বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১২

বেগম খালেদা জিয়া ও শৈশব



লিখেছেনঃ রুহুল আমীন
বাংলাপোষ্ট২৪/জেটঃ ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় সমস্ত বিশ্ব প্রকম্পিত। মিত্রশক্তি ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় এবং ৯ আগস্ট নাগাসকিতে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ল ল নিরীহ মানুষ মারা যায়। ল ল লোক পঙ্গুত্ব বরণ করে। সমগ্র এলাকা পণিত হয় ধংসস্তুপে। ১৩ আগস্ট অশক্তির প্রধান নাজী নেতা জার্মান রাষ্ট্রপতি হের হিটলার আত্মহত্যা করেন। অপর নেতা ইতালির মুসোলিনি আত্মসমর্পণ করেন। ফলে মিত্রশক্তি যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং ১৫ আগস্ট ৫ বছর স্থায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। বিশ্বের মানুষ বিভীষিকার হাহাকার থেকে মুক্তি লাভ করে। বিশ্বের সর্বত্রই তখন শান্তির জয়গান ও প্রশান্তির বাণীতে মুখরিত; শহরে-বন্দরে-গ্রামে-গঞ্জে, অলিতে-গলিতে বের হচ্ছে অজস্ত্র শান্তির মিছিল। ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি’ এ চক্তিুতে স্বার করতে উদ্যোগী হন নেতারা।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার জনগণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে এ রাজ্যে দুর্ভিে প্রায় ৫০ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। ফলে ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি’ এ স্লোগানে তারা রাজ্যের সর্বত্র মুখরিত করে তোলে। যুদ্ধ শেষে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করায় মুসলমানরা মসজিদে মিলাদ দেয় ও হিন্দুরা মন্দিরে পুজো দেয়, খৃষ্টানরা গির্জায় প্রার্থনা করে। জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা  প্রকাশ করে।
বিশ্বের সর্বত্র  যখন শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে ঠিক সেই বিরল মুহূর্তে ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জলপাইগুড়ি জেলা শহরের নয়াবস্তির এক আভিজাত্যে ভরা শান্তির নীড় মুজমদার পরিবারে প্রচণ্ড খুশির বার্তা বয়ে জনাব এস্কান্দার মজুমদারের ঔরস্যে ও বেগম তৈয়বা মুজমদারের গর্ভে একটি ফুটফুটে, নাদুস-নুদুস কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। দেখতে সে তার মা বাবার মতোই। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। ভুমিষ্ঠ হয়েই অল্পণ চুপ থেকে পরণেই খুব উচ্চস্বরে আপ্রাণ জোরে কেঁদেছিল। ভূপ্রকৃতির মধ্যাকর্ষণ শক্তির বন্ধন  টানে তা শোনে আশপাশের অনেকেই দৌড়ে দেখতে এলো, তার আম্মাও প্রসবকালীন কষ্টের পর দীর্ঘশ্বাসে কিছুটা স্বস্তি ফেললেন। এ বাড়িতে নতুন শিশু আসবে সবাই তা জানতো। তাই নতুন শিশুর জন্য পেয়ালায় আগে থেকে রাখা ছিল মধু। বৃদ্ধ ধাত্রী শিশুর মুখে মধু তুলে দিতেই কান্না থেমে গেলো। এরপর শান্ত শিশু বড় বড় চোখ তুলে তাকাল এদিক-ওদিক। দেখল এক রহস্যময় পৃথিবী।
তখন শরতের স্নিগ্ধ ভোর। নতুন শিশুর আগমনে পরিবারের সবাই আনন্দিত। শিশুর বড় বোন খুরশিদ জাহান আঁতুড় ঘরে গিয়ে দেখল সদ্যোজাত বোনকে। খুশিতে সে দিশেহারা। ছোট বোন বিউটি তখনও ঘুমিয়ে। খুরশিদ জাহান দৌড়ে গেলো তার ক।ে ঘুম থেকে ডেকে তুললো বিউটিকে। বললো দেখে এসো বিউটি, আমাদের কি সুন্দর বোন হয়েছে। আকস্মিক খবরে ছোট বিউটি হকচকিয়ে গেলো। ওর বয়স তখন আড়াই বছর। চোখ কচলাতে কচলাতে সেও গেল আঁতুড় ঘরে। নতুন বোনকে দেখে মহাখুশি। আবেগে বলেই ফেলল ওকি আমার পুতুল। আমি ওর সঙ্গে খেলব। খুশিতে বাবা এস্কান্দার মজুমদার দোকানে গেলেন মিষ্টি আনতে। পাশের বাড়ির বৌউ-ঝিরা এলো মজুমদার বাড়িতে। এলো নতুন শিশুকে দেখতে। শিশুকে বললো রাজকন্যা, কেউ বললো লাল টুক- টুকে পরী। তারা কামনা করল নতুন শিশুর দীর্ঘজীবন।
খুশির খবর পেয়ে এস্কান্দার মজুমদার সাহেবের বন্ধু ডাক্তার অবনী গুহ নিয়োগি এলেন ঐ বাড়িতে। তিনি মজুমদার সাহেবের শুধু বন্ধুই নন, এ বাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক । উঠোন থেকেই ডাকলেন মজুমদার সাহেবকে। বললেন, আগে মিষ্টি চাই। মেয়ে এমন সময় জন্ম নিয়েছে, যখন সর্বত্র শান্তি। এই মেয়ের  নাম রেখে দাও ‘শান্তি’।
 যিনি এদেশে ১৫ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীকও বটে। সেদিনের সেই ফূটফুটে শিশুটিই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বর্তমান বিরোধী দলীয় নেত্রী শহীদ জিয়ার সুযোগ্য উত্তরসূরি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া
স্নেহময়ী মায়ের কোলে ও বোনদের সোহাগী আদরে বড় হতে থাকলেন খালেদা জিয়া। একদিন দু’দিন করে তার বয়স হলো সাত দিন। এবার নাম রাখার পালা। মহা উৎসবে চললো আয়োজন। ভালো খাবারের আয়োজন করা হলো। আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করা হলো। এভাবেই সম্পন্ন হলো তার আকিকা।
সেদিন বাবা তার  তৃতীয় কন্যার নাম রাখলেন খালেদা খানম। সন্তানদের নাম সাধারণত তিনিই রেখে থাকেন। তবে বিপত্তি দেখা গেলো ডাক নাম নিয়ে। কি নামে ডাকা হবে তাকে? শান্তি, টিপ্সি না পুতুল। শান্তি নামটি পছন্দ করেছেন পারিবারিক চিকিৎসক ডা. অবনী গুহ নিয়োগি। টিপ্সি নামটি দিয়ে ছিলেন বাবা এস্কান্দার মজুমদার। আর পুতুল নামটি আগেই দিয়ে রেখেছে  মেজো বোন বিউটি। অবশেষে বিউটিরই জয় হলো। তার পছন্দ করা পুতুল নাম রাখাই সিদ্ধান্ত হলো। খালেদা জিয়ার ডাক নাম সেদিন থেকেই ‘পুতুল’।
খালেদা জিয়া যখন জন্ম নিলেন, জলপাইগুড়ি তখন এক শান্ত-স্নিগ্ধ শহর। সেই শহরের মধুময় এ স্মৃতি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে ছিল খালেদা জিয়ার মা বেগম তৈয়বা মজুমদারের। খালেদা জিয়ার জন্মের স্মৃতিও মনে আছে বেগম তৈয়বা মজুমদারের। ১৯৮৩ সালে শহীদ জিয়ার ক্যান্টমেন্টের বাসায় একদিন এ প্রসঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন :
“পুতুলের জন্মের আগে যুদ্ধের খুব বিভীষিকা ছিল। মানুষ শুধু যুদ্ধেরই গল্প করতো। পুতুলও জন্ম নিল, যুদ্ধও থেমে গেল। আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ডা: অবনী গুহ নিয়োগি এবং প্রতিবেশীরা বলতো পুতুল খুব সৌভাগব্যান। আমার খুব আনন্দ লাগত। পুতুলের যেদিন জন্ম হলো, সেদিন থেকেই আমার মেজো মেয়ে বিউটি ওকে পুতুল নামে ডাকতে শুরু করলো। বিউটির মাটির একটি পুতুল ছিল। একদিন পুতুলটির হাত-পা ভেঙে যায়। ফলে বিউটি খুব কান্নাকাটি করেছে। এর পরই আমার ছোট  মেয়ে জন্ম নেয়। বিউটি মাটির পুতুলের কথা ভুলে যায়। বিউটি তখন থেকেই পুতুলকে নিয়ে সারাণ খেলতো। পুতুল ছিল ওর সারাণ খেলার সাথী।”
মাতৃ এবং পিতৃকূলের দিক থেকে চারটি বিখ্যাত সংস্কৃতিবান পরিবারের উত্তরসূরি বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর মাতৃকূলের পূর্ব পুরুষ মুহাম্মদ দানিয়েল ছিলেন বাংলার সুবাদার মীর জুমলার ভাই। ১৯৬২-৬৩ খৃস্টাব্দে কুচবিহারের অন্তর্গত তদানীন্তন জলপাইগুড়ির মধ্য দিয়ে আসাম অভিযান কালে কুচবিহারের রাজা তাকে বাধা দিয়েছিলেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজা মুঘল বশ্যতা স্বীকার করেন। মীর জুমলা একটি দুর্গ নির্মাণ করলেন জলপাইগুড়ির বোদা পরগনায়। মুহাম্মদ দানিয়েল তখন দিল্লীতে রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। তাকে দিল্লী থেকে এনে দুর্গের সেনাধ্য নিযুক্ত করা হয় এবং পরগনার প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়। মোহাম্মদ দানিয়েল আর দিল্লী ফিরে  যাননি। তিনি বোদা পরগনার চন্দবাড়ি গ্রামে বাসগৃহ নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে  থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে তার বংশধর স্থানীয় জনগণের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। মীর জুমলার সঙ্গে মোহাম্মদ দানিয়েল ইরান থেকে প্রথমে আসেন দাণিাত্যের গোলকুন্ডায়। সেখানে সুলতানের অধীনে দুই ভাই চাকরি নিয়েছিলেন। দু’জনই ছিলেন সুশিতি। মীর জুমলা ছিলেন ফারসী সাহিত্যে সুপন্ডিত। রাজনৈতিক বিচণতার সুবাধে তিনি গোলকুন্ডা রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হন। তার সামরিক দতাও ছিল অসাধারণ। সম্রাট শাহাজাহানের হাতে গোলকুন্ডা  বিজিত হওয়ার পর সেখানকার জগদ্বিখ্যাত কোহিনুর মণি উপহার হিসেবে শাহজাহানকে দিয়েছিলেন মীর জুমলা। পরে মুঘল দরবারে তিনি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন। আওরঙ্গজেব মতায় আসার পর মীর জুমলা বাংলার সুবদার নিযুক্ত হন।
আসাম অভিযানের পর মীর জুমলা মারা গেলে তার পারিবারবর্গের অনেকেই এ দেশে থেকে যান। এ ভাবেই তারা এখনকার স্থায়ী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হন। খালেদা জিয়ার মা বেগম তৈয়বা মজুমদার বোদা চন্দনবাড়ির মেয়ে। তবে তিনি মুহাম্মদ দানিয়েলের কততম বংশধর তা জানা যায়নি। এ পরিবার বিখ্যাত ‘টি-ফ্যামিলি’ নামে পরিচিত। টি-ফ্যামিলি বক্সার যুদ্ধে ব্রিটিশকে সমর্থন দিয়েছিল। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদের তামার পাত্রে লেখা সনদ উপহার দেয়। তখন এ ফ্যামিলির যে কোন সদস্য বিনা খরচে লন্ডনে যেতে পারতেন।
মাতৃকূলের দিক থেকে জিয়াউর রহমানও মীর জুমলার বংশধর। বেগম খালেদা জিয়া  জিয়াউর রহমানের দূর সম্পর্কের খালাতো বোন।
পিতৃকূলের দিক থেকে বেগম খালেদা জিয়া আরব বংশোদ্ভূত। তার পূর্ব পুরুষরা ইয়েমেন থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এদেশে এসেছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা প্রথমে ইয়েমেন থেকে এসে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বসবাস শুরু করেন। পরে আসেন ফেনীর ফুলগাজীতে। প্রায় দশ পুরুষ আগে তার পূর্ব পুরুষরা এদেশে আসেন।
খালেদা জিয়ার দাদা হাজী সালামত আলী ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ। তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী, গায়ের রং ধব ধবে ফর্সা। এলাকর মানুষ তাকে দরবেশ হিসেবেই অখ্যায়িত করতো। তিনি ছিলেন যেমন দানশীল, তেমনি আল্লাহ্ওয়ালা। শেষ বয়সে সারাণ তিনি মসজিদে থাকতেন। নামাজ, তসবিহ-তাহলীল এবং আল্লাহ্-আল্লাহ জিকিরেই তিনি নিয়োজিত থাকতেন।
হাজী সালামত আলীর পাঁচ ছেলে দুই মেয়ে। ছেলে মেয়েদের মধ্যে সায়েরা খাতুন সবার বড়। এর পরই খালেদা জিয়ার বাবা এস্কান্দার মজুমদার। তিনি ১৯০৫ সালের ২৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। এস্কান্দার মজুমদারের ছোট হলো : মোছাদ্দেক হোসেন মজুমদার, আওলাদ হোসেন মজুমদার, জামশেদ হোসেন মজুমদার, রওশন আরা বেগম ও দোলায়ার হোসেন মজুমদার। সায়েরা খাতুনকে পাশের গ্রামের মুন্সীরহাট দরবার বাড়িতে বিয়ে দেয়া হয়। তার স্বামী ফজলুর রহমান জলপাইগুড়ি চা বাগানে চাকরি করতেন।
জলপাইগুড়িতে বোন ও দুলাভাইয়ের কাছে থাকার জন্য ছোটবেলা থেকেই এস্কান্দার মজুমদার বাবাকে বলতেন। অবশেষে ১৯১৯ সালে বাবা তাকে জলপাইগুড়ি থাকার অনুমতি দেন। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। বোনের কাছে থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে চা বাগানে তার চাকরি হয়। কিন্তু কিছুদিন চাকরি করার পর ভাল না লাগায় তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। জড়িয়ে যান চা ব্যবসায়। একবার তিনি টি-প্ল্যান্ট এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে ১৯ মার্চ জলপাইগুড়িতে তিনি বেগম তৈয়বা মজুমদারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
খালেদা জিয়ার বাবা এস্কান্দার মজুমদার ১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর মারা যান। তার পে এখন আর কেউ বেঁচে নেই। সর্বশেষে ছোট চাচা জামশেদ হোসেন মজুমদার ১৯৯৩ সালে মারা যান। খালেদা জিয়ার নানা তোয়াবুর রহমান ছিলেন একজন সাব রেজিষ্ট্রার। তার কোন মামা নেই। মায়ের পে শুধু একজন খালা আছেন। খালা-খালুরা দিনাজপুর থাকেন।
চাচা জামশেদ হোসেন মজুমদারের সঙ্গে খালেদা জিয়ার চেহারার অনেকটা মিল রয়েছে। অত্যন্ত সজ্জ্বন ব্যক্তি। অমায়িক ব্যবহার। কোন অহংকার ছিল না।
খালেদা জিয়ার বাবা এস্কান্দার মজুমদার অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও ছিলেন প্রাণবন্ত। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসের এক সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসায় গেলাম। তিনি আমাকে আম দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। বেশ আদুরে কণ্ঠে বললেন, খাও আমাদের গাছের আম। এখনও ভাল করে পাকে নাই। আব্বা নিয়ে এসেছেন। আম খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, ম্যাডাম আপনার আব্বা কি বাসায় আছেন? তিনি বললেন আছেন। বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি বললাম বেয়াদবি মাফ করবেন। আমি উনার সাথে একটু আলাপ করতে চাই। তিনি বললেন, বেশ তো। অসুবিধা কোথায়? এই বলেই ড্রইং রূম থেকে ভেতরে গেলেন। খানিক পরই এক সৌম্যদর্শন বয়োবৃদ্ধ ভদ্রলোক ড্রইংরুমে ম্যাডামের সাথে প্রবেশ করলেন। আমি দাড়িয়ে সালাম দিলাম এবং উনি সোফায় না বসা পর্যন্ত দাড়িয়েই রইলাম। ম্যাডাম আমার সাথে উনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সম্ভবত উনি পূর্ব থেকেই আমার সম্পর্কে জানতেন। আমার লেখা বই ‘মৃত্যুঞ্জয়ী জিয়া’ সম্পর্কেও কথা বললেন। বললেন, কাঁচা হাতের লেখা। ছেলে মানুষ তাই এখনও সবকিছু রপ্ত করতে পারোনি। তবে লেগে থাক। একদিন সাইন করবে। আমি বললাম মাত্র ১ মাসের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে লিখেছি। তাই খুব ভাল হয়নি। তবে একটা স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়েছি। ভবিষ্যতে আশা করি পরবর্তী সংস্করণে আরো ভালো হবে। আমি উনার দোয়া চাইলাম যাতে লেখালেখিতে আরো ভালো করতে পারি। খানিকণ দম নিয়ে আমি বললাম, শুনেছি আপনার পূর্ব পুরুষরা সাতকানিয়ায় বসবাস করছিলেন। সেখান থেকে ফেনীর ফুলগাজী। ফুলগাজী থেকে আপনি কুচবিহারের জলপাইগুড়ি গেলেন। সেখান থেকে আবার দেশ বিভাগের সময় দিনাজপুরে চলে এলেন। আপনার পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। আপনি দয়া করে বললে আমি কৃতজ্ঞ থাকব। সাথে সাথে ঠাট্টা করে বললেন, আমাকে নিয়ে বই লিখবে নাকি? আমি বললাম, লিখতেও পারি। তিনি একটু দম নিয়ে অনর্গলভাবে পারিবারিক ইতিহাস বলে যাচ্ছিলেন। যেগুলি এখনও আমার ডাইরির পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। তিনি বললেন, তোমাদের ম্যাডামের অর্থাৎ পুতুলের বয়স দুই বছর হবে। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়েছে। দেশ বিভাগের তোড়জোড় চলছে জলপাইগুড়িতে। আমার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। ভারতে থেকে খুব একটা সুবিধা করতে পারবো বলে মনে হলো না। তাছাড়া জলপাইগুড়িতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হওয়ায় দাঙ্গায় মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্থ হচ্ছিলো। ফলে ব্যবসাপাতি ঘুটিয়ে দিনাজপুরে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে আমার জলপাইগুড়ির বাড়িটি বেহাত হয়ে যায়। দিনাজপুরে এসে আবার ব্যবসা শুরু করি। আস্তে আস্তে ব্যবসায় উন্নতি হতে থাকে। মোটামুটি স্বচ্ছলভাবে চলার মতো। দিনাজপুরে এসে প্রথমে ঈদগাঁ বস্তিতে বাসা ভাড়া নেই। সেখানে প্রায় চৌদ্দ বছর ছিলাম। এরপর কিছুদিন ঘাঁসিপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকি। পরে দিনাজপুরের মুদিপাড়ায় জায়গা কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি। একটু দম নিয়ে আবার বললেন, আমার জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়েছি। তবে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে পেরেছি। এটাই সান্তনা। এখন বৃদ্ধ বয়সে মসজিদ, মাদ্রাসা ও সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করেই দিন কাটাচ্ছি। তাছাড়া কেউতো আমার কাছে নেই। আমরা বুড়ো-বুড়িই দিনাজপুরে আছি। যখনই মন চায় ছেলেমেয়ে, নাতি, নাতনীদের দেখতে চলে আসি। সেদিন উনার সাথে আমার অনেকণ অন্তরঙ্গভাবে আলাপ হয়েছিল। আলাপচারিতায় দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও এরশাদের সামরিক শাসন সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছিলেন।

শৈশবঃ 
খালেদা জিয়ার বাবা এস্কান্দার মজুমদার যখন সপরিবারে জলপাইগুড়ি থেকে দিনাজপুরে চলে আসেন তখন খালেদা জিয়ার বয়স দু’বছর। হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাটতে শিখেছেন। মুখে কথা ফুটেছে আগেই, জলপাইগুড়ি থাকা অবস্থায়। সেখানে মা-বাবা ডাকতে পরেন। নবীন রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবেশ ছিল তখন চমৎকার। গ্রাম-গঞ্জ ও শহর এলাকা ছিল অনেকটা ফাঁকা। দিনাজপুর শহর ছিলো আরো ফাঁকা। শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ। এত দালান-অট্টালিকা ছিল না। বাস, ট্যাক্সি এমনকি রিক্সারও এত হৈ-হুল্লোড় ছিল না। নৌপথে হস্তচালিত কাঠের নৌকা ও লঞ্চ আর রেলপথে মানুষ বেশি যাতায়ত করতো। পাড়া-প্রতিবেশীরা একজন আরেকজনের সাহায্যে এগিয়ে আসতো। মানুষের মধ্যে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। আনন্দ-উল্লাস আর নানা ধরনের বিনোদনের কমতি ছিল না। তখন পাড়ায়-মহল্লায় বুলবুলি, গোল্লাছুট, মোরগ আর ষাঁড়ের লড়াই দেখতে মানুষ ভীড় করতো। ঘুড়ি উড়ানো ছিল শখের খেলা। নদীতে নৌকা বাইচ আর মহররমের মিছিলে জৌলুসের অন্ত ছিল না। গ্রাম-গঞ্জে-শহরে প্রায়ই বসতো কাওয়ালী ও বাউল গানের জলসা। গ্রামে রাতের বেলায় অধিকাংশ বিয়ে হতো। বিয়ে বাড়িতে বর আসতো পালকি চড়ে। আর পালকি চড়ে বউ যেত শ্বশুরবাড়ি। সেই পালকি বহন করতো মুচি সম্প্রদায়ের লোক। সবুজ শ্যামলে ভরা ছিল এই জনপদ। গাছে প্রচুর ফল, মাঠে সবুজ ধান, তরিতরকারি, নদীতে-বিলে প্রচুর মাছ। গাছে ফল পেকে থাকতো। খাওয়ার লোক ছিল কম। সে সময়ের এমনি মধুর পরিবেশে দিনাজপুরে বেড়ে ওঠেন খালেদা জিয়া। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই আছে আনন্দময় শৈশবের স্মৃতি। মাটির পুতুল দিয়ে বর-কনে সাজানো, বিয়ে দেয়া, ছোট্ট হাঁড়িতে মিছেমিছি রান্না করে চড়–ইভাতি খেলা, ছিপ দিয়ে মাছ ধরা, ঘুড়ি উড়ানো, কানামাছি খেলা, ছি কুৎকুত খেলা, বৃষ্টির পানিতে ভিজা, দুষ্টুমিতে সময় কাটিয়ে দেয়া আরও কত কি? বেগম খালেদা জিয়ার ছেলেবেলাও ছিল এমনি বর্ণাঢ্য, এমনি মধুর। দিনাজপুরে কাটে তাঁর স্মৃতিময় শৈশব ও সোনালি কৈশোর।
খালেদা জিয়ার শৈশব কেটেছে দিনাজপুরের ঈদগাঁ বস্তিতে। ( ঈদগা বস্তি দিনাজপুরের একটি স্বনামদন্য আবাসিক এলাকা)  একটি ভাড়া বাসায়। মেজো বোন বিউটি ছিল তাঁর সারাণ খেলার সাথী। পরিবারে খালেদা জিয়াই ছিলেন তখন সবার আদরের পুতুল। তাকে কেউ ধমক দিতে পারতো না। আদর করতে হতো। সেই আনন্দময় শৈশবের মুহূর্তগুলো একান্ত আলাপচারিতায় খালেদা জিয়ার মা বেগম তৈয়বা মজুমদার একদিন বর্ণনা করেছিলেন বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে।
চাচ্চুটা ভাল না। আমাদের বাসায় আর ওকে আসতে দিও না।’ বিউটিকে নিয়ে পুতুল সারাণ খেলত। কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল নিয়ে ওরা বউ খেলায় মেতে থাকত। ছোট হাঁড়িতে বালি দিয়ে রান্না চড়াত। মিছেমিছি খাবারের ভান করত। ওদের মধ্যে কোনদিন ঝগড়া হয়নি। পুতুলের একদিন আঙ্গুল কেটে গিয়েছিল, বিউটি তো কেঁদেই অস্থির। ছোটবেলায় পুতুল ওর বাবার গামছাকে শাড়ি হিসেবে পরত। ওর শখ দেখে ওর বাবা একটি ছোট্ট লাল শাড়ি এনে দেয়। ওটা ও পরত। আমরা ওকে তখন বলতাম লাল টুকটুকে বউ। বিউটি যখন পড়তে বসত, পুতুলও বিউটির কাছে গিয়ে বসত। বিউটির সঙ্গে সে পদ্য মুখস্থ করত। ওর বাবা বাসায় এলে পদ্য মুখস্থ শুনাতো। ওর বাবা বলত, আমার ওই মেয়েটি বিদ্বান হবে। বইয়ের ছবি দেখতে পুতুল পাগল ছিল। নতুন বই আনলেই উলটে-পালটে ছবি দেখত। ওর বয়স তখন চার। রোজার দিন। আমরা সবাই রোজা রাখছি। সে রোজা রাখতে প্রতিদিন কান্নাকাটি করত। আমরা বলতাম ছোট মানুষের রোজা এমনিতেই হয়। কিন্তু সে মানত না। পুতুল ‘রোজা রাখব’ বলতে পারত না।  বলতে ‘আম্মা আমি রোজা খাব’।  একদিন তো সে একটি রোজা রেখেই দিল। অনেক চেষ্টা করেও আমরা রোজা ভাঙাতে পারিনি। আমার সঙ্গে নামাজের বিছানায় নামাজও পড়ত। ওর বাবা এবং আমি ওকে মুখে মুখে কলমা শিখিয়েছি। অবশ্য একটু বড় হলো মৌলানা সাহেব রেখে আমরা ওদের নামাজ ও কলমা-কালাম শিখিয়েছি। শবে বরাতের দিন পুতুল ফকির-মিসকিনদের হালুয়া-রুটি বিলিয়ে দিত। রাতে আমাদের সঙ্গে নামাজ পড়ত। ঈদের দিনে নতুন কাপড় পরে খুব মজা করত। ছোটবেলা থেকেই পুতুলের তেমন চাহিদা নেই। অন্যের নতুন জামা-কাপড় দেখে ও সেটা কিনে দেয়ার জন্য বায়না ধরত না। ছোট বেলায় পুতুল গান করেছে, নাচ করেছে। ওর জন্য নাচের মাস্টার রেখেছিলাম। বাসায়ও নাচ করেছে। অবশ্য একটু বড় হলে আর নাচে উৎসাহিত করিনি।”¾“পুতুল ছিল আমার পরিবারের সবার আদরের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই ও খুব সুন্দর। ওর বাবা ওকে ভীষণ আদর করত। কাউকে কিছু বলতে দিত না। প্রতিদিন ওর বাবা বাসায় এলেই ও দৌড়ে গিয়ে কোলে উঠতো। ওর বাবা ওর কাছে জিজ্ঞেস করতো কে কে আদর করেছে, কে করেনি। কেউ কিছু বলেছে কি-না। পুতুলের বয়স তখন দু’বছর। মুখে কথা ফুটেছে। আমরা জলপাইগুড়িতে। আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ডা. অবনী গুহ নিয়োগী একদিন বাসায় এসে পুতুলকে কোলে নিল। অবনী গুহের গোঁফ ছিল অনেক বড়। সে পুতুলকে আদর করে বললো, ‘এই বুড়ি! তোকে গোঁফ দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাব।’ পুতুল তখনই ওর কোল থেকে নেমে এসে আমার কাছে নালিশ করে
পাঁচ বছর বয়সে খালেদা জিয়ার স্কুল জীবন শুরু হয়। তাঁর বাবা তাঁকে প্রথমে দিনাজপুর মিশনারি কিন্ডার গার্ডেনে ভর্তি করে দেন। মেজো বোন বিউটির সঙ্গে স্কুলে যেতেন। ছোট বেলা থেকেই খালেদা জিয়া খুব পরিপাটি ও গোছানো স্বভাবের ছিলেন। খুব লাজুক ছিলেন। কম কথা বলতেন। ফুল ছিল তাঁর খুব প্রিয়। ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং সাজিয়ে রাখা ছিল পছন্দ।

জিয়া ও খালেদা জিয়ার বিয়ে

এক যে ছিল রাজপুত্র। একদিন সে রাজপুত্র এক রাজকন্যার সাাৎ পেল। রাজপুত্রের চোখে রাজকন্যাকে অপূর্ব লাগল। রাজপুত্র রাজকন্যার জন্য পাগলপ্রায়। অবশেষে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে রাজপুত্র রাজকন্যাকে বিয়ে করল এবং তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।
জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বিয়ের ঘটনাটি সেই রূপকথার কাহিনীর মতোই। তাঁরা রাজপরিবারের কোন রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা ছিলেন না। কিন্তু তাদের বিয়ে হয় অনেকটা এভাবেই।
খালেদা জিয়া এবং জিয়াউর রহমান উভয়েই মাতৃকূলের দিক দিয়ে মীর জুমলার বংশধর। খালেদা জিয়া ছিলেন জিয়াউর রহমানের দূর সম্পর্কীয় খালাতো বোন। জিয়া তাঁর মকবুল নানার কাছে প্রথম শুনেছিলেন খালেদা জিয়ার কথা। শুনেছিলেন তাঁর সেই খালাতো বোনটি দেখতে রাজকন্যার মতো। মকবুল নানা জিয়াকে তাঁর ঐ বোনটি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওকে অন্ধকার রাতে দেখলে মনে হবে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।’ জিয়া তাঁর ছবি মামার কাছেও খালেদা জিয়ার একই প্রশংসা শুনেছিলেন। জিয়ার খুব ইচ্ছে হলো সেই বোনটিকে এক নজর দেখতে। একদিন দিনাজপুর যাওয়ার সুযোগ হলো। সেই সুবাধেই জিয়া দেখতে পেলেন খালেদা জিয়াকে। খালেদা জিয়া তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। তাকে দেখে জিয়া তাঁর নানা ও মামার দেয়া বর্ণনার সঙ্গে মিল খুঁজে পেলেন।
 পুতুল। খালেদা খানম।¾ ছেলেবেলায় খালেদা জিয়া ছিলেন খুব লাজুক। খুব কম কথা বলতেন। জিয়া খালেদার উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা ও সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হলেন। তখন থেকেই জিয়া তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। তাঁর এই স্বপ্নের কথা তিনি তাঁর ছবি মামাকেও জানিয়েছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর একবার মামীর কাছে লেখা চিঠিতেও তিনি লিখেছিলেন, ‘সেই দিদিমণিটি কেমন আছে? সেই দিদিমণিটিই
খালেদা জিয়ার বিয়ের ঘটনা সম্পর্কে ১৯৯১ সালে তার বড় বোন সাবেক মন্ত্রী মরহুমা খুরশীদ জাহান হক তার বনানীর বাসায় একান্ত আলাপচারিতায় বলেন :
“জিয়া তখন ছিল সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডিএফআই’র অফিসার হিসেবে ওর পোস্টিং হলো দিনাজপুরে। আমরা থাকতাম দিনাজপুরের ঈদগাঁ বস্তি এলাকায় ভাড়াটে বাসায়। দিনাজপুরের চাকরির সময় জিয়া মাঝে-মধ্যে আমাদের বাসায় আসতো। জিয়ার একটি অসম্ভব গুণ ছিল, সে সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতো। পুতুল মেট্রিক পাশ করার পর জিয়া একদিন আমাদের বাসায় এলো। আম্মার কাছে গিয়ে বললো, “খালা আমি আপনার জামাই হতে চাই”। আম্মা হেসে ফেললেন। তখন কিছুই বললেন না। আব্বা বাসায় এলে তাঁকে বলা হলো জিয়ার কথা। আব্বা বললেন মন্দ কি! তবে পুতুলের বয়স তো খুব কম। আম্মা এ ঘটনাটি আমার স্বামীকে জানালেন। তিনি সদ্য আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। কারণ তার যুক্তি ছিল পুতুলের বয়স খুব কম। মাত্র ম্যাট্রিক পাশ করেছে। ডিগ্রী পাশ না করা পর্যন্ত বিয়ে কি করে হয়। অন্যদিকে জিয়া সেনাবাহিনীর লোক। এটা নিয়েও আমরা ভাবলাম। প্রথমে প্রায় সবারই অমত ছিল। তবে জিয়াকে আমরা সবাই পছন্দ করতাম। এদিকে জিয়াও বার বার খবর নিতে থাকল। অবশেষে আমরা বিয়েতে সম্মত হই।”
খালেদা জিয়ার মা বেগম তৈয়বা মজুমদার জানান, তাঁর মকবুল চাচা (জিয়ার নানা) আনুষ্ঠানিকভাবে জিয়ার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে মুদিপাড়ার বাসায় জিয়া ও পুতুলের বিয়ে হয়। বিয়ে হয়েছিল অনেকটা তাড়াহুড়ো করে। প্রথমে আকদ হয়েছিল। এক বছর পর ঢাকার শাহবাগ হোটেলে (বর্তমান পিজি হাসপাতাল) তাদের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা দেয়া হয়।
বিয়ের স্মৃতি বর্ণনা করে মেজো বোন সেলিমা ইসলাম বিউটি জানান, ১৯৬০ সালে আমার বিয়ের কয়েক মাস পরে আগস্ট মাসে পুতুলের বিয়ে ঠিক হয়। আম্মা হঠাৎ খবর দেন যে, তোমরা একটু আস। বিয়েতে আড়ম্বর হয়নি। আমিই পুতুলকে গায়ে হলুদ দিয়েছি এবং মেহেদি মেখে দিয়েছি। জিয়ার সঙ্গে ওকে বেশ মানিয়েছিল।
বিয়ের পর জিয়া অবসর পেলেই খালেদা জিয়াকে নিয়ে বেড়াতেন। একবার তারা বড় বোন খুরশীদ জাহান হকের খালিশপুরের বাসায় বেড়াতে যান। খুরশীদ জাহানের স্বামী জনাব মোজাম্মেল হক খালিশপুর নিউজপ্রিন্ট মিলের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
১৯৬৫ সালে জিয়া খালেদা জিয়াকে নিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখানে তাঁর পোস্টিং হয়। সে সময় পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানেই ছিলেন। জিয়া যুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। তিনি খেমকারান রণাঙ্গনের ‘বেদীয়ান’-এ যুদ্ধরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাট্যালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। তাঁর কোম্পানির নাম ছিল আলফা কোম্পানি। সে যুদ্ধে জিয়া বীরত্ব দেখিয়েছিলেন এবং পদকও পেয়েছিলেন। যুদ্ধের কথা জানিয়ে বেগম খুরশীদ জাহান হক আলাপচারিতায় বলেন, “ঐ সময় পুতুল এবং জিয়ার খবর নেয়ার জন্য আমরা প্রায়ই পাকিস্তানে ফোন করতাম। পুতুল তাদের কুশলাদি জানাত। আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম কোন অসুবিধা হচ্ছে কি-না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সে ছিল দৃঢ় মনের। বলত তোমরা অযথা ভেবো না।  পাকিস্তানের বান্নো এলাকায় পুতুল থাকত। সেখানেই ১৯৬৬ সালের ২০ নভেম্বর পিনোর জন্ম হয়।”
পাকিস্তান থেকে ফেরার স্মৃতি বর্ণনা করে বেগম তৈয়বা মজুমদার একান্ত আলাপচারিতায় জানান, “পুতুল ওর শ্বশুরের খুব প্রশংসা করতো। বলতো ওর শ্বশুর ওকে খুব আদর করত। এটা কিনে দিত, ওটা কিনে দিত। ওর শাশুড়ি যে বেতারে গান করতেন তা বলত। জিয়া ও পুতুল ছিল মধুর দম্পতি। ওরা কেউ কারো সম্পর্কে কোনদিন অভিযোগ করেনি।”

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads