শুক্রবার, ১০ জুলাই, ২০১৫

সৈয়দ আশরাফের অর্ধ-বিদায়


অবশেষে সরেই যেতে হলো সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। গত ৭ জুলাই একনেকের সভায় ছয় হাজার ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী যখন  স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর অনুপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আপত্তি জানিয়েছিলেন, তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। সৈয়দ আশরাফ সেদিন তার নিজের এলাকা কিশোরগঞ্জে ছিলেন। অব্যাহতি সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার জবাবে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘গুজবে কান দেবেন না।’ অর্থাৎ সেদিন পর্যন্তও তিনি ভাবতে পারেননি যে, তার মতো ক্ষমতাধর এবং প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীকেও বাদ দেয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। অন্যদিকে সেটাই ঘটেছে পরদিন। ৮ জুলাই সত্যিই বাদ পড়েছেন তিনি। তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করেছেন প্রধানমন্ত্রী- যেমনটি একবার সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে করা হয়েছিল। এখানে শিরোনামে ব্যবহৃত ‘অর্ধ-বিদায়’ কথাটার ব্যাখ্যা দেয়া দরকার। সৈয়দ আশরাফকে শুধু এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব থেকেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি এখনো আওয়ামী লীগের সাধারণ পদে বহাল রয়েছেন। সে কারণে এখনই বলার সময় আসেনি যে, তাকে একেবারে বিদায় করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তা সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।
সৈয়দ আশরাফের ব্যাপারে আপত্তি অবশ্য প্রথম থেকেই ছিল। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মন্ত্রী প্রবরের বদৌলতে পুরোপুরি ঝিমিয়ে পড়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ঝিমিয়ে না পড়ে উপায়ও ছিল না। কারণ, প্রথম পর্যায়ে ২০১১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিন বছর পেরিয়ে গেলেও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মবলগে মাস তিনেকের বেশি সচিবালয়ে তার দফতরে যাননি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গেছেনও আবার মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকে অংশ নিতে। তাই বলে প্রতিটি সভায় নয়, অংশ নিয়েছেন মাঝে-মধ্যে। মন্ত্রিসভার বৈঠকের ব্যাপারেই যার এত কম আগ্রহ তাকে যে মন্ত্রণালয়ের মাসিক সভায় খুব একটা দেখা যাবে না সেটাই স্বাভাবিক। দেখা আসলে যায়ও নি। কেন এই অনুপস্থিতি এবং কাজ ফেলে দূরে দূরে থাকা- তার কারণ জানাতে গিয়ে সংবাদপত্রের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মনে হতে পারে যেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেশি ব্যস্ত থাকেন বলেই তিনি সরকারি কাজে সময় দিতে পারেন না। আসলে কিন্তু তা নয়। দলীয় কাজকর্মেও মোটেই পাওয়া যায় না তাকে। রাজধানীর বাইরে থেকে আসা দলের নেতা-কর্মীরা তার হদিস পান নাÑ সচিবালয়ে তো বটেই, মন্ত্রী পাড়ার বাসভবনেও। সচিবালয়ে সবাই ঢুকতে পারেন না, বাসভবনে ঢোকার ব্যাপারে আবার খোদ মন্ত্রী প্রবরের নিষেধ রয়েছে।
সে সময় প্রশ্ন উঠেছিল, সচিবালয়ে যান না, বাসভবনেও দেখা করেন না, তাহলে তিনি করেনটা কি? অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল বিচিত্র কিছু তথ্য। যা-ই করুন না কেন, অনেক রাত পর্যন্ত ‘কাজ’ করতে হয় বলে তিনি দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠতে পারেন না। শেভ-গোছল থেকে কাপড় পরে তৈরি হওয়া পর্যন্ত সব কাজ সারতে সারতে বেলা গড়িয়ে যায়। ততক্ষণে আর সচিবালয়ে যাওয়ার সময় থাকে না। তাকে তাই বলে দলীয় কার্যালয়ে বা প্রধানমন্ত্রীর ধানমন্ডির অফিসেও তেমন দেখা যায় না। এরপর আসে রাত জেগে ‘কাজ’ করার পালা। সে কারণে পরদিন সচিবালয়ে যাওয়া হয় না। মাঝখানে অন্য একটি খবরও প্রাধান্যে এসেছিল। সুযোগ পেলে শুধু নয়, উপলক্ষ সৃষ্টি করে হলেও প্রায়ই লন্ডনে পাড়ি জমান তিনি। ব্যক্তিগত সফরের আড়ালে মাসের বেশিরভাগ কাটান লন্ডনে। সেখানে তার ভারতীয় শিখ স্ত্রী ও সন্তান বসবাস করেন। ওদিকে মন্ত্রীকে অনুসরণ করার জন্য কি না সেটা একটি প্রশ্ন বটে, তবে প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকও সচিবালয়ের দিকে খুব একটা যাননি বললেই চলে। মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কাজকর্মেও তাকে তেমন পাওয়া যায়নি। এভাবে সব মিলিয়েই ঝিমিয়ে পড়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সচিবালয়ে শুধু নয়, ফাইলের স্তূপ জমেছিল মন্ত্রীর বাসভবনেও। একই অবস্থা দেখা দিয়েছিল সর্বশেষ ঘটনার প্রাক্কালেও। ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীর কবির নানকের স্থলে প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। শোনা যায়, তাকেও মন্ত্রণালয়ে যাওয়া-আসার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী দেখা যায় না। একনেকের যে সভায় অর্থমন্ত্রী আপত্তি তুলেছেন সে সভার দিনই প্রতিমন্ত্রী ‘মাত্র’ ১০ দিনের সফর শেষে বিদেশ থেকে ফিরেছিলেন। ক্লান্তির কারণে সম্ভবত একনেকের ওই সভায় যেতে পারেননি- যদিও বাদ পড়ে যাওয়ার কথা শুনেই সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে!
 সৈয়দ আশরাফের বিষয়টিকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, একে তো প্রভাবশালী মন্ত্রী, তার ওপর ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। উন্নয়ন বাজেটের বিরাট অংশ বাস্তবায়িত হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। উপজেলাসহ স্থানীয় সরকারের দেখভাল করার দায়িত্বও তার। সে মন্ত্রী দিনের বেলায় ঘুমিয়ে কাটানোর ফলে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের সব উন্নয়ন প্রকল্প ‘লাটে’ ওঠার উপক্রম হয়েছে। উপজেলা পর্যায়েও সৃষ্টি হয়েছিল অচলাবস্থার। দেশের অনেক উপজেলা অফিসে তো তালা পর্যন্ত ঝুলতে দেখা গেছে। এক কথায়, দেশের ১২টা তো বাজছিলই, সরকারের জন্যও সমস্যার পাহাড় তৈরি করেছিলেন সৈয়দ আশরাফ। সচেতন সকল মহলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল আসলে দেশ ও জনগণের জন্য। উন্নয়ন কর্মকান্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা যেখানে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেন না সেখানে সরকারের কাছে নিশ্চয়ই আশা করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বলা দরকার, সৈয়দ আশরাফ কিন্তু এমনি-এমনি ‘লাই’ পাননি। জেনারেল মইন উ’দের আমলে তার ওপর এমন এক শক্তির ‘ব্লেসিং’ ছিল যাদের ‘ব্লেসিং’ নিয়েই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পেরেছে বলে প্রচারণা রয়েছে। এসব বিষয়ে অনেক আগে জানিয়ে রেখেছেন তার ইমিডিয়েট পূর্বসূরী আবদুল জলিল। কিছুদিন আগে পর্যন্তও সে একই শক্তির ‘ব্লেসিং’ ছিল বলেই সৈয়দ আশরাফ সম্ভবত কাউকে- এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। অনেক দেরিতে হলেও তার জবাব সৈয়দ আশরাফকে পেতে হয়েছে। অবশেষে সত্যি সত্যি ‘আপদ’ বিদায় করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পর্যবেক্ষকরা অবশ্য সৈয়দ আশরাফকেই একমাত্র ‘আপদ’ মনে করেন না। তাদের মতে আরো অনেক ‘আপদ’ই রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অবশ্য অকারণে এতদিন মন্ত্রী পদে বহাল থাকেননি। বিশেষ কিছু কারণের মধ্যে একটি প্রধান কারণ ছিল তার ‘উদ্ধারকারী’র ভূমিকা। মাঝে-মধ্যেই তাকে অনেকের বিপদে ‘উদ্ধারকারী’র ভূমিকায় দেখা গেছে। যেমনটি গিয়েছিল ২০১৩ সালের জুলাইয়ে, পবিত্র রমযান মাসে। তখন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘোষিত এক ‘তথ্য-তত্ত্ব’ নিয়ে বিতর্কের ঝড় চলছিল। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, জয় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ অবারও ক্ষমতায় আসবে বলে তার কাছে ‘তথ্য’ রয়েছে। কথাটা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় তুলেছিল। প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের সেদিনের বিপদে সবার আগে দৃশ্যপটে এসেছিলেন সৈয়দ আশরাফ। নিজের ঘোষণা অনুযায়ী ‘না হিন্দু, না মুসলমান’ হলেও মাথায় টুপি লাগিয়ে এক ইফতার মাহফিলে দেয়া বক্তব্যে জয়ের বোঝাটা নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি। জয় যেখানে তার কাছে ‘তথ্য’ রয়েছে জানিয়েছিলেন সেখানে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, তার কাছে ‘তথ্য’ নেই, তবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার ‘গন্ধ’ পাচ্ছেন তিনি! এই ‘গন্ধ’ তিনি নাকি পেয়েছেন একজন রাজনীতিক হিসেবে! সৈয়দ আশরাফের ব্যাখ্যায়ও কোনো ফাঁক ছিল না। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন হবেই এবং সে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তার নেত্রীর দল আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে বলে তিনি ‘গন্ধ’ পাচ্ছেন! সে সময়ে বিভিন্ন মহলের আলোচনায় বলা হয়েছিল, শুনতে খুব সহজ-সরল এবং রাজনীতিকসুলভ মনে হলেও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ‘তথ্য-তত্ত্ব’ এবং সৈয়দ আশরাফের ‘গন্ধ-তত্ত্বের’ নাড়ি বা মূলসূত্র রয়েছে একই স্থানে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা হবে বলে ‘দক্ষিণী’ কোনো বিশেষ কেন্দ্র থেকে দু’জনের কানেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। অনেকটা হঠাৎ করে রাজনীতিতে নেমে পড়েছেন বলে জয়ের পক্ষে ‘কানপড়াটা’ চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। তার ওপর পাঁচ-পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হেরে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সে সময়  দলের জন্য দরদে উথলে ওঠাটাও ছিল স্বাভাবিক। সেই সাথে ছিল দলের নেতিয়ে পড়া নেতাকর্মীদের ‘টনিক’ বা মৃতসঞ্জীবনী ধরনের কোনো ‘সুরা’ দিয়ে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্য। আবেগের আতিশয্যে তথ্যটি জয় আসলে ‘টনিক’ এবং মৃতসঞ্জীবনী ‘সুরা’ হিসেবেই নেতাকর্মীদের গলায় ঢেলেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কূটনীতিতে যথেষ্ট ঝানু বলে বিশেষ কিছু মহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত সজীব ওয়াজেদ খেয়াল করেননি, ঘরের সব খবর বাইরে প্রকাশ করতে হয় না। কারণ, সময়টা তখন আওয়ামী লীগের জন্য ভালো যাচ্ছিল না।
বলা দরকার, রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন এর উল্টো ব্যাখ্যাও করা হয়েছিল। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলেছিলেন, লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস ও ১/১১ ঘটানো থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা এবং নিজের মা শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমানও। সেই থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে এসেছেন। সুতরাং এমন মনে করার সুযোগ ছিল না যে, ‘তথ্য-তত্ত্ব’টি কোনো অপরিপক্ব যুবকের মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছিল। তাছাড়া তিনি আবার পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধাসহ ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাও। সব মিলিয়েই বলা হয়েছিল, আগে যেভাবেই তাকে হাজির করা হয়ে থাকুক না কেন, তিনি কেবলই প্রধানমন্ত্রীর অতি আদরের পুত্র বা ‘বঙ্গবন্ধুর’ নাতি নন, একজন রাজনীতিকও হয়ে উঠেছেন বটে- যাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক আশা ও পরিকল্পনা রয়েছে। একই কারণে তার কোনো কথাকেই আর হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। তার ‘তথ্য-তত্ত্ব’ও তাই নিন্দা-সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। বলা হয়েছে, এটা অবশ্যই কথার কথা নয়। সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্যের ভিত্তিতে জয় আসলে আগাম জানান দিয়েছেন। আর এ ধরনের ‘তথ্য’ যে জয়ের জানা থাকে বা তাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখা হয় তার প্রমাণ তো বহু আগেই পাওয়া গেছে।  
ওদিকে সৈয়দ আশরাফকেও যেনতেন রাজনীতিক মনে করার সুযোগ ছিল না। তার সম্পর্কে সবচেয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু তথ্য জানিয়ে গেছেন মরহুম আবদুল জলিল- যিনি সৈয়দ আশরাফেরই ইমিডিয়েট পূর্বসূরী অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১/১১-এর পর সৈয়দ আশরাফ কিভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তার কোন ধরনের ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ হয়েছিল এবং ঠিক কোন আশ্বাস ও ভরসায় তিনি লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেনÑ এসব বিষয়ে আবদুল জলিল বহুবার বলেছেন। সংবাদপত্রেও এ সম্পর্কিত রিপোর্ট বেরিয়েছে। পাঠকদেরও মনে পড়তে পারে, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে গিয়ে আবদুল জলিল একের পর এক হাটে হাঁড়ি ভেঙেছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই তার সে সব বক্তব্য নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় বয়ে গেছে। লন্ডনের বাংলা টিভি এবং একাধিক বার্তা সংস্থাকে দেয়া পৃথক পৃথক সাক্ষাৎকারে অনেক গোপন কথাই ফাঁস করেছিলেন তিনি। এরকম একটি তথ্য জানাতে গিয়ে আবদুল জলিল বলেছিলেন, জেনারেল মইন উ আহমেদের নেতৃত্বাধীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ ছিল বলেই আওয়ামী লীগের পক্ষে এত বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয় অর্জন করা এবং ক্ষমতায় আসা সম্ভব হয়েছে। এর আগে আবদুল জলিল আরো বলেছিলেন, বর্তমান অর্থাৎ শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভার ৯০ শতাংশই ‘সংস্কারপন্থী’ এবং তাদের বেশির ভাগই সেনাসমর্থিত সরকারের দিনগুলোতে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যে ওই গোয়েন্দা সংস্থার  সঙ্গে সমঝোতা করেই লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন সে কথারও পুনরাবৃত্তি করেছিলেন আবদুল জলিল। এ প্রসঙ্গে নতুন একটি তথ্যও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। প্রথমবারের মতো জানিয়েছিলেন, লন্ডনে বসে সবকিছুর পছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন শেখ রেহানা। তার মধ্যস্থতাতেই সৈয়দ আশরাফ দেশে ফিরতে পেরেছিলেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতাদের ‘ছেলে-ছোকড়া’ অভিহিত করে আবদুল জলিল জানিয়েছিলেন, গোয়েন্দা সংস্থাটি তাকেও বাগে আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি বলেই তার ওপর রাগ মিটিয়েছে। তাকে গ্রেফতার করে হেনস্তা করেছে।
আবদুল জলিলের সব কথা না মেনেও বলা যায়, সজীব ওয়াজেদ জয়ের মতো সৈয়দ আশরাফও কেবলই একজন রাজনীতিক নন। ১/১১ ঘটানোসহ রাষ্ট্রক্ষমতার রদবদলে তারও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ধরনের কর্মকান্ডে তিনি নাকি ‘তুখোড়’ একজন খেলোয়াড়ও। কথাটা আমাদের নয়। আবদুল জলিল তো বলেছেনই, বলেছেন আরো অনেকেও। সুতরাং সে সৈয়দ আশরাফও যখন সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরপর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে আগাম ‘গন্ধ’ পেয়েছিলেন তখন উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল সঙ্গত কারণে। মাত্র মাস পাঁচেকের মধ্যে কথাটা সত্যও প্রমাণিত হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিই আবারও ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। এজন্যই বলা হয়েছিল, সজীব ওয়াজেদ জয় অকারণে হঠাৎ ‘তথ্য-তত্ত্ব’ হাজির করেননি, সৈয়দ আশরাফের নাকেও ঠিক ‘গন্ধ’ই ঢুকেছিল। সুখবর হওয়ায় শুধু গন্ধ না বলে সৈয়দ আশরাফের উচিত ছিল ‘খুশবু’ও বলা। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ ‘খুশবু’ না বলে শুধু ‘গন্ধ’ পর্যন্ত এসেই থেমে গিয়েছিলেন। তার সম্ভবত আশংকা ছিল, কৌশলের জবাবে পাল্টা  কৌশল বলেও একটা কথা রয়েছে! তাছাড়া যুগে যুগে প্রমাণিত সত্য হলো, মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে হত্যা করলেই বাংলাদেশের জনগণকে দমন করা বা ইচ্ছাধীন করে ফেলা যায় না। বিশেষ করে এমন কোনো দল বা নেত্রীকে ক্ষমতায় আনা যায় না, যার বা যাদের বিরুদ্ধে দেশের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালন করার অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সৈয়দ আশরাফকে অবশ্য তেমন কোনো পরিণতি দেখে যেতে হলো না। তা সত্ত্বেও তার সর্বশেষ একটি কথার মধ্যে কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে। মন্ত্রিত্ব খোয়ানোর দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক শেষে দলের এক ইফতার অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, না হলে ‘অশুভ শক্তি’ ক্ষমতা দখল করে নেবে। কথাটার মধ্য দিয়ে দৃশ্যত খালেদা জিয়াকে ভয় দেখালেও অন্তরালে আরো কোনো রহস্য রয়েছে কি না, অতীতের মতো বর্তমান পর্যায়েও তার নাকে আগাম কোনো ‘গন্ধ’ আসতে শুরু করেছে কি না- এসব বিষয়ে জানার জন্য অপেক্ষা না করে উপায় নেই। তবে চিন্তা ও উদ্বেগের কারণ হলো, ‘অশুভ শক্তি’র ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনার ব্যাপারে অন্য কেউ নন, আবারও সৈয়দ আশরাফই বলেছেন- যাকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে একজন তুখোড় খেলোয়াড় বলা হয়।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads