বৃহস্পতিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১২

নির্বাচন নিয়ে কোলাহল নেই যে দেশে-



 বাংলাদেশ আর ভুটানের নির্বাচন প্রায় একই সময়ে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে সেখানে নেই কৌতূহল, কোলাহল। চায়ের দোকানের আড্ডায়ও নেই নির্বাচন প্রসঙ্গ। ছিমছাম ছোট জেলা শহর পারো। দেড়-দুই কিলোমিটারের সিটি সেন্টার। হাজার দুয়েক লোকের বাস। আর ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে দশ হাজার লোকের বাস। গণতন্ত্রের সূচনালগ্নে পারোর বাসিন্দাদের দিন কেমন কাটছে? সোনামস ট্রফেল হোটেলের মালিক ও তার কন্যার প্রতিক্রিয়া ছিল দুই মেরুর। মা একেবারেই রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন। রাজার শাসনেই তিনি ভাল আছেন। মেয়ে উইকলি বিজনেস ভুটানে কাজের সুবাদে জানেন অনেক কিছুই। আগামী বছর নির্বাচন জানাতেই, পাল্টা প্রশ্ন, তোমাদের এখানে রাজার পছন্দের দল কি ক্ষমতায় আসবে? রাজা কি অনুঘটক হিসেবে পর্দার আড়ালে কাজ করে না? প্রশ্ন শুনে অবাক উইকলি। না, তা হবে কেন? নির্বাচন নির্বাচনের মতো। রাজা এসব নিয়ে কখনও মাথা ঘামান না। কে ক্ষমতায় এলো তা নিয়ে রা নেই রাজ অন্দরমহলের কারও। একই রকম সুর পারো ক্যান্টিনের পাফিরও। মাঝারি গোছের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। বিকিকিনির ফাঁকে ফাঁকেই কথা হচ্ছিল রাজনীতি নিয়ে। পারো শহরে এক যুগের বেশি সময় গাড়ি চালাচ্ছে সোনম নামগেলে। তারও ভাষ্য হচ্ছে, গণতন্ত্র হোক আর রাজতন্ত্র হোক আমরা বুঝি রাজাকেই। কিং ইজ কিং। আর রয়্যাল ভুটানিয়ান গভর্নমেন্টের ফরেস্টার ওয়াংচকের মন্তব্য প্রজারা গণতন্ত্র চাননি। রাজা নিজেই বছরের পর বছর গণতন্ত্র শিখিয়েছেন প্রজাদের। গণতন্ত্র এলেই দেশে অশান্তি শুরু হবে। অপরাধ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর পাকিস্তানের মতো হবে। কিন্তু চতুর্থ রাজা জিগমে সিগমে ওয়াংচুক প্রজাদের বুঝিয়েছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বকে মোকাবিলায় গণতন্ত্র দিতে চাই। দূর অতীতের রাজতন্ত্র এশিয়ান জাতিগোষ্ঠীর জন্য উত্তম শাসন ব্যবস্থা হতে পারে না। ভারত ও চীনের মতো পরাক্রমশালী দু’টি দেশের বাইরে নিজেদের এক স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে পরিচিত করতে সত্যিকার গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে দুনিয়ার তাবৎ মিডিয়াও।
১৯০৭ সালে ওজেন ওয়াংচুক প্রথম রাজা হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। তার শতবর্ষ পালিত হয় ২০০৭ সালে। ১০১ বছরে দেশটির রাজতন্ত্র ভেঙে রাজা নিজেই বিকেন্দ্রিকরণে কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। রাজতন্ত্রের শতবর্ষ পূরণের অনেক আগেই তৃতীয় রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক দেশে রাজতন্ত্র বিলোপের আওয়াজ দেন। একই সঙ্গে দাসপ্রথাও নিষিদ্ধ করেন। প্রগতিশীল আগ্রগামী চিন্তার জন্য তাকে আধুনিক ভুটানের জনকও বলা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পুত্র চতুর্থ রাজা জিগমে সিগমে ওয়াংচুক ছুটে যান মাইলের পর মাইল। উদ্দেশ্য একটাই- দেশবাসীকে গণতন্ত্রমনা করা। প্রজাদের নানা আপত্তি। তাতে একটুও দমেননি জিগমে। তারও এক যুগ আগে ১৯৯৬ সাল থেকেই শক্তিশালী রাজতন্ত্র থেকে উত্তরণে সংবিধান সংশোধনের কাজ শুরু করেন। শান্তিপ্রিয় ভুটানজুড়ে গণতন্ত্র নামক শাসনকেও যুক্ত করতে থাকেন। দিনের শুরু আর দিন শেষে রাজবাড়ির সামনে রাজা আর ধর্মগুরুর প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বেজে ওঠে বিউগল। সামরিক কায়দা মেনে ড্রাগন অঙ্কিত পতাকা উত্থিত-অবনমিত হয়। এই যেন রীতি। পুরো ভুটানের সবখানে তা বিচারালয় বা ধর্মালয় যা-ই হোক রাজার ছবি শোভা পাচ্ছে। আবার বৃটিশ কায়দায় শিশু গণতন্ত্রও কাজ করছে। নব্বইয়ের দশকে নেপালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে মাওবাদীরা ক্ষমতায় আসে। জাদুঘরে পাঠায় রাজপরিবারকে। কিন্তু ভুটানে উল্টো চিত্র। হাত ধরে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। রাজা ডেকে ক্ষমতায়ন করেন প্রজাদের। সংবিধানে রাজাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলা হলেও, দেশ পরিচালনার নির্বাহী দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদের ওপরই। একেবারেই নতুন ধাঁচের এই রীতি মেনে নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে ভুটানের রাজা-প্রজা উভয়কেই। ভুটানের জনগণ রাজাকে যে ঈশ্বর বলে মানে। তারা কোনভাবেই তাকে ছাড়তে রাজি নন। দূরদৃষ্টি নিয়ে জিগমে ২০০৭ সালে থিম্পুতে পরীক্ষামূলক নির্বাচনের আয়োজন করেন। এর আগে ২০০৫ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ শেষ করেন। একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীকেও দায়িত্ব দেন। পরীক্ষামূলক নির্বাচনটি মক ইলেকশন নামেই পরিচিত। ২০০৭-এর ২২শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে এক লাখ পঁচিশ হাজার ভুটানি অংশ নেয়। মক নির্বাচনে অংশ নেয়া পার্টিগুলো ছিল দ্রুক ব্লু, দ্রুক গ্রিন, দ্রুক রেড, দ্রুক ইয়েলো। পরীক্ষামূলক নির্বাচন শেসে প্রাথমিক পর্যায়ে দু’টি পার্টি রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। দল গঠন করে। যার একটির নেতৃত্বে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী জিগমে থিনলে। পার্টির নাম দ্রুক পয়েনসাম থুকপা (ডিপিটি)। অন্যটির নেতৃত্বে ছিলেন সাঙ্গে নেদুপ। পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)। দুটোই ২০০৭-এ কাজ শুরু করে। নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলও এই দুটোই। সবশেষ গত ক’বছরে আরও কিছু নতুন রাজনৈতিক দল ভুটানে কাজ শুরু করেছে। তাদের মধ্যে ভুটান ডেমোক্রেটিক স্যোসাল পার্টি, ভুটান ন্যাশনাল কংগ্রেস, ভুটান গোর্কা ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ভুটান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, ভুটান পিপল পার্টি, ভুটান টাইগার্স পার্টি, ভুটান ন্যাশনাল পার্টি।
২০০৮-এর মার্চের ২৪ তারিখ। দিনটি ছিল ভুটানের ইতিহাসে অনন্য। অন্যরকম উৎসবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের একটি অনুষ্ঠিত হয়। দুনিয়ার বাঘা বাঘা নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের এ নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক কিছুই লেখার ছিল না। তিন লাখ এক হাজার এক শ’ পঁয়ষট্টি ভোটার ভোট দিতে গিয়ে বাতিল হয়েছিল ২২২ ভোট। ৪৭ আসনের পার্লামেন্টে দ্রুক পয়েনসাম থুকপা (ডিপিটি) পেয়েছিল ৪৫ আসন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থিনলের নেতৃত্বে বিশ সদস্যের মন্ত্রিসভা দেশ পরিচালনায় রাজার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করছে। পিডিপি দুই আসন পেয়ে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে আছে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট ভুটানের নির্বাহী বিভাগে উচ্চ কক্ষ পঁচিশ সদস্যের। তার মধ্যে বিশটি জেলা বা জং থেকে থাকেন বিশ প্রতিনিধি। আর রাজার মনোনীত পাঁচ প্রতিনিধি। এই নিয়ে পঁচিশ জনের উচ্চকক্ষ বা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ভুটান। যা গঠিত হয় ২০০৭ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। আর সংসদ বা ন্যাশনাল এসেম্বলি অব ভুটান গঠিত হয় ৪৭ সদস্য নিয়ে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads