সেগুলোর মধ্যে একটা হলো, ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত’। আর একটা গান হলো, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। আর একটি হলো, ‘আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত’। এখন এসব গান তেমন একটা গাওয়া হয় না। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় নজরুলের বিপ্লবী গান ব্যবহার করা হয়েছে জনাব নুরুল আমীনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। নজরুলের এসব গান গেয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ভোট চাওয়া হয়েছে। জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিএনপি এবং এরশাদের রাজত্বের বিরুদ্ধে নজরুলের বিপ্লবী গান বিশেষ করে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ এবং ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত’ গাওয়া হতো জিয়া খালেদা ও এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে।
আজ এই ৩ জনের কেউই ক্ষমতায় নেই। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। বিগত ৭ বছর থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এখন আর নজরুলের ঐসব বিপ্লবী গান রেডিও টেলিভিশন বা বিচিত্রানুষ্ঠানে গাওয়া হয় না। অথচ জিয়াউর রহমান খালেদা জিয়া এবং এরশাদ সরকারের তুলনায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি রাজবন্দী আছে। কারাগারের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ৪ গুণ বেশি বন্দী কারাগারে আছে। তারপরেও নজরুলের ঐসব বিপ্লবী গান গাওয়া হয় না। আওয়ামী লীগ জাতীয় কবি নজরুলকেও দলীয়করণ করেছে। তারা নজরুলকে এমনভাবে উপস্থাপন অতীতে করেছে এবং এখনো করছে যেন মনে হয় নজরুল ছিলেন আইয়ুব বিরোধী, নুরুল আমীন বিরোধী, খালেদা জিয়া রিরোধী, এরশাদ বিরোধী এবং জিয়াউর রহমান বিরোধী। তিনি হলেন হাসিনা পন্থী। তাই বর্তমান আমলে নজরুলকে চিত্রিত করা হয় শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী হিসেবে।
নজরুল তো জাতীয় কবি। তার তুলনা তিনি শুধু নিজেই। শাহ্ আব্দুল করিমকে নিয়েও ঐ একই খেলা খেলা হচ্ছে। একটু আগে মৌলবাদ বিরোধী এবং অসাম্প্রদায়িকতার দাবিদার বাংলা দৈনিকটি লিখেছে যে, বঙ্গ ভঙ্গ ছিল সাম্প্রদায়িকতার থিসিস। আর অখ- বাংলা ছিল সাম্প্রদায়িকতার এ্যান্টি থিসিস। অসাম্প্রদায়িকতার বিচার করতে গিয়ে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন লালন ফকির, শাহ্ আব্দুল করিম, রাধা রমন, উকিল মুন্সি, আব্দুল কুদ্দুছ বয়াতি প্রমুখ বাউল গায়ককে। আজ আমার জন্য এই লেখাটির কোনো প্রয়োজন ছিল না, যদি খ-িত বঙ্গকে সাম্প্রদায়িক এবং অখ- বাংলাকে অসাম্প্রদায়িক বলে দেখানোর চেষ্টা না হতো। ঠিক এই জায়গাতেই আমার প্রশ্ন, যদি ওদের ভাষায় খণ্ডিত বাংলা সাম্প্রদায়িক হয় তাহলে বাংলাদেশকে কোন পর্যায়ে ঠেলে দেয়া হয়?
॥দুই॥
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদেরকে আরো একটি অপপ্রচারের জবাব দিতে হবে। সেটি হলো, আজকের বাংলাদেশ নাকি লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। এই কথাটি বলেছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী লে: কমান্ডার মরহুম মোয়াজ্জেম হোসেন, শেরে বাংলার পুত্র মরহুম এ কে ফয়জুল হক এবং আ স ম আব্দুর রব। নিরপেক্ষভাবে বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য আসুন, আমরা একটু পেছনে যাই।
এ কথা সকলেই জানেন যে, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এই প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে অভিহিত হয়। প্রস্তাবের সংক্ষিপ্তসার এদেশের সব মানুষই জানেন। ঐ প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে, ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যেসব এলাকায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব এলাকায় অর্থাৎ এই দু’টি অঞ্চলে দু’টি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। লাহোর প্রস্তাবে এই নতুন দু’টি রাষ্ট্রের কোনো সুনির্দিষ্ট সীমানা উল্লেখ করা হয়নি। তবে প্রস্তাবের স্পিরিট দেখে ধারণা করা হয়েছিল যে, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, অবিভক্ত পাঞ্জাব এবং কাশ্মীর নিয়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। আবার এই দিকে বর্তমান বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গ এবং তদানীন্তন আসাম ও বিহারের অংশবিশেষ নিয়ে পূর্বাঞ্চলে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
এখন শুরু করছি কমান্ডার মোয়াজ্জেমের কথা দিয়ে। যারা প্রবীণ তারা হয়তো জানেন যে, আগরতলা মামলা বাঞ্চাল হওয়ার পর কমান্ডার মোয়াজ্জেম জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। বেরিয়ে আসার পর তিনি লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি নামে একটি সংগঠন করেছিলেন। ঢাকায় এই সংগঠনের উদ্যোগে কয়েকটি স ভাও করা হয়েছিল। সেই সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে পাকিস্তান আর্মী তাকে গুলী করে হত্যা করে।
মৃত ব্যক্তির কোনো উক্তি নিয়ে কোনো কথা বলা ঠিক নয়। কারণ মৃত বলে সে ব্যক্তি প্রতিবাদ করার ক্ষমতা রাখেন না। কথার পাল্টা কোনো কথা বলতে পারেন না। তবে তার যাঁরা ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তাদের কারো করো সাথে মিলে আমি কমান্ডার মোয়াজ্জেমের সাথে কথা বলেছিলাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম যে, লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন বলতে তারা কি বোঝাতে চান। কমান্ডার মোয়াজ্জেমের সুচিন্তিত উত্তর ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশের) স্বাধীনতা অর্জন। আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল যে, লাহোর প্রস্তাব তো ছিল শুধুমাত্র এই খণ্ডিত বাংলার স্বাধীনতাই নয়; বরং সমগ্র বাংলা এবং আসাম ও বিহারের একটি অংশ নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই কমান্ডার মোয়াজ্জেম মারা গেছেন। বাংলাদেশের মুখ তিনি দেখে যেতে পারেননি। বাংলাদেশ হওয়ার পরেও তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে লাহোর প্রস্তাবের অবশিষ্টাংশ তিনি কিভাবে বাস্তবায়িত করবেন সেটি হয়তো দেখা যেত।
॥তিন॥
আসছি ফয়জুল হক ও আ স ম আব্দুর রবের কথায়। ফয়জুল হক ছিলেন, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা মরহুম এ কে ফজলুল হকের পুত্র। তিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রী সভায় একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি সম্ভবত কখনো আওয়ামী লীগ করেননি। তিনি ১৯৯৬ সালের ইলেকশনের আগে আওয়ামী লীগে জয়েন করেন এবং আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের সমর্থক হওয়ার কারণে তিনি কারাবরণ করেন। জনাব ফায়জুল হক যেহেতু শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের পুত্র তাই লাহোর প্রস্তাব এবং পরবর্তীতে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হওয়া সম্পর্কিত কাগজপত্র তার কাছে থাকতেও পারে। ঐসব কাগজপত্র ঘাঁটলে তিনি দেখতে পেতেন যে, খণ্ডিত বাংলা অর্থাৎ যেটা আজকের বাংলাদেশ সেটা লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের একটি অংশ মাত্র। বৃহত্তর অংশ বাস্তবায়নে এখনও অনেক বাকি।
॥চার॥
জনাব আসম আব্দুর রব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। তার রাজনীতিতে কোন রাখ ঢাক ছিল না। তৎকালীন ছাত্র লীগের একটি অংশ অনেক দিন থেকেই অর্থাৎ পাকিস্তান আমল থেকেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। এদের নেতা ছিলেন জনাব সিরাজুল আলম খান। সিরাজুল আলম খানের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন জনাব রব, শাহজাহান সিরাজ, মোহাম্মদ শাহজাহান, হাসানুল হক ইনু, কর্নেল তাহের, শরীফ নূরুল আম্বীয়া, কাজী আরিফ আহমেদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ ফ ম মাহবুবুল হক প্রমুখ। আরো অনেকে ছিলেন যাদের নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। জনাব সিরাজুল আলম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসমেট ছিলেন। অবশ্য আমাদের সাবজেক্ট ছিল আলাদা। যাই হোক, সিরাজুল আলম খান এবং তার অনুসারীদের নিকট থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে আমি জানতে চেয়েছিলাম এবং পরেও জানতে চেষ্টা করেছি যে, তারা আসলে কি চান। শুধু আমি নই, অনেককেই ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তারা এর সীমানা বাড়াবেন।
তারপর থেকে অনেক বছর গড়িয়ে গেলো। পদ্মা এবং গঙ্গা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। কোথায় গেল সেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র? আর কোথায় গেলো সেই বৃহত্তর বাংলা?
কথায় কথায় যারা সাম্প্রদায়িকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার সবক দেন তারা জানেন না যে, তারা কি বলছেন? সাবেক পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তারা সব সময় সাম্প্রদায়িক বলে এসেছেন। কারণ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হয়ে পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলা গঠিত হয়েছিল। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভক্ত পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) যদি সাম্প্রদায়িক হয় তাহলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভক্ত পশ্চিম বাংলাও সাম্প্রদায়িক হয়। আর পূর্ব বাংলা সাম্প্রদায়িক হলে বাংলাদেশের অবস্থা কি দাঁড়ায়? কারণ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটে সেটি তত্ব ও ভৌগলিকভাবে আগের ধারাবাহিকতা। কিন্তু আমরা জানি এবং দৃঢ়তার সাথে বলছি যে, বাংলাদেশ মোটেই সাম্প্রদায়িক নয়। এটি অতীতেও অসাম্প্রদায়িক ছিল এবং এখনো আছে।
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads