বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০১৫

অনিবার্য হয়ে উঠছে মধ্যবর্তী নির্বাচন?

তিন মাসব্যাপী বিরোধীদলীয় আন্দোলনের একধরনের ব্যর্থতা এবং তিন সিটি করপোরেশনে ভোট ডাকাতির নির্বাচনের পর দেশের মানুষের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তনের ব্যাপারে হতাশা নামে। এরপর অনেকটা আকস্মিকভাবে আগামী বছর মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন কূটনৈতিক মহল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের এমন ধারণা দেয়া হচ্ছে যে, নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তনের সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ যে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে সেটি ক্রমেই প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। এত দিন এ চাপ ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের প্রভাবশালী কূটনৈতিক অংশীদার দেশ চীনও। এমনকি প্রতিবেশী ভারতও বিশ্বব্যাপী বৈধতার ব্যাপারে প্রশ্নবিদ্ধ একটি সরকার তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে, নাকি এটি শেষ পর্যন্ত দায় হয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু করেছে।
একতরফা ভারত নির্ভরতায় চীনের বোধোদয়?
বাংলাদেশের প্রভাবশালী কূটনৈতিক অংশীদার চীনের সাথে বর্তমান সরকার বেশ কৌশলী সম্পর্ক রক্ষা করে আসছিল। শুরু থেকেই বাংলাদেশে চীনের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে পুরোপুরি আশ্বস্ত করে আসছিল সরকার। এ ব্যাপারে চীনা আস্থা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি গড়তে দেবে মর্মে গোপন চুক্তির ভুয়া দলিল করে তাদের সরবরাহ করা হয়। এসব প্রচেষ্টার ফলে চীন একপর্যায়ে বিএনপির ওপর আস্থা একেবারেই হারিয়ে বসে। তারা মনে করতে থাকে, আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন যোগালে শেষ পর্যন্ত তাদের মাধ্যমে স্বার্থ রক্ষিত হবে। সরকার চীনকে বিভিন্ন প্রকল্প দেয়ার ব্যাপারেও নানাভাবে আস্বস্ত করে রাখে।
শেখ হাসিনার চীন সফরের আগে তাদের ধারণা দেয়া হয় যে, প্রধানমন্ত্রী বেইজিং থাকতেই সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা চীনের সাথে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পরিবর্তে ভারতীয় কোম্পানিসহ কনসোর্টিয়াম করে বন্দর নির্মাণ ও পরিচালনার প্রস্তাব দেয়। এতে তারা প্রথম ধাক্কা খায়। কিন্তু এই প্রকল্প যে শেষ পর্যন্ত চীনকে দেয়া হবে না, এ রকম কোনো ধারণা তাদের দেয়া হয়নি। সর্বশেষ গভীর সমুদ্রবন্দরের স্থান সোনাদিয়ার পরিবর্তে পায়রা নিয়ে আসার পর চীন যে বন্দর নির্মাণের ব্যাপারে আর অগ্রাধিকার তালিকার মধ্যেই থাকছে না, তা স্পষ্ট হতে থাকে। 
২০১১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় নয়াদিল্লি চেয়েছিল চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে কমপক্ষে ১০টি রুটে সমন্বিত ট্রানজিট পাওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর হোক। শেষ পর্যন্ত চীনের নেপথ্য চাপের কারণে ঢাকা ভারতের সাথে ট্রানজিট বাস্তবায়নের চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়ার অজুহাত দেখানো হয় তখন। এ বিষয়টাকে মনমোহন সরকার ভালোভাবে না নেয়ার কারণে সীমান্তচুক্তি সংসদে অনুমোদন করানোর ব্যাপারে কিছুটা বিলম্বিত করার কৌশল নেয়া হয়। 
এর মধ্যে ৫ জানুযারির একতরফা নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতার সঙ্কটে পড়ে শেখ হাসিনার সরকার। এর কয়েক মাস পর ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে। বিরোধী দলে থাকাকালে ভারতের বিজেপির সাথে আওয়ামী লীগ সব সময় দূরত্ব বজায় রেখে আসছিল। এমনকি বিজেপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে বাংলাদেশে একটি অনুষ্ঠানে আসার ভিসা প্রদানেও অস্বীকৃতি জানানো হয়েছিল। কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান নিয়েও রিপোর্ট ছাপা হয় গণমাধ্যমে। সব মিলিয়ে ভারতের নতুন সরকারের সাথে বাংলাদেশ সরকারের শুরুতে তৈরি হয় একধরনের মনস্তাত্ত্বি¡ক দূরত্ব। এই দূরত্ব কাটানোর জন্য বর্তমান সরকার ব্যাপক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে আর এ জন্য লবিং করতে বিনিয়োগও করে। এ ক্ষেত্রে ঢাকার ক্ষমতাসীনেরা কিছুটা সফল হয়; কিন্তু এর বিনিময়ে ভারতের ট্রানজিট থেকে শুরু তাদের কাক্সিক্ষত সব চুক্তি সম্পাদনের পাকা অঙ্গীকার করতে হয় বর্তমান সরকারকে। এই অঙ্গীকার পাওয়ার পরই নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সফরের আগে তিনি ভারতীয় সংসদে সীমান্তচুক্তি অনুমোদন করিয়ে নেন।
এভাবে ভারতের চাওয়া-পাওয়ার সব কিছু দিতে গিয়ে চীনের সাথে সৃষ্টি হয় দূরত্ব। ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার ব্যাপারে দু’টি বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছিল চীনকে। প্রথমত, এই ট্রানজিট কোনোভাবেই প্রতিরক্ষা কাজে ব্যবহার করা হবে না। দ্বিতীয়ত, ট্রানজিট চুক্তির পর বিসিআইএম করিডোর চুক্তিও সম্পন্ন করবে ঢাকা। কিন্তু বাস্তবে ভারতের সাথে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ট্রানজিটের মালামাল আনা-নেয়ার ব্যাপারে যে চুক্তি হয় তাতে এমন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে ভারত ঘোষণা না দিয়ে সব ধরনের মালামাল বা সরঞ্জাম ট্রানজিটে আনা-নেয়া করতে পারবে। চুক্তির শর্তে বলা হয়, ভারতের মালবাহী কন্টেইনার চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরে পৌঁছার পর তা গ্রহণ করার সময় ভারতীয় ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও কাস্টমস কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু সিল মারা কন্টেইনার বাংলাদেশের কর্মকর্তারা খুলতে বা যাচাই করতে পারবেন না। সিল মারা অবস্থায় সেটি ট্রানজিট রুট দিয়ে সীমান্তের ওপার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। এর মধ্যে যদি কন্টেইনার খোলা হয় তার দায়দায়িত্ব বর্তাবে বাংলাদেশের ওপর। এই শর্তের কারণে অসত্য ঘোষণা দিয়ে সহজেই ভারত গোলা-বারুদ বা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ট্রানজিট রুটে আনা-নেয়া করতে পারবে বলে চীন মনে করছে। তাদের ধারণা, ভারতের সাথে বন্দর ব্যবহার ও ট্রানজিট চুক্তিটি যেভাবে করা হয়েছে, সেটি তাদের সাথে প্রতারণার শামিল। অন্য দিকে ট্রানজিট চুক্তি ভারতের সাথে করার পর বিসিআইএম করিডোর চুক্তির ব্যাপারে ঢাকার শীতলতা লক্ষ্য করছে বেইজিং। বরং চীনকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ ভারত-নেপাল- ভুটানের সাথে আঞ্চলিক অবাধ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও কার্যকর করার এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। সব মিলিয়ে চীন বর্তমান সরকারের ওপর আস্থা আর রাখতে পারছে না। 
এর প্রতিফলন সাম্প্রতিক চীনা কূটনীতিকদের আচরণের মধ্যেও লক্ষ করা গেছে। চীনের বিশেষ মর্যাদার রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হলেও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আনুষ্ঠানিক কোনো সাক্ষাৎ করেননি। সরকারের কার্যক্রমে নানা বিষয়ে আস্থা হারানোর পর বিএনপির সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে চীনকে। এর মধ্যে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে ঘাঁটি করার সুযোগ দেয়া সংক্রান্ত চুক্তির যে কপি বিভিন্ন সরকারি এজেন্সি থেকে চীনা দূতাবাসে দেয়া হয়েছিল, সেগুলোও ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। এসব কারণে চীনা সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বিশেষ প্রতিনিধিদল ঢাকায় এলে বেগম জিয়ার সাথে ঘটা করে তারা সাক্ষাৎ করেন। 
চীনা দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন সরকারের জন্য বড় রকমের চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রের আভাস অনুযায়ী, চীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেলেও এখন মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে যাবে। পদ্মা সেতুসহ ঢাকাকে দেয়া বিভিন্ন বিনিয়োগ-সুবিধার ওপর যেমন এ চাপের একটি প্রভাব পড়তে পারে, তেমনিভাবে ভারতে বিপুল বিনিয়োগ এবং যৌথভাবে ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সেটি দিয়েও বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে নয়াদিল্লর ওপর চাপ দিতে পারে চীন।
পশ্চিমা চাপ বাড়ছে
পাশ্চাত্যের দেশগুলো শুরু থেকে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের বৈধতা মেনে নেয়নি। যদিও তারা সরকারের সাথে কাজ করে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আপত্তি করেনি। এই নির্বাচনের আগে সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলে উল্লেখ করেছিল। শিগগিরই অরেকটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে অঙ্গীকারও করেছিল। ভারতের পক্ষ থেকেও আমেরিকা ও অন্য কয়েকটি পাশ্চাত্য দেশকে একই প্রতিশ্রতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর সরকার কিছুটা সংহত অবস্থায় চলে গেলে ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন দেয়া হবে না বলে উল্লেখ করা হয়। একতরফা নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে বাংলাদেশে নির্বাচনের দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রসঙ্গ আবার দৃশ্যপটে চলে আসে। কিন্তু ভারত তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তিগুলো সরকারের সাথে করিয়ে নেয়ার আগে কোনো আন্দোলনের কাছে নতি শিকার না করার ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারকে সমর্থন জোগানোয় শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন সফল হয়নি। বিরোধী পক্ষ কূটনীতিকদের অনুরোধে তিন সিটি কপোরেশন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু দৃশ্যমান ভোট ডাকাতির মধ্য দিয়ে এ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর এ সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়ে। একই সাথে পাশ্চাত্যের চাপের মধ্যেও নতুন মাত্রা সৃষ্টি হয়। 
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার নেতিবাচক মনোভাবের প্রতিফলন গত বেশ কিছু দিন ধরে ল্য করা যাচ্ছে। তাদের ধারণাÑ গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ নানাবিধ নাগরিক অধিকারকে ুণœ ও অগ্রাহ্য করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অর্থনৈতিকভাবে দেশটিকে পিছিয়ে দিচ্ছে। উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদী শক্তি এই অস্থিতিশীলতার সুযোগটি ইতোমধ্যেই নিয়েছে এবং আরো নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস। তাদের মনোভাব হচ্ছে এমন যে গণতন্ত্রবিহীন, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এবং জন-অনৈক্যের প্রোপটটি সব বিবেচনাতেই বিপজ্জনক। আমেরিকান পররাষ্ট্র দফতরের মানবাধিকার প্রতিবেদন এবং কোকেন পাচারের ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হইচই থেকে পশ্চিমা চাপের মাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পশ্চিমা দেশগুলো এখন শুধু বাংলাদেশ সরকারের ওপরই চাপ সৃষ্টি করছে না, একই সাথে ভারতের ওপরও চাপ দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। 
ভারতের মনোভাবটিও এমন যেÑ জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদের উত্থান হলে তাতে ভারতই বেশি মাত্রায় তিগ্রস্ত হবে। তারা মনে করে, বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে এমন পরিস্থিতিতে। বাংলাদেশের দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে আপাতশান্তি ফিরিয়ে আনার পর যেকোনো সময় এর বিরূপ বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা দিল্লির নীতি নির্ধারকদের মধ্যে আলোচিত হচ্ছে। কুলদীপ নায়ারের মতো সাংবাদিক যিনি শুরু থেকে শেখ হাসিনার সরকারকে সর্বতোভাবে সমর্থন জানিয়ে লেখালেখি করে গেছেন, তিনি সাম্প্রতিক এক কলামে শেখ হাসিনার শাসনের বিপজ্জনক পরিণতির ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। একই সাথে ভারতের বাংলাদেশ নীতির ব্যাপারেও সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। একই ধরনের মনোভাব ভারতের অনেক থিংক ট্যাঙ্কের বক্তব্যেও আসছে। 
শুরুতে কিছুটা দূরত্ব থাকলেও বাংলাদেশে ভারতের নানাবিধ স্বার্থগত বিষয় যেমনÑ ট্রানজিটের নামে সড়ক, নৌ, রেল, করিডোর প্রাপ্তি, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা লাভ, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সুবিধাদি এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে মোদি সরকারের বাংলাদেশ নীতিতে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন এসেছিল। তবে নয়াদিল্লির বিভিন্ন সূত্র বলছে, সবার অংশগ্রহণে নতুন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকুকÑ এমন অবস্থান থেকে তারা একেবারে সরে গেছে, তা নয়। মোদি সরকার চায়, বাংলাদেশে যে সরকারই মতায় আসুক না কেন, সে সরকারটি যেন কোনোক্রমেই ভারতের স্বার্থবিরোধী না হয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে তিনি সরাসরি এ ব্যাপারে কিছু না বললেও এর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ সময় তিনি ২০১৬ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ভাবতেও শেখ হাসিনার প্রতি পরামর্শ রাখেন। এমন কথাও নয়াদিল্লির বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে, মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ ক্ষমতায় এলে তারা যেন বর্তমান সরকারের সাথে করা চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইছে ভারত। একই সাথে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়টি নিয়েও নিশ্চিত হতে চাইছে। সব মিলিয়ে নয়াদিল্লি তার রাষ্ট্রিক স্বার্থ পরবর্তী যেকোনো সরকারের সময় নিশ্চিত থাকবে মর্মে মনে করলে মধ্যবর্র্তী নির্বাচনের ব্যাপারে চাপ আরো বাড়াতে পারে।
দুই পক্ষের নির্বাচনের প্রস্তুতি?
ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দল উভয় পক্ষ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এ জন্য বিরোধী জোটে বিভক্তি আনা এবং বিএনপি নেতৃত্বকে পরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুপযুক্ত করার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারি দলের নেতাদের বিএনপি-বিষয়ক বক্তৃতা পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, আওয়ামী লীগ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্ততি নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এর মধ্যে প্রতি আসনে তিনজন করে সম্ভাব্য সরকারি দলের প্রার্থীর নামের তালিকা প্রণয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট এজেন্সিকে নির্দেশনা দিয়েছেন। একই সাথে বলা হয়েছে, তারা সরকারের পরোক্ষ সমর্থনপুষ্ট দু’জন বিরোধী দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর নামও যেন ঠিক করে রাখে, যাতে এসব প্রার্থী বিএনপির অফিশিয়াল প্রার্থীর পরাজয়ে ভূমিকা রাখতে পারেন। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ প্রতিবেদন দেয়ার জন্য এজেন্সিটিকে বলা হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে হালনাগাদ করা হবে। 
সম্ভাব্য মধ্যবর্র্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে একই সাথে সরকার জামায়াতে ইসলামীর ওপর পাইকারিভাবে দমননিপীড়ন চালানোর নীতি থেকেও সরে আসার চিন্তাভাবনা করছে। তবে তাদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা হবে, যাতে তারা জোট ছেড়ে আলাদা নির্বাচন করে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়াটিকেও আপাতত ঝুলিয়ে রাখা হবে। তবে আইসিটির মামলার বিষয়টি একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শনির্ভর করে এ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হতে পারে। 
সরকারি দলের পাশাপাশি বিএনপিও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে দলের নেতাকর্র্মীদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে। দলের নেতারা মনে করছেন, ২০১৬ সালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেকোনো সময়ে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। নেতাদের দেয়া আভাস অনুযায়ী, এই নির্বাচন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো হবে না। অন্তর্বর্র্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মাধ্যমে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমদ তো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তার নেতৃত্বে থাকতে পারেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি সার্বিক পরিস্থিতির ব্যাপারে ভারত, আমেরিকা, চীন, রাশিয়াসহ প্রভাবশালী সব পক্ষের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করেছে। 
বাংলাদেশে একটি মধ্যবর্র্র্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি সরকার শুধু আন্তর্জাতিক চাপের কারণে করার প্রয়োজন মনে করছে তা-ই নয়, একই সাথে অর্থনৈতিক দিক থেকেও তীব্র চাপের মুখে রয়েছে সরকার। ব্যাংকগুলোতে চলছে একধরনের বিনিয়োগ অচলাবস্থা। বিদেশী বিনিয়োগহীনতা এবং রাজস্ব আহরণে মন্দার কারণে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও স্থবির হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক বৈধতা ছাড়া সামনে আগানো কঠিন হয়ে পড়ছে বলে অনুভব করছেন সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকেরা। এ ছাড়া মধ্যবর্র্তী নির্বাচনে জয়ী হতে পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব আওয়ামী লীগ সরকার করতে পারবে এমন আশাবাদের মুলোও তাদের সামনে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়, সেটি দেখার জন্য আরো কিছু সময় পরিস্থিতি অবলোকন করতে হবে।
মাসুম খলিলী

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads