মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০১৫

গ্রিক বাহাদুরের ঠাটা ঢেঁকি


গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাসের কথা শুনে, হুমকি-ধামকি দেখে মনে হচ্ছিল যে, তার কাছে বুঝি বিরাট কোনো জাদুর কাঠি আছে, যা দিয়ে তিনি গোটা ইউরোপকে একেবারে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিতে পারেন। বলতে পারেন যে, তোমাদের আমরা থোড়াই পরোয়া করি। আমরা আমাদের মতো করে নিজেরাই চলতে পারি। তোমাদের ঋণ-ফিনের আমরা তোয়াক্কা করি না। যেমন ক’দিন আগে আমাদের আত্মমর্যাদাবতী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর গলায় বলেছেন যে, আমরা ভিক্ষা নেই না, ঋণ নেই এবং নিয়মিত পরিশোধ করি। অতএব কারও ডিকটেশন শুনতে চাই না। একেবারে খাঁটি কথা। কিন্তু খাঁটি কথার সব সময় ভাত মেলে না। ঋণের জন্য ঋণদাতাদের হাতেপায়ে ধরতে হয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে।
গ্রিসের কট্টর বামপন্থী প্রধানমন্ত্রী সেদেশের নাগরিকদের মধ্যে এক ঘোর তৈরি করে এ বছরের জানুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগষ্ঠিতা তিনি পাননি। তাই সরকার গঠনের জন্য তাকে কোয়ালিশন করতে হয়েছে চরম দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে। অর্থাৎ চরম এক গোঁজামিলের মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু করেন সিপ্রাস। কিন্তু তার আগেই গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গ্রিসের অর্থনীতিতে অধিকতর ধস নামতে শুরু করেছিল। সরকারগুলো ক্ষমতায় আসীন থাকার জন্য গ্রিকদের সেটা বুঝতে দিতে চাননি। আর পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কেবলই ইউরোপীয় কমিশন, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (তিন মিলে ট্রয়কা) থেকে অবিরাম ঋণ নিয়ে গেছে। ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেনি। ফলে এখন দেউলিয়া হবার মুখে পড়েছে গ্রিস। পুরানা ঋণের কিস্তি শোধ করা তো দূরের কথা, এখন গ্রিক সরকার ঐ ট্রয়কার কাছে নতুন করে আরও ঋণ চাইছে।
পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আপনি আপনার কোনো বন্ধুর কাছ থেকে গত বছর ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন, ফেরত দেননি। আপনি তার আগের বছরও একই বন্ধুর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন, ফেরত দেননি। এ বছর আরও ৫০ হাজার টাকা ঋণ চাইছেন। কেউ কি এ ধরনের ঋণ কখনও কাউকে দেয়? অতএব পেলেন না। এতে রাগে ক্ষোভে আপনি ফেটে পড়লেন। অথচ পুরো ইউরোপকে এক ধরনের ব্ল্যাক মেইল করে গ্রিক সরকার সে ঋণই আদায় করে নিতে চাইছে। কিন্তু তৃতীয় বছরে এসে একবারে বেঁকে বসেছে এ ট্রয়কা। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিকরা গ্রিসবাসী তথা পৃথিবীর মানুষদের নিষেধ করে গিয়েছিলেন, গ্রিকরা সে নিষেধ অমান্য করে ধার করে ঘি খেতে শুরু করেছেন প্রায় এক যুগ বা তারও আগে থেকে। এখন তাদের বিপদ ভারী হলো।
এখন গ্রিস দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। একসময় ইউরোপীয় দেশ হিসেবে গ্রিস ট্রয়কার যে সমর্থন পেয়েছিল, এখন তা প্রায় বাস্পীভূত হয়ে যেতে বসেছে। কীভাবে পরিশোধ করা হবে-সেটা চিন্তা না করেই তারা ভেবেছিল, ঋণ শোধের ক্ষেত্রে তারা ইইউ-এর শর্ত কিছুতেই মানবে না। এদিকে গ্রিস আবার ইউরোপীয় অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থার অংশীদার। ফলে সে দেশে স্থানীয় মুদ্রার চেয়ে ইউরোর কদর বেশি। গোটা অর্থব্যবস্থা এখন ইউরো-নির্ভর। ব্যাংকগুলো চলে ইউরোতে। কিন্তু আইএমএফের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্রিসকে নতুন করে ঋণ দিতে অস্বীকার করে। এতে সঙ্কট এমন দাঁড়ায় যে, গ্রিসের গোটা ব্যাংক ব্যবস্থাই ধসে পড়ে। ব্যাংকগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছে। এসময় শুধু খোলা ছিল ব্যাংকের এটিএম বুথগুলো। আর সেসব বুথ থেকে কোনো গ্রাহক সর্বোচ্চ ৬০ ইউরোর বেশি তুলতে পারছিলেন না। সে এক ভয়াবহ দুঃসময়। ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোতে পণ্য সরবরাহ সীমিত হয়ে আসছিল। মানুষের মধ্যে বেড়ে যাচ্ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুতের প্রবণতা। দাম বাড়ছিল ভোগ্যপণ্যের।
গ্রিসকে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঐ ট্রয়কা তিন দফা সুপারিশ করেছিল। তার মধ্যে ছিল পেনশন কমানো, সোশাল সিকিউরিটি সহায়তা ও বেকারভাতা হ্রাস আর কিছু কৃচ্ছ্রতার পথ বেছে নেওয়া। তাদের যুক্তি ছিল যে, এসব প্রস্তাব মেনে এর আগে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশ একই ধরনের সঙ্কট থেকে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য আলেক্সিস সিপ্রাস এসব সংস্কার কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে ইইউ’র প্রস্তাব গণভোটে দেন। এটা ছিল সিপ্রাসের সস্তা স্টান্টবাজি। তিনি বলতে চাইলেন যে, গ্রিসবাসী কোনো চাপিয়ে দেওয়া শর্তটর্ত মানতে প্রস্তুত নয়। তা হলে এতোদিন যে ধার করে ঘি খেলেন, সে ঘিয়ের পয়সা শোধ হবে কীভাবে? কিন্তু সিপ্রাস দারুণ এক জিগির তুলে দিয়ে আইএমএফের শর্তের বিরুদ্ধে জনগণের ভোট আদায় করে নিলেন। প্রায় ৫০ শতাংশ লোক ঐ গণভোটে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ আইএমএফের সংস্কার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
তবে কি তারা ধার করা অর্থ ফেরত দিতে চান না? জনগণ সেভাবে ভাববার অবকাশই পাননি। সরকার টাকা ধার করেছে কিনা, সাধারণ মানুষ তার কি জানে। কিন্তু তারা কোনো সুযোগ-সুবিধা ছাড়তে রাজি না। এই ধার যে সরকার নিজের জন্য করেননি, তাও জনগণকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে সিপ্রাসের সরকার। আর এই উদ্যোগে সিপ্রাসের সবচেয়ে কট্টর সমর্থক ছিলেন তার অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, গণভোটে জয়লাভের পর ঐ অর্থমন্ত্রী নিজে অতি দ্রুত পদত্যাগ করে দৃশ্যপট থেকে সরে যান। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস হয়তো ভেবেছিলেন যে, ইউরোপীয় নানা ইকুয়েশনে শেষ পর্যন্ত ঋণ শোধ না করলেও, ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও ইইউ তাদের আবারও ঋণ দেবে। কিন্তু বেঁকে বসেছিল জার্মানী আর ফ্রান্স। তারা বলল, এই ঋণে কোনো ছাড় নয়। কারণ যে অর্থ তারা ঋণ হিসেবে দেবেন, তা তাদের জনগণের ঘামঝরানো ট্যাক্সের পয়সা। এটা তারা পানিতে ঢালতে পারেন না। অতএব কিস্তি পরিশোধ না করলে আর কোনো নতুন ঋণ নয়।
আইএমএফকে ‘না’ বলে গ্রিকবাসীর সে কি উল্লাস! কিন্তু তারা হয়তো ভাবেনইনি যে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের এই উল্লাসের অবসান ঘটবে। কারণ গত ২০ জুনের মধ্যেই তাদের ইইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে হতো ৭০০ কোটি ইউরো। আর আগস্টের মাঝামাঝি তাদের সর্বমোট পরিশোধ করতে হবে ১২ শ’ কোটি ইউরো। এ ছাড়াও ইউরো জোনের দেশসমূহ ও আইএমএফকে তাদের অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে ২৪ হাজার কোটি করে ইউরো। ফলে গ্রিসের জন্য এখন ত্রাহি অবস্থা। এদিকে আবার চলমান পরিস্থিতিতে গ্রিসের বেকারত্ব দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশেরও ওপরে। এই বেকারদেরও আবার দিতে হচ্ছে বেকার ভাতা।
ফলে ঋণভারে জর্জরিত গ্রিস। তারা জানে না কীভাবে এই ঋণ শোধ করা হবে। আবার তারা ঋণদাতাদের পরামর্শ শুনতেও নারাজ। এ রকম একটি দেশকে কে ফের ঋণ দিতে যাবে? সঙ্কট হয়েছে সেখানেই। তাছাড়া গ্রিসে রয়েছে সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি, ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় গ্রিকদের উৎপাদনশীলতাও অনেক কম। স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতি লাগামছাড়া। প্রতিযোগিতমূলক অর্থনৈতিক সংস্কারে তাদের আছে ব্যাপক অনীহা। তাছাড়া তারা আয় বুঝে ব্যয় করতেও জানে না, যা যেকোনো ভদ্র দেশ করে থাকে। গ্রিসের কর্মক্ষম লোকেরা কাজ করে খাওয়ার চেয়ে বেকারভাতা খাওয়াই অনেক বেশি পছন্দ করে। আর সরকারের মনোভাবও যেন অনেকটা সেরকমই। ঋণ নেব বেকার ভাতার মতো, যা কোনোদিন শোধ করতে হবে না। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে, তেমন ঋণ দেওয়ার দেশ বা প্রতিষ্ঠান দুনিয়ার কোথায়ও নেই।
তবে অলস হলেও গ্রিকদের গণতন্ত্রপ্রীতি দারুণ। তারা ইইউ’র নির্দেশকে ‘মানি না’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হোক, গ্রিসের দার্শনিকরাই তো পৃথিবীকে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছে ও সভ্যতা শিখিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের ব্যাপক চর্চা প্রীতির প্রতি সমর্থন তাদের ঋণ থেকে মুক্তি দিতে মোটেও সহায়ক হতে পারেনি। এদিকে গত ১৩ জুলাই ইউরো জোন নেতারা এক বৈঠকে বসে গ্রিসকে চূড়ান্তভাবে হুশিয়ার করে দিয়েছেন যে, পরবর্তী যে কোনো আলোচনায় বসার আগে এবং ইউরো মুদ্রাভুক্ত থাকতে হলে গ্রিসকে সুনির্দিষ্টভাবে কতকগুলো পদক্ষেপ নিতেই হবে।
এরপর প্রায় ১৭ ঘণ্টা আলোচনার পর গ্রিসের বাকোয়াজ প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন শর্তে একেবারে নাকে খত দিয়ে আরও তেতো ওষুধ খেতে বাধ্য হয়েছেন। এ যাত্রা রয়ে গেছেন ইইউতে ও ইউরো জোনে। পেনশন কমবে, বেকারভাতা কমবে, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে, দুর্নীতিবাজদের তোয়াজ করা বন্ধ করতে হবে, কর আয় বাড়াতে হবে। স্বজনপ্রীতি চলবে না। এসব পাপ এখন গ্রিক সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হয়ে গেছে। দেখা যাক, সিপ্রাসের পরবর্তী নাটক কী হয়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads